ভলিবলের চর্চা নেই, তবুও স্বপ্ন দেখান জাবির–হরষিতরা

ভলিবলের তারকা জাবিরছবি: শামসুল হক

জাতীয় ভলিবল দলের ইরানি কোচ আলিপোর আরজির সঙ্গে একের পর এক ছবি তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন বাংলাদেশের খেলোয়াড়েরা। এশিয়ান সেন্ট্রাল জোন ভলিবল চ্যাম্পিয়নশিপের রানার্সআপ ট্রফিটা ঘুরেফিরে সবাই হাতে নিয়ে ছবি তুললেন কাল। অথচ এ টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন হওয়ারই স্বপ্ন দেখেছিল বাংলাদেশ পুরুষ ভলিবল দল। শেষ পর্যন্ত মিরপুর শহীদ সোহরাওয়ার্দী ইনডোরে ফাইনালে বাংলাদেশকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে টুর্নামেন্টে প্রথমবার খেলতে আসা শ্রীলঙ্কা।

ভলিবলে আন্তর্জাতিক সাফল্য কালেভদ্রেই পায় বাংলাদেশ। পুরুষ ও নারী ভলিবল দল মিলিয়ে দক্ষিণ এশিয়ান গেমসে এ পর্যন্ত ব্রোঞ্জ জিতেছে পাঁচবার। এর মধ্যে ১৯৮৭ সালে কলকাতায়, ১৯৯১ কলম্বো, ১৯৯৩ ঢাকা ও ১৯৯৯ সালে কাঠমান্ডু সাফ গেমসে (এখন নাম এসএ গেমস) ব্রোঞ্জ জেতে বাংলাদেশ পুরুষ ভলিবল দল। ১৯৯১ সালে বাংলাদেশ নারী ভলিবল দল একমাত্র ব্রোঞ্জটি জেতে কলম্বোতে।

ভলিবলে আন্তর্জাতিক সাফল্য কালেভদ্রেই পায় বাংলাদেশ
ছবি: প্রথম আলো

২২ বছর ধরে এই যে বাংলাদেশ ভলিবল দলের সাফল্য–খরা, এর পেছনে অন্যতম কারণ ভলিবল খেলাটির চর্চার অভাব। এটিকে সবার মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার উদ্যোগের অভাব। আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় নিয়মিত না খেলার ব্যাপারটি তো আছেই। পুরুষ দলটি তো তা–ও মাঝেমধ্যে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে অংশ নিতে পারে। কিন্তু মেয়েদের জাতীয় দলই ছিল না গত ২০ বছর! অবশেষে ২০১৯ সালে ঢাকায় হওয়া এশিয়ান সেন্ট্রাল জোন ভলিবল টুর্নামেন্ট দিয়ে নারী দল আবারও খেলায় ফেরে। ওই টুর্নামেন্টের পর কাঠমান্ডু এসএ গেমসে খেলেছে ২০১৯ সালে। দুই বছরের বিরতির পর এবার ঢাকায় এশিয়ান সেন্ট্রাল জোন ভলিবলে খেলার সুযোগ পেয়েছে বাংলাদেশের মেয়েরা। ক্রিকেটার, সাঁতারু, কাবাডি, রকবল ও ডিউবল খেলোয়াড়দের নিয়ে জোড়াতালির নারী দল শেষ পর্যন্ত ছয় দেশের মধ্যে হয়েছে পঞ্চম। একমাত্র ম্যাচটি তারা জিতেছে মালদ্বীপের বিপক্ষে।

দেশে ভলিবলের চর্চা নেই
ছবি: প্রথম আলো

এসএ গেমসের বাইরে বাংলাদেশ পুরুষ দলের একমাত্র আন্তর্জাতিক অর্জন এশিয়ান সেন্ট্রাল জোন ভলিবলে চ্যাম্পিয়ন হওয়া। ২০১৫ সালে ঢাকায় প্রথমবার আয়োজিত হয় এই টুর্নামেন্ট। সেবার প্রথম আসরে চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল তুর্কমেনিস্তান, রানার্সআপ কিরগিজস্তান।

২০১৬ সালে কিরগিজস্তানকে হারিয়ে চ্যাম্পিয়ন হয় বাংলাদেশ। ১৯৭২ সালে ফেডারেশন প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর ওটাই ছিল বাংলাদেশের ভলিবলে সর্বোচ্চ আন্তর্জাতিক অর্জন। এরপর ২০১৮ সালে তুর্কমেনিস্তানের কাছে ফাইনালে হেরে রানার্সআপ হয় বাংলাদেশ।

যেখানে পিছিয়ে বাংলাদেশ

সেন্ট্রাল জোন ভলিবলে এবার পুরুষ বিভাগে অংশ নিয়েছে উজবেকিস্তান, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, মালদ্বীপ ও বাংলাদেশ। লিগ পর্ব ও ফাইনাল মিলিয়ে বাংলাদেশ খেলেছে ৫টি ম্যাচ। এর মধ্যে ৩টিতে জয়। দুটি ম্যাচই হেরেছে শ্রীলঙ্কার কাছে। কিন্তু লঙ্কানদের বিপক্ষে লড়াইগুলো একপেশে ছিল না। বিশ্ব ভলিবল র‌্যাঙ্কিংয়ে শ্রীলঙ্কার অবস্থান ৫০। বাংলাদেশের ৯৩। কিন্তু সেই শ্রীলঙ্কার সঙ্গে দুর্দান্ত লড়াই করেও হেরেছে শুধু অভিজ্ঞ খেলোয়াড়ের অভাবের কারণে। বাংলাদেশের তুলনায় শ্রীলঙ্কায় ভলিবল খেলাটির চর্চা অনেক বেশি। স্থানীয় টুর্নামেন্টও লঙ্কান ভলিবল খেলোয়াড়েরা অনেক বেশি খেলেন।

অনিয়মিত বিদেশি কোচ

বাংলাদেশ ভলিবল দলের জন্য দীর্ঘমেয়াদি কোনো কোচ নেই। শুধু আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট সামনে থাকলেই কয়েক মাসের জন্য আনা হয় বিদেশি কোচকে। এবারও যেমন টুর্নামেন্ট শুরুর মাত্র দেড় মাস আগে ইরানের আলিপোর আরজিকে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। টুর্নামেন্ট শেষ, কোচও ফিরে যাবেন ইরানে।

নেই জাতীয় দলের পাইপলাইন

যেহেতু খেলাটির চর্চা নেই, তাই এ খেলায় ভালো খেলোয়াড়ের বেশ অভাব বাংলাদেশে। বাংলাদেশ জাতীয় দল আছে, তবে নামকাওয়াস্তে। যুবদল করার কথা কোনো দিন ভাবেনি ফেডারেশন। ঘরোয়া কোনো বয়সভিত্তিক ভলিবল প্রতিযোগিতাও আয়োজন করে না ফেডারেশন। তাই বাংলাদেশের রিজার্ভ বেঞ্চ খুবই দুর্বল। এবারের দলে শুধু সাইদ আল জাবির, হরষিত বিশ্বাস, মোহাম্মদ সুজনদের মতো কয়েকজন আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেছেন। এর বাইরে ৯ জন একেবারে নতুন। বাস্তবতা হচ্ছে আনফিট হরষিত এক ম্যাচ ভালো খেললে পরের ম্যাচে নিজের সেরাটা দিতে পারেননি। কিন্তু তাঁকে তুলে নিয়ে বিকল্প কাকে নামাবেন, সেই খেলোয়াড়ও খুঁজে পাননি কোচ। টুর্নামেন্টের সেরা স্পাইকার শ্রীলঙ্কার জয়লেথ আরাচসিগি মাহেলা ইনদিওয়ারে বান্দারা এশিয়ান সেন্ট্রাল জোনের যুব চ্যাম্পিয়নশিপেও হয়েছিলেন সেরা খেলোয়াড়। বাংলাদেশের কাছ থেকে বেশির ভাগ পয়েন্টই ছিনিয়ে নিয়েছেন মাহেলা।

প্রস্তুতির অভাব ও আন্তর্জাতিক ম্যাচের স্বল্পতা

এ টুর্নামেন্টে খেলতে আসার আগে যেখানে নেপাল, শ্রীলঙ্কা বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় ব্যস্ত ছিল, সেখানে বাংলাদেশ কোনো প্রস্তুতি ম্যাচই খেলতে পারেনি। মাত্র দেড় মাসের অনুশীলন করেছে বাংলাদেশ। আর প্রায় দুই বছর পর এই টুর্নামেন্ট দিয়েই আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্টে ফিরেছেন হরষিতরা।

ঘরোয়া টুর্নামেন্টে বৈচিত্র্যের অভাব

ফেডারেশন শুধু বর্ষপঞ্জিতে থাকা নিয়মিত টুর্নামেন্ট—ফেডারেশন কাপ, লিগ ও বিজয় দিবস, স্বাধীনতা দিবসের মতো প্রতিযোগিতার আয়োজন করে। সেখানে সাধারণ মানের প্রিমিয়ার লিগে খেলছে তিতাস ক্লাব, বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড, পানি উন্নয়ন বোর্ড, বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ, ওয়ারী ক্লাব, বাংলাদেশ পুলিশ, বাংলাদেশ জেল ও আনসারের মতো দলগুলো। নতুন খেলোয়াড় বের করে আনার উদ্যোগও কম ফেডারেশনের।

প্রয়োজন দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা

প্রতিবার টুর্নামেন্ট শেষে ভলিবল আলোচনায় উঠে আসে। কিন্তু টুর্নামেন্ট শেষ হলে খেলোয়াড়েরা কোথায় চলে যাবেন, সেই খোঁজও রাখবে না ফেডারেশন। যদিও এবার অনেক আশার গান শোনাচ্ছেন ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক আশিকুর রহমান, ‘আমরা এবার দীর্ঘমেয়াদি ক্যাম্প করব এই খেলোয়াড়দের নিয়ে।’ যুগ্ম সম্পাদক ফজলে রাব্বি আরও এক ধাপ বাড়িয়ে বললেন, বিপিএল ক্রিকেটের আদলে বাংলাদেশে আয়োজন করা হবে প্রিমিয়ার ভলিবল লিগ, ‘আগামী মার্চে আমরা পেশাদার ভলিবল লিগ করব। যেখানে দেশ–বিদেশের খেলোয়াড়েরা খেলবে। ক্রিকেটের মতোই হয়ে থাকবে বিভিন্ন ফ্র্যাঞ্চাইজি। এতে খেলোয়াড়েরা ভালো অঙ্কের টাকাও পাবে।’

শুধু তা–ই নয়, বয়সভিত্তিক টুর্নামেন্টের দিকেও নজর দিচ্ছেন তিনি, ‘আমরা আগামী বছর অনূর্ধ্ব-২৩ এশিয়ান সেন্ট্রাল জোনের প্রতিযোগিতার আয়োজন করব বাংলাদেশে। ঢাকায় হওয়া ফিবার কংগ্রেসে উজবেকিস্তানের কাছ থেকে বিড করে আমরা নিয়েছি এ টুর্নামেন্ট। বয়সভিত্তিক দল গড়ার উদ্দেশ্যেই এ সিদ্ধান্ত আমাদের।’

এ বছরই পল্টনে ভলিবল স্টেডিয়াম নতুন করে সংস্কার করা হয়েছে। খেলোয়াড়দের জন্য করা হয়েছে আন্তর্জাতিক মানের জিম–সুবিধা ও আবাসন। এবার শুধু পরিকল্পনাগুলো বাস্তবায়ন করতে হবে। তাহলেই হয়তো এই খেলোয়াড়েরাই এনে দিতে পারবেন আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বড় সাফল্য।