সাক্ষাৎকারে উসমান কাদির

‘কাদির নামটা নোংরা করতে চাই না’

ক্রিকেটের খোঁজখবর যাঁরা রাখেন, ‘কাদির’ নামটাকে তাঁদের নতুন করে চেনানোর প্রয়োজন নেই। পাকিস্তান ক্রিকেটের কিংবদন্তি আবদুল কাদির ২০১৯ সালের ৬ সেপ্টেম্বর পাড়ি জমান অনন্তলোকে। কিন্তু তাঁর লেগ স্পিনের সম্মোহনী সৌন্দর্যটা যেন দিয়ে গেছেন ছেলে উসমান কাদিরকে। তিনিও লেগ স্পিনার, বোলিং করেন ঠিক বাবার মতো অ্যাকশনে। কিন্তু বাবার এই পরিচয়ের কারণেই একটা সময় তাঁকে চলে যেতে হয়েছিল অস্ট্রেলিয়ায়। বিপিএলে দুর্দান্ত ঢাকার হয়ে খেলতে আসা পাকিস্তানের ক্রিকেটার উসমান কাল মিরপুরে অনুশীলনের ফাঁকে প্রথম আলোকে শুনিয়েছেন সে গল্পই—  

প্রথম আলো:

প্রথমবার বিপিএল খেলছেন। কেমন লাগছে?

উসমান কাদির: নতুন কোনো টুর্নামেন্টে খেলতে এলে একটা স্নায়ুর চাপ থাকে। প্রথম ম্যাচ জেতায় তা আর নেই। আশা করি, আমরা সবাই প্রথম জয়ের ছন্দটা ধরতে রাখতে পারব।

প্রথম আলো:

বিগ ব্যাশে খেলার অভিজ্ঞতা বলুন। সেখানে খেলার পরই তো ক্রিকেট-বিশ্বে পরিচিতি বাড়তে থাকে আপনার…

কাদির: দারুণ একটা সুযোগ ছিল আমার জন্য। আমি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলতে পারছিলাম না। তখন এমন একটা সুযোগ পাওয়া, দুটি দলের হয়ে খেলা আমার জন্য অন্য রকম এক অভিজ্ঞতা হয়ে আসে। বিগ ব্যাশ খেলার পর মানুষ আমাকে জানতে শুরু করে।

প্রথম আলো:

শুনেছি, জাস্টিন ল্যাঙ্গার আপনাকে প্রথম দেখেই দলে নিতে চেয়েছিলেন…

কাদির: ২০১৭ সালে আমি সিডনিতে ক্লাব ক্রিকেট খেলতাম। একদিন হুট করেই জাস্টিন ল্যাঙ্গারের ফোন আসে। তখন তিনি পার্থ স্করচার্সের কোচ। তিনি আমার বোলিং দেখতে চাইছিলেন। পরদিন আমি ব্রিসবেন যাই, তাঁর সঙ্গে দেখা করি। তিনি বোলিং দেখেই আমাকে বিগ ব্যাশে সুযোগ দেওয়ার আশ্বাস দেন। কিন্তু ওই মৌসুমে ম্যাচ বাকি ছিল মাত্র ২টি। আমাকে পরের মৌসুমের চুক্তির প্রস্তাব দেওয়া হয়। কিছুদিন পরেই আমার বিয়ে হয়। এর মধ্যে হঠাৎ একদিন অস্ট্রেলিয়া থেকে ফোন আসে। আমি ঘুমিয়ে ছিলাম, তাই ফোন ধরতে পারিনি। পরে জানলাম আমার বিগ ব্যাশ খেলা নিশ্চিত। খবরটা শোনার পর আমি আনন্দে বিছানায় লাফালাফি শুরু করি। আমি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলার সুযোগ পাচ্ছিলাম না। তখন এমন একটা সুযোগ পাওয়া বিরাট ব্যাপার ছিল।

বিগ ব্যাশে পার্থ স্করচার্সের হয়ে খেলার সময় জাস্টিন ল্যাঙ্গারকে কোচ হিসেবে পেয়েছিলেন উসমান কাদির
ছবি : ইনস্টাগ্রাম
প্রথম আলো:

তার আগে তো অস্ট্রেলিয়ার ক্লাব ক্রিকেটে নিয়মিত ছিলেন...

কাদির: হ্যাঁ, দারুণ অভিজ্ঞতা ছিল। স্পিনাররা সেখানে খেলতে চায় না। কারণ, উইকেটে তেমন টার্ন থাকে না। কিন্তু আমার সেখানে খেলতে খুব ভালো লাগে। বিশাল বাউন্ডারি, আপনি চাইলে লুপি লেগ স্পিনও করতে পারেন। উইকেটের জন্য বোলিং করা যায়।

‘কাদির’ নামটার সঙ্গে উত্তরাধিকারের অনুভূতি কাজ করত। এখন আমি বাবার ঐতিহ্যকে আরও সমৃদ্ধ করার সুযোগ পাচ্ছি। আমি ‘কাদির’ নামটা নোংরা করতে চাই না।
উসমান কাদির, পাকিস্তানি লেগ স্পিনার
প্রথম আলো:

অস্ট্রেলিয়ায় আপনাকে প্রথম সুযোগ দেন ড্যারেন ব্যারি। তিনি শেন ওয়ার্ন ও নাথান লায়নের ক্যারিয়ারেরও বড় ভূমিকা রেখেছিলেন...

কাদির: ব্যারি দারুণ একজন কোচ, খুব ভালো মানুষও। ২০১২ অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপে খেলা দেখে তিনি আমাকে অ্যাডিলেড ক্রিকেট ক্লাবে খেলার সুযোগ করে দেন। সেটাই আমাকে অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যায়।

প্রথম আলো:

অস্ট্রেলিয়ার হয়ে তো প্রায় খেলেই ফেলেছিলেন…

কাদির: হ্যাঁ, অনেকটাই। অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী একাদশের হয়ে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ওয়ানডে খেলেছি। ৩ উইকেট নিয়েছিলাম ২৭ রান দিয়ে। অস্ট্রেলিয়ার হয়ে খেলার খুব কাছাকাছি ছিলাম তখন। কিন্তু বাবা বললেন দেশে ফিরে দেশের জন্য খেলার চেষ্টা করতে। তিনি আমাকে বারবার পাকিস্তানের হয়ে খেলার কথা বলতেন। বাবা মারা যাওয়ার পরও তিনি যে আমাকে দেশের হয়ে খেলতে দেখতে চেয়েছিলেন, সেটা আমি মন থেকে সরাতে পারছিলাম না। কিছুদিন পরই জাতীয় দলে সুযোগ আসে।

পাকিস্তান দলে সুযোগ না পাওয়ায় অস্ট্রেলিয়ার হয়ে খেলতে চেয়েছিলেন উসমান কাদির
ইনস্টাগ্রাম
প্রথম আলো:

অস্ট্রেলিয়ার হয়ে খেলার ইচ্ছাটা কখনো গোপন করেননি। বরং নিজে থেকে আগ্রহ দেখিয়েছেন। কেন?

কাদির: আমি পাকিস্তানে সুযোগ পাচ্ছিলাম না। এ রকম সময়ে কেউ যদি আগ্রহ দেখায়, আপনি তো সুযোগটা নিতেই চাইবেন।

প্রথম আলো:

২০১৩ সালে আপনাকে ওয়েস্ট ইন্ডিজ সফরের দলে নেওয়া হয়। কিন্তু অদ্ভুত কারণে সফরে যাওয়ার আগেই বাদ দেওয়া হলো। পাকিস্তান থেকে তখনই নাকি আপনার মন উঠে গিয়েছিল?

কাদির: তখন আমার বাবা নির্বাচক ছিলেন। প্রধান নির্বাচক আমাকে দলে রেখেছিলেন। কিন্তু বাবা বললেন, আমাকে দলে নিলে তিনি দায়িত্ব থেকে সরে দাঁড়াবেন। কারণ, বাবা নির্বাচক থাকা অবস্থায় আমি জাতীয় দলে খেললে পক্ষপাতের অভিযোগ উঠবে। তিনি স্বজনপ্রীতির অভিযোগ নিতে চাচ্ছিলেন না। ওই ঘটনার পেছনের গল্প এটাই।

বাবা আবদুল কাদিরের সঙ্গে উসমান কাদির
ছবি : ইনস্টাগ্রাম
প্রথম আলো:

‘কাদির’ নামটার ভার বয়ে বেড়ানো তাহলে সহজ নয়...  

কাদির: না, তবে এখন আর সেটা নেই। আমি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলেছি। সারা বিশ্বে লিগ খেলছি। এর আগে ‘কাদির’ নামটার সঙ্গে উত্তরাধিকারের অনুভূতি কাজ করত। এখন আমি বাবার ঐতিহ্যকে আরও সমৃদ্ধ করার সুযোগ পাচ্ছি। আমি ‘কাদির’ নামটা নোংরা করতে চাই না। এটা আমি সব সময় মাথায় রাখছি। ভালো করে যাওয়ার কাজ করছি।

প্রথম আলো:

এখন কী মনে হয়, বাবার ছায়া থেকে বেরিয়ে আসতে পেরেছেন?

কাদির: আমার সবই বাবার জন্য। তিনিই আমাকে সব শিখিয়েছেন। যেখানেই খেলি না কেন, বাবার শেখানো কৌশলের সৌজন্যেই খেলি।

বাবা–ছেলের বোলিং অ্যাকশনে অনেক মিল
ছবি : ইনস্টাগ্রাম
প্রথম আলো:

জাতীয় দলে ফেরার লক্ষ্য আছে নিশ্চয়ই...

কাদির: হ্যাঁ, সে লক্ষ্য তো আছেই। যেখানেই খেলি, আমাকে উইকেট নিয়ে যেতে হবে। সেটা করতে থাকলে আবারও নিশ্চয়ই সুযোগ আসবে।

আরও পড়ুন