লাখপতি ‘দঙ্গল’ কুস্তিগির এখন ১০ রুপিতে বস্তা টানেন

গোলু পালোয়ান নামে খ্যাত দেশ রাজ কাজ করছেন মজুর হিসেবে।
ছবি: টুইটার

সন্ধ্যা ৭টা। সংগ্রাম তখনও জীবন–সংগ্রামে ব্যস্ত। পিঠের ওপর বস্তার ভার। প্রতি কুইন্টাল বস্তা টানায় মেলে ১০ রুপি করে। কাজ শুরু হয় সেই সকাল ৮টায়—হরিয়ানার বাহাদুরগায়। শরীরটা ২৬ বছরের তাগড়া জোয়ান হলেও একের পর এক বস্তা টানায় পিঠটা ভেঙে যাওয়ার দশা হয়। সংগ্রাম তবু শিরদাঁড়া সোজা করে চলে আশা নিয়ে—পাল্টে যাওয়া এই জীবন একদিন আবার বদলে যাবে। ফিরিয়ে দেবে তাঁর সেই কাদামাটির লড়াই—দঙ্গল!

নামটা পরিচিত লাগছে? ভারতের চলচ্চিত্র ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি আয়কারী সিনেমা ‘দঙ্গল’। কাদামাটির মধ্যে কুস্তিখেলা নিয়ে এ সিনেমায় অভিনয় করেছিলেন আমির খান। ভারতে ভীষণ জনপ্রিয় এ খেলারই চ্যাম্পিয়ন কুস্তিগির সংগ্রাম। করোনাভাইরাস মহামারির আগে এ খেলা থেকেই লাখ টাকা আয় করতেন তিনি। কিন্তু করোনা এসে দঙ্গল তুলে দিয়েছে—মানে, খেলাটা বন্ধ আছে। কিন্তু পেট তো আর বসে নেই। টান পড়ে প্রতিদিনই। এই টান হালকা করতেই চ্যাম্পিয়ন কুস্তিগির সংগ্রাম এখন কুলি।

দিনে ৩০০ রুপি করে আয় করি। যত পদক ও শিরোপা ছিল সব বেচে দিয়েছি। এখন বেঁচে থাকাটাই আসল কথা।
কুশল নাথ, কুস্তিতে বিহারের রাজ্য চ্যাম্পিয়ন

সংগ্রামের পরিবারে মুখ আছে আরও চারটি—স্ত্রী, দুই মেয়ে ও ছেলে। তাদের নিয়ে এখন জীবন সংগ্রাম চলছে এ কুস্তিগিরের। অথচ করোনা আসার আগেও জীবনটা তাঁর অন্যরকম ছিল, ‘প্রতি বছর দঙ্গলে অংশ নিয়ে আমি দুই থেকে আড়াই লাখ রুপি আয় করতাম। আমার সব সঞ্চয় শেষ। এখন যে কাজ (কুলি) করছি তাতে মাসে ৫ হাজার রুপি আসে। এত অল্প টাকায় পাঁচজনের পরিবার চালানো ভীষণ কঠিন।’

এই সংগ্রামে সংগ্রাম কিন্তু একা নয়। ভারতের আনাচে–কানাচে ছড়িয়ে থাকা দঙ্গল কুস্তিগিরদের একই দশা। জীবন বাঁচাতে এখন এমন সব কাজ বেছে নিতে হচ্ছে কুস্তিগিরদের।

যেমন গোলু পালোয়ান। নাম দেশ রাজ হলেও ভারতে তিনি গোলু পালোয়ান নামে পরিচিত। লকডাউনের আগে পাঞ্জাব, হরিয়ানা, জম্মু, রাজস্থান, উত্তর প্রদেশে কুস্তি লড়েছেন তিনি। কিন্তু এখন কাজ করছেন মজুরের। সংবাদমাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়াকে তিনি বলেন, ‘মাসে ৭ থেকে ৮ হাজার টাকা আয় হয়। দঙ্গল তো অলিম্পিক কুস্তি নয় যে সরকারি সাহায্য পাওয়া যাবে।’

কুস্তিগির গুরিন্দর সিং এখন সবজি ও ফল–মূল বিক্রেতা।
ছবি: টুইটার

আরেক কুস্তিগির গুরিন্দর সিং বাজারে বিক্রি করছেন শাক–সবজি, ফলমূল। গুরিন্দর জানালেন তাঁর জীবন–সংগ্রামের কথা, ‘দঙ্গল ছাড়া আমার আয়ের কোনো উৎস ছিল না। পরিস্থিতি এ পর্যায়ে আসার আগে কীভাবে এসব কাজ করতে হয় সেটাও জানতাম না। দঙ্গল না হওয়ায় জীবন খুব কঠিন হয়ে পড়েছে। ঠিকমতো খাওয়াও জোটে না...অনুশীলন তো বহু দূরের কথা। শুধু শসা ও পেঁপে খেয়েও দিন কেটেছে।’

কুস্তিতে জাতীয় পর্যায়ে বিহারের রাজ্য চ্যাম্পিয়ন কুশল নাথ। দঙ্গলে নেমেছেন পরে। করোনার কারণে এখন মজুরের কাজ করছেন তিনি, ‘দিনে ৩০০ রুপি করে আয় করি। যত পদক ও শিরোপা ছিল সব বেচে দিয়েছি। এখন বেঁচে থাকাটাই আসল কথা।’

দ্রোণাচার্য পুরষ্কার পাওয়া মহাবীর প্রসাদ হরিয়ানার খ্যাতিমান কোচ। দঙ্গলের কুস্তিগিরদের মধ্যে তিনি ভীষণ জনপ্রিয়। তিন দশক ধরে অনেকেরই হাতে খড়ি ঘটেছে তাঁর কাছে। তিনি জানালেন দঙ্গলে শুধু টাকাই উপার্জন হয় না। ঘি, আটা, বাদামও পেয়ে থাকেন কুস্তিগিররা।

একজন কুস্তিগিরের প্রতিদিনের খাবার খরচ ৫০০ থেকে ৭০০ রুপির মতো। খাবারের মধ্যে দুধ, বাদাম, কিসমিস, ফল–ফলাদি এসব নিত্য প্রয়োজনীয় বস্তু। কিন্তু এখন কুস্তিগিরদের ‘বেঁচে থাকার খাবার জোগাড় করতে হচ্ছে’ বলে মনে করেন মহাবীর প্রসাদ, ‘এটা শুধু হরিয়ানায় নয়, দেশের অন্যান্য জায়গার কুস্তিগিরদেরও একই দশা।’

গত মার্চ থেকে ভারতের প্রায় ৭৫০জন পরিচিত–অপরিচিত দঙ্গল কুস্তিগিররা জীবন নিয়ে সংগ্রাম করছেন। এ সময় করোনার কারণে তারা সব মিলিয়ে প্রায় ৪০ কোটি রুপি আয় করা থেকে বঞ্চিত হয়েছেন। দঙ্গল ভুলে এখন তাদের নামতে হয়েছে জীবন নিয়ে সংগ্রামের রিংয়ে। একটাই আশা, সবকিছুরই শেষ আছে তাই করোনারও...।