‘১৭ বছরের ছেলের কামাই খাই, আর কী চাইতে পারি’

মিরপুর সৈয়দ নজরুল ইসলাম জাতীয় সুইমিং কমপ্লেক্সে মায়ের সঙ্গে সামিউল ইসলামছবি: প্রথম আলো

বাবা চলে গেছেন...।

ছেলেটার তখনো এটা বোঝার বয়স হয়নি। বয়স যে তখন মাত্র আট মাস। সড়ক দুর্ঘটনায় পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি স্বামীকে হারিয়ে একমাত্র শিশুসন্তানকে নিয়ে জীবনের উত্তাল সাগরে নাও ভাসিয়েছেন মা সিমলা ইয়াসমিন।

শিশুসন্তানের মুখে দুমুঠো ভাত তুলে দেওয়ার জন্য চাকরি নিয়েছেন এনজিও প্রতিষ্ঠান ব্র্যাকে। আবার ছেলের বেড়ে ওঠার সময়টায় তাঁর সঙ্গে থাকতে পারছেন না বলে ছেড়েছেন সেই চাকরিও। ৮ মাস বয়সে বাবা হারানো সেই সামিউল ইসলাম এখন ১৭। বঙ্গবন্ধু জাতীয় সাঁতার, ডাইভিং ও ওয়াটার পোলো প্রতিযোগিতায় আজ রেকর্ড গড়েছেন দুঃখী মায়ের অন্ধের যষ্টি যে সামিউল।

বাংলাদেশ নৌবাহিনীর হয়ে জাতীয় সাঁতার চ্যাম্পিয়নশিপের ৫০ মিটার ব্যাকস্ট্রোকে সোনা জিতেছেন ২৭.৩৮ সেকেন্ড সময় নিয়ে। আগের রেকর্ডের চেয়ে যা দশমিক ৩৪ সেকেন্ড কম। একমাত্র ছেলের সাফল্য মিরপুর সৈয়দ নজরুল ইসলাম জাতীয় সুইমিং কমপ্লেক্সে বসেই দেখেছেন সিমলা ইয়াসমিন।

রেকর্ড বা টাইমিং ভালোমতো বোঝেনও না। শুধু বুঝেছেন, তাঁর বুকের ধন সামিউল ভালো কিছু করেছেন, যার জন্য গণমাধ্যমগুলো তাঁর ছেলের ছবি তুলছে, নিচ্ছে সাক্ষাৎকার।

২০১৬ সালে প্রতিভা অন্বেষণ কর্মসূচিতে দেশব্যাপী সেরা সাঁতারুর খোঁজে নেমেছিল সাঁতার ফেডারেশন। নিজ এলাকায় মাইকিং শুনে রাজবাড়ী জেলার সুইমিং কমপ্লেক্সে গিয়ে সেই প্রতিযোগিতায় নাম লেখান সামিউল। কোনো প্রস্তুতি ছাড়াই হয়ে যান প্রথম।

সামিউল ইসলাম
ছবি: প্রথম আলো

ব্যস, ধারাবাহিক কয়েক ধাপের পরীক্ষা শেষে ফেডারেশনের অধীনে প্রায় তিন বছর মেয়াদি অনুশীলনের সুযোগ মিলে যায়। মা-ছেলে দুজনের জন্য তা পরিণত হয় মধুর সমস্যায়। চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত হওয়া মানেই মাকে ছেড়ে সামিউলের ঢাকায় এসে থাকা। আবার অন্যভাবে ভাবলে, একমাত্র ছেলেকে ঢাকায় রেখে রাজবাড়ীতে বসে তাঁর মঙ্গল কামনা ছাড়া আর কিছুই করার নেই মায়ের।

ছেলের ভবিষ্যতের কথা ভেবে সেটাই মেনে নেন মা। মাঝেমধ্যে ঢাকায় এসে আত্মীয়স্বজনের বাসায় উঠে ছেলেকে দেখতে যেতেন। মায়ের ফেরার সময় সুইমিং কমপ্লেক্সের গেট ধরে ডুকরে কাঁদতেন সামিউল।

মা-ছেলের সেই ত্যাগ ও কষ্টগুলো আজ সফল হওয়ার পথে। বাংলাদেশ নৌবাহিনীর হয়ে দ্বিতীয়বারের মতো জাতীয় সাঁতার চ্যাম্পিয়নশিপে অংশ নিয়েই নিজেকে উজ্জ্বল করে তুলেছেন সামিউল।

গত বছরের অক্টোবরে সর্বশেষ চ্যাম্পিয়নশিপে ২৮.৩৫ সেকেন্ড সময় নেওয়া ছেলেটাই আজ নিয়েছেন ২৭.৩৮ সেকেন্ড। ৫ মাসের কঠোর পরিশ্রমের বিনিময়ে লেখা এই সাফল্য।

আজ প্রথম আলোকে সামিউল বলছিলেন, ‘এই দিনটার জন্য অনেক পরিশ্রম করেছি আমি। যাদের কাছে থেকে আমি বিভিন্ন বিষয় শিখেছি, আজ তাদের হারিয়েই প্রথম হয়েছি।’ নিজের ভবিষ্যৎ লক্ষ্যটাও জানিয়ে রাখলেন, ‘২৬.০৫ সেকেন্ড টাইমিং করে বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে সরাসরি জায়গা করে নিতে চাই।’

জাতীয় সাঁতারে হ্যান্ড টাইমিংয়ে রেকর্ড গড়ে এমন কথা এর আগেও অনেকের মুখে শোনা গেছে। তবে সামিউলকে একটু আলাদা করে রাখাই যায়। ১৭ বছর বয়সেই উচ্চতা ৫ ফুট ১১ ইঞ্চি। প্রথম দেখায় শারীরিক যোগ্যতার ভিত্তিতে একজন পরিপূর্ণ অ্যাথলেটই মনে হয় তাঁকে।

মায়ের সঙ্গে সামিউল
ছবি: প্রথম আলো

সামিউলকে নিয়ে তাই বাজি ধরতে রাজি নৌবাহিনীর কোচ ও সাবেক জাতীয় সাঁতারু রুবেল রানা, ‘ওর এত সুন্দর উচ্চতা আর এখনই যে টাইমিং। ভবিষ্যতে ওর বড় সাঁতারু না হওয়ার আমি কোনো কারণ দেখি না।’

পুলের পাশ দিয়ে হেঁটে হেঁটে অনেকের মুখে ছেলের প্রশংসা শুনছিলেন আর যেন ছেলের ভবিষ্যৎ সাফল্যের চিত্র আঁকছিলেন সিমলা ইয়াসমিন। ছেলের সাঁতার দেখার জন্য কালই ঢাকায় এসে উঠেছেন গুয়াহাটি এসএ গেমসে জোড়া সোনাজয়ী মাহফুজা আক্তারের বাসায়।

২০০৩ সালের পর এবারই প্রথমবারের মতো জাতীয় সাঁতারে অংশ নিচ্ছেন না মাহফুজা। নিজের সোনা জয়ের গল্পগুলো শুনিয়েছেন সামিউলের মাকে।
সিমলা ইয়াসমিনের ৫ ফুট ১১ ইঞ্চি উচ্চতার ছেলেটার মাথা কত উঁচুতে ঠেকবে, তা ভবিষ্যতের হাতে।

আপাতত ছেলে যা করেছেন, এ নিয়েই খুশি মা, ‘এই ১৭ বছর বয়সের ছেলের কামাই খাই আমি। ও নিজে চলে, আমাকে চালায়। ওর টাকা দিয়ে বাড়িতে ঘর দিয়েছি। এতটুকু ছেলের কাছে আমি আর কী চাইতে পারি?’