বক্সিংয়ে সাফল্য এখন শুধুই স্মৃতি

সেনাবাহিনীর বক্সার মুজাহিদ হকের (নীল জার্সি) পাঞ্চ ঠেকানোর চেষ্টা পুলিশের শাহাবুদ্দিনের। কাল পল্টন মোহাম্মদ আলী বক্সিং স্টেডিয়ামেছবি: সংগৃহীত

জীবনযুদ্ধে বেঁচে থাকতে বক্সিং রিংয়ের বাইরেও লড়তে হচ্ছে মোহাম্মদ তানজিল ও জীবন ইসলামকে। চাঁপাইনবাবগঞ্জে একটি স্টিলের ফার্নিচারের দোকানের শ্রমিক তানজিল। আর রাঙামাটির জীবন চায়ের দোকানদার। ঢাকায় চলমান বঙ্গবন্ধু ৩০তম জাতীয় বক্সিং প্রতিযোগিতায় অংশ নিচ্ছেন এই দুই বক্সারই।

বাবা পক্ষাঘাতগ্রস্ত, সংসার চালাতে পড়াশোনা ছেড়ে স্টিলের দোকানে কাজ নেন তানজিল। কাজের ফাঁকে সময় বের করে অনুশীলন করেন। আর্থিক অনটনের কারণে জীবনেরও পড়ালেখা থমকে গেছে। নিরুপায় হয়ে তিনি এখন বসেন বাবার চায়ের দোকানে। শুধু তানজিল আর জীবনই নন, বাংলাদেশের প্রায় সব বক্সারের গল্পই এ রকম। অধিকাংশ বক্সারই উঠে এসেছেন নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে। স্বাভাবিকভাবেই তাঁদের বক্সার হওয়া বক্সিংকে ভালোবেসে নয়, আর্থিক উপার্জনটাই এখানে মুখ্য। বক্সিংয়ে এলে সুযোগ তৈরি হয় সার্ভিসেস সংস্থায় চাকরি পাওয়ার।

বাংলাদেশে বক্সিংয়ের চর্চা সেভাবে নেই বললেই চলে। যশোর, খুলনা ও রাজশাহী থেকে উঠে আসেন বেশির ভাগ বক্সার। তবে গত কয়েক বছরে বক্সিং ছড়িয়েছে চাঁপাইনবাবগঞ্জ, জামালপুর, বরিশাল, রাঙামাটিতেও। বাংলাদেশ সেনাবাহিনী, বাংলাদেশ আনসার, বাংলাদেশ পুলিশ, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) ও বাংলাদেশ রেলওয়ে দলে বক্সিং ডিসিপ্লিন আছে। ওই সব জেলা থেকে উঠে আসা সম্ভাবনাময় বক্সারদের নিয়ে দল গড়ে তারা। ব্যবস্থা করে তাঁদের প্রশিক্ষণ ও খেলার। বক্সাররা পেয়ে যান চাকরিও।

১৯৭৭ সালে ইন্দোনেশিয়ায় অষ্টম এশিয়ান বক্সিং চ্যাম্পিয়নশিপে বাংলাদেশের হয়ে প্রথম আন্তর্জাতিক পদক জেতেন বক্সার আবদুল হালিম ও আবদুর রউফ। দুজনই সেবার ব্রোঞ্জ জিতেছিলেন। বাংলাদেশে খুব একটা জনপ্রিয় না হলেও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে খেলাধুলা থেকে বাংলাদেশের প্রথম বড় অর্জনও এসেছিল বক্সিং থেকেই। এশিয়ান গেমসে বাংলাদেশের হয়ে প্রথম পদক জেতেন বক্সার মোশাররফ হোসেন। ১৯৮৬ সালে সিউলে অনুষ্ঠিত দশম এশিয়ান গেমসে ব্রোঞ্জ জিতেছিলেন তিনি। সেটাই প্রথম এবং সেটাই শেষ। এশিয়ান গেমস বক্সিং থেকে বাংলাদেশের এরপর আর কোনো অর্জন নেই।

দক্ষিণ এশিয়ার বক্সিংয়েও বাংলাদেশের সাফল্যের অর্জনের খরা দীর্ঘদিনের। ১৯৮৪ সাল থেকে এ পর্যন্ত ১৩টি এসএ গেমসে অংশ নিয়েছেন বাংলাদেশের বক্সাররা। সব মিলিয়ে সোনা জিতেছে ৪টি, রুপা ১৮টি ও ব্রোঞ্জ ৫৬টি। ঢাকায় হওয়া ১৯৮৫ ও ১৯৯৩ এসএ গেমসে সোনা জিতেছিলেন মোশাররফ হোসেন ও মোজাম্মেল হোসেন। বক্সিং থেকে বাংলাদেশের সর্বশেষ সোনার পদকটিও এসেছে ১১ বছর আগে। ২০১০ সালের ঢাকা গেমসে জুয়েল আহমেদ ও আবদুর রহিম জেতেন সোনা।

আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সাফল্য না আসার পেছনে অনেক কারণই দেখেন বক্সাররা। দীর্ঘ মেয়াদে অনুশীলনের অভাব, আন্তর্জাতিক মানের জিমনেসিয়ামের স্বল্পতা ও কোচের অপ্রতুলতা এর মধ্যে অন্যতম। ঘরোয়া প্রতিযোগিতায় বিচারকদের নিরপেক্ষতা নিয়েও প্রশ্ন আছে অনেকের। প্রতিভাবান অনেক বক্সারই বিচারকের বিতর্কিত সিদ্ধান্তে হেরে খেলাই ছেড়ে দিয়েছেন বলে অভিযোগ আছে। ঘরোয়া টুর্নামেন্ট আয়োজন করে নতুন প্রতিভা অন্বেষণেও উদ্যোগী নয় বক্সিং ফেডারেশন। জাতীয় সিনিয়র, যুব বক্সিং, জাতীয় জুনিয়র, স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসসহ হাতে গোনা কিছু আসরের বাইরে আর কোনো প্রতিযোগিতা হয় না।

অবশ্য ২০১০ সালে এসএ গেমসে পাওয়া সোনালি সাফল্যের জন্য সেনাবাহিনীর বক্সার আবদুর রহিম কৃতিত্ব দিয়েছেন তখনকার ফেডারেশনকে, ‘ওই সময় ফেডারেশন আমাদের টানা এক বছর অনুশীলন করিয়েছিল। গেমসের আগে থাইল্যান্ড ও ইতালিতে অনুশীলনের জন্য পাঠিয়েছিল। থাইল্যান্ডের কোচ থান তো ওয়ান আমাদের প্রশিক্ষণ দিয়েছিলেন।’

বক্সিংয়ের উন্নতির জন্য কোচ ও বিচারকদের আন্তর্জাতিক মানের প্রশিক্ষণ জরুরি বলে মনে করেন ফেডারেশনের কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্য ও চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলার কোচ রাজু আহমেদ, ‘নিজে ফেডারেশনের ইসি মেম্বার (কার্যনির্বাহী সদস্য) হয়েও বলব, ফেডারেশনে অনেক দুর্বলতা আছে। রেফারি ও বিচারকদের পক্ষপাতিত্ব ছাড়তে হবে। প্রায়ই খেলায় ভুল সিদ্ধান্ত দেন তাঁরা। এতে ভালো মানের বক্সারদের মন ভেঙে যায়। অনেকে খেলাই ছেড়ে দেন।’

বেশি প্রতিযোগিতা আয়োজনের সঙ্গে কোচদের প্রশিক্ষণ চান আনসারের কোচ ফজলুর রহমান, ‘ফেডারেশনের উচিত আরও বেশি খেলার আয়োজন করা। যত খেলা হবে, তত নতুন বক্সার তৈরি হবে। সারা দেশে কোচেস প্রশিক্ষণ নিয়মিত হয় না। জেলায় জেলায় ভালো কোচ নিয়োগ দিলে ভালো বক্সার বেরিয়ে আসবে। ফেডারেশনের তেমন উদ্যোগ নেই।’

এসব অভিযোগের জবাবে বক্সিং ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক মাজহারুল ইসলাম বলেন, ‘আমি দায়িত্ব নিয়ে মাত্র ১৮ মাস কাজ করার সুযোগ পেয়েছি। করোনার কারণে ইচ্ছা থাকলেও কিছু করা সম্ভব হয়নি। তবে এখনো বক্সারদের দীর্ঘমেয়াদি অনুশীলন করানোর পরিকল্পনা আছে।’ বিচারকদের নিরপেক্ষতা নিয়ে ওঠা প্রশ্ন মেনে নিয়েই জানান, ফেডারেশন বাংলাদেশেই আন্তর্জাতিক মানের বিচারক ও কোচ তৈরির উদ্যোগ নিতে যাচ্ছে। তাঁর আশা, ‘যেভাবে কাজ করে যাচ্ছি, তাতে আশা করি আগামী এসএ গেমসেই বাংলাদেশ সোনা জিতবে।’