শাহীনের উপস্থিতি আফগান মেয়েদের অনুপ্রেরণা

নিগারা শাহীনছবি: টুইটার

নিগারা শাহীন। জন্ম আফগানিস্তানে হলেও বেড়ে ওঠা পাকিস্তানে। ১৯৯৩ সালে যুদ্ধের হাত থেকে বাঁচতে তাঁর পরিবার পার্শ্ববর্তী দেশে পালায়। তখন তাঁর বয়স ছিল মাত্র ছয় মাস। দুই দিন, দুই রাত টানা হেঁটে পরিবারটি সীমান্ত পাড়ি দিতে সক্ষম হয়েছিল।

১৮ বছর পর শাহীন নিজ দেশে পড়াশোনা করার সিদ্ধান্ত নেন। ভর্তি হন কাবুলে আমেরিকান ইউনিভার্সিটি অব আফগানিস্তানে। দেশ ছাড়ার পর এই আফগানিস্তানে তাঁর পা পড়ল।

২৮ জুলাই শাহীন তাঁর অলিম্পিকে খেলার স্বপ্ন পূরণ করতে যাচ্ছেন। ২০১৬ রিও অলিম্পিক থেকে অলিম্পিকে শরণার্থী দলের দেখা মিলছে। সে দলের হয়ে এবার টোকিও অলিম্পিকের জুডোতে অংশ নেবেন শাহীন।

অলিম্পিক শরনার্থী দল
ছবি: রয়টার্স

তাঁর স্বপ্ন প্রায় ধূলিসাৎ হতে যাচ্ছিল। এই মাসের শুরুর দিকে তাঁর দলের এক কর্মকর্তার করোনাভাইরাস ধরা পড়ে। শরণার্থী দল তখন দোহায় প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। আল–জাজিরাকে শাহীন বলেন, ‘এই সময়ে মনে হচ্ছিল, আমরা হয়তো অলিম্পিকে অংশ নেওয়ার সুযোগটি হারাতে যাচ্ছি এবং শরণার্থীদের প্রতিনিধিত্ব করতে পারব না। কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমরা একটি পরিবারের মতো সবকিছু কাটিয়ে উঠেছি।’

অলিম্পিকে অংশ নেওয়ার সুযোগটা তাঁর কাছে স্বপ্নপূরণের মতো। আল–জাজিরাকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বলেছেন, ‘আমি সব সময় স্বপ্ন দেখতাম, একদিন অলিম্পিকে অংশ নেব। আর এ জন্য আমি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ ছিলাম। কিন্তু একটা সময় মনে হয়েছিল, আমি কোনো দিনও পারব না। তখন আমি মাস্টার্স ডিগ্রির জন্য রাশিয়ায়। করোনার কারণে সব জুডো ক্লাব বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু আমার মনে আছে, যেদিন শরণার্থী অলিম্পিক টিম ঘোষণা করা হলো, সেখানে আমার নাম দেখতে পেয়ে বিশ্বাস হচ্ছিল না। পুরো এক দিন লেগেছিল বিশ্বাস করতে।’

আমি ভেঙে পড়িনি। উল্টো আমার মনোবল আরও শক্ত হয়েছে। এখন মনে হয়, এগুলো না হলে হয়তো আমি যেখানে ছিলাম সেখানেই পড়ে থাকতাম।
নিগারা শাহীন

আজকের এই অবস্থানে পৌঁছানোর সফরটা মসৃণ ছিল না তাঁর। অনেক হেনস্তা ও বুলিংয়ের শিকার হতে হয়েছে তাঁকে। শাহীন বলেন, ‘পেশোয়ার (শাহীন ও তাঁর পরিবার সেখানে শরণার্থী হিসেবে বাস করে) ও কাবুলে আমাদের পরিবারের নিরাপত্তা নিয়ে খুব উদ্বিগ্ন থাকতাম। আল্লাহই জানে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে আমি কতবার হুমকি পেয়েছি। আমার নামে ফেসবুক পেজ খুলে আজেবাজে পোস্ট দেওয়া হতো।’

রাশিয়ায়ও আপন বোধ করেননি, ‘আমি সেখানে গিয়েছিলাম। ভেবেছিলাম জুডো প্রশিক্ষণে আমাকে তারা সহযোগিতা করবে, কিন্তু তেমনটা পাইনি। এগুলো আমার জন্য কঠিন ছিল। কিন্তু আমি ভেঙে পড়িনি। উল্টো আমার মনোবল আরও শক্ত হয়েছে। এখন মনে হয়, এগুলো না হলে হয়তো আমি যেখানে ছিলাম সেখানেই পড়ে থাকতাম।’

বাড়ি থেকে বা পরিবার থেকে কেমন সমর্থন ছিল জানতে চাইলে শাহীন বলেন, ‘আমি খুবই সৌভাগ্যবান যে আমার প্রতি পরিবারের অগাধ আস্থা ছিল। পরিবারের সদস্যদের সঙ্গে প্রশিক্ষণে যাওয়ার পথে বহুবার আমার ওপর হামলা হয়েছে। কিন্তু আমার মা-বাবার প্রতি কৃতজ্ঞ। কারণ, তাঁরা আমার খেলার প্রতি গভীর আগ্রহের কথা জানতেন। যা–ই হোক না কেন, তাঁরা আমার পাশে থেকে আমাকে অনুপ্রেরণা জুগিয়েছেন।’

নিগারা শাহীন
ছবি: টুইটার

পাকিস্তানে বেড়ে ওঠা কেমন ছিল জানতে চাইলে বলেন, ‘আপনি যখন একটি দেশে শরণার্থী, তখন আপনার মনে হবে সেখানকার সমাজ আপনাকে ঠিক আপন করে নিচ্ছে না। শিশুকাল থেকে পাকিস্তানে বেড়ে উঠতে গিয়ে আমাকে অনেক উদ্বেগের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে, যা আমার চারপাশের অন্য শিশুদের তুলনায় অনেক কঠিন ছিল। কিন্তু খেলাধুলা ছিল আমার জন্য নিরাপদ স্বর্গ। শুধু মানসিকভাবে নয়, এটি আমাকে সমাজের অন্যদের সঙ্গে মেশার সুযোগ করে দিয়েছে। জুডো আমার চিরকালের ভালোবাসা।’

জুডোর জগতে প্রবেশটা একটু ঘুরপথে হয়েছে শাহীনের, ‘আমি যেকোনো ধরনের মার্শাল আর্ট ক্লাবে যোগ দিতে চাইতাম। আমি কারাতে দিয়ে শুরু করি। আমরা যেখানে থাকতাম, সেখানে আর অন্য কোনো ক্লাব ছিল না। তাই আমার অন্য কোনো বিকল্প ছিল না। ইসলামাবাদে অনূর্ধ্ব-১৪ বয়সীদের খেলায় আমার কোচ জানতে চেয়েছিল, জুডোতে যেতে চাই কি না। কারণ, জুডোতে নারী খেলোয়াড় তেমন নেই। আমি রাজি হয়ে গেলাম আর কারাতের পোশাকেই জুডোতে অংশ নিলাম। খুব অল্প সময়ের মধ্যে জুডোকে আমি ভালোবাসতে শুরু করি। একপর্যায়ে কারাতে ছেড়ে জুডোতে আত্মনিবেশ করি।’

অলিম্পিকে খেলতে নামবেন নিগারা শাহীন
ছবি: টুইটার

১৮ বছর পর আবার আফগানিস্তানে। স্বদেশ প্রত্যাবর্তন শাহীনের? ‘এটি খুবই আবেগময় মুহূর্ত ছিল। পেশোয়ারে আমি যখন স্কুলে পড়ি, সেখানে প্রতিদিন জাতীয় সংগীত গাওয়া হতো। দেশটির প্রতি আমার গভীর শ্রদ্ধা আছে, কিন্তু মনের কোণে কোথায় যেন নিজের দেশের জন্য খারাপ লাগত। আফগানিস্তানে ফিরে আসা আমার জন্য কঠিন ছিল। এখানে অনেক কিছু আমার জন্য নতুন। এগুলো আত্মস্থ করতে আমার সময় লাগবে। এমনকি আমাকে এমন প্রশ্নও শুনতে হয়েছে, নিজেকে কেন আফগানি বলে পরিচয় দিই, যেখানে আমার বেড়ে ওঠা পাকিস্তানে।’

শাহীনের আশা, টোকিও অলিম্পিকে তাঁর উপস্থিতি আফগান মেয়েদের বড় উৎসাহ জোগাবে, ‘তারা যত বাধার মুখে পড়েছে, আমিও সেসবের মধ্য দিয়ে গেছি। এরপরও আমি যদি করতে পারি, তারাও পারবে। এটি কঠিন, কিন্তু কোনো কিছুই মানুষের আয়ত্তের বাইরে নয়।’ তাঁর পরামর্শ হলো, প্রথম যা করতে হবে তা হলো, কিসে আগ্রহ তা খুঁজে বের করা, যত বাধাই আসুক তাতে লেগে থাকতে হবে।

অলিম্পিক শেষ হওয়ার পর কী করবেন, এ বিষয় জানতে চাইলে শাহীন বলেন, ‘আমি এখনো এটি ভাবিনি। আমি সব সময়ই খেলার সঙ্গে যুক্ত থাকব। এখান থেকে অনেক কিছু পেয়েছি। আমি জুডো ভালোবাসি। আমার জীবনসংগ্রামে একমাত্র নিরাপদ স্বর্গ ও মানসিক শান্তির জায়গা হলো খেলা। আমি খেলার জগৎকে কিছু প্রতিদান দিতে চাই। এ জন্য আমি আমার উপযুক্ত পথ খুঁজে নেব।’