ধমক আর চিৎকারে পারফরম্যান্স আসে না

২০১৯ সালে বাংলাদেশ ক্রিকেট দলের কোচের দায়িত্ব নিয়েছেন রাসেল ডমিঙ্গোপ্রথম আলো ফাইল ছবি
‘আমি খুশি। কারণ, আমি বাড়ি যাচ্ছি’—দক্ষিণ আফ্রিকার এক বন্ধুর সঙ্গে ফোনে বলছিলেন রাসেল ডমিঙ্গো। এর ঘণ্টাখানেক আগেই টি-টোয়েন্টির দায়িত্ব থেকে ডমিঙ্গোকে সরিয়ে দেওয়ার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা আসে। কিন্তু সিদ্ধান্তটা যেন ডমিঙ্গোর জন্য অপ্রত্যাশিত স্বস্তিই বয়ে এনেছে। গত পরশু বিকেলে প্রথম আলোর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে সেই স্বস্তির কারণ জানিয়েছেন ডমিঙ্গো। ভাগাভাগি করেছেন তিন বছর বাংলাদেশ দলের কোচিং করানোর অভিজ্ঞতা। জানিয়েছেন ভবিষ্যৎ পরিকল্পনার কথাও—

কোচ রাসেল ডমিঙ্গোর ভবিষ্যৎ

প্রশ্ন :

গত কয়েক দিন এত কিছু হয়ে গেল। সবটাকে আপনি কীভাবে দেখছেন?

রাসেল ডমিঙ্গো: খুবই, খুবই শান্তিতে আছি। এটা কোনো বিষয়ই নয়। আমি টি-টোয়েন্টি দল নিয়ে অনেক চেষ্টা করেছি। বোর্ড ভাবছে, এখন অন্য কাউকে দায়িত্ব দিয়ে দেখতে। বোর্ড যদি মনে করে এটাই দলের জন্য ভালো, আমার কোনো সমস্যা নেই। আমার এত অহংকার নেই।

প্রশ্ন :

কিন্তু বোর্ড প্রকাশ্যে আপনার কোচিং স্টাইলের সমালোচনা করেছে…

ডমিঙ্গো: সবারই মতামত আছে। কিন্তু সেটা তাদের মতামত। এটা হতাশার যে সেটা সবাইকে বলে বেড়িয়েছে। আমাকে কিছু বলেনি। ওরা যে বলেছে, সেটা আমি পড়িওনি। মানুষ এসে আমাকে বলেছে। কিন্তু আমি টি-টোয়েন্টি দল নিয়ে যা করেছি, তাতে আমি সন্তুষ্ট। এসব নিয়ে একদমই ভাবছি না।

প্রশ্ন :

ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাবছেন?

ডমিঙ্গো: আমার মনোযোগ থাকবে ৫০ ওভারের বিশ্বকাপে। আমি বিশ্বাস করি, আমাদের সেখানে ভালো করার সম্ভাবনা আছে। টেস্ট দলটাকে ভালো জায়গায় নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করব। কিছু সিরিজ জয়ের চেষ্টা করতে হবে। আমাকে নিয়ে অনেক কথা হয়, সেটা আমি জানি। আমি কই যাচ্ছি, এই দায়িত্বে থাকছি কি না...কিন্তু এই মুহূর্তে আমি শুধু নিজের কাজটাই করে যেতে চাই। এসব নিয়ে ভাবতে চাই না।

মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে রাসেল ডমিঙ্গো
প্রথম আলো ফাইল ছবি

প্রশ্ন :

ক্রিকেটারদের জন্য এটা কি সহজ হবে? কারণ, ভিন্ন কোচ হলেও তা হয় সাধারণত সাদা বল ও লাল বলে। এখন আপনি ওয়ানডে ও টেস্টের কোচ, টি-টোয়েন্টির নন। এটা ক্রিকেটারদের জন্য বিভ্রান্তিকর হবে?

ডমিঙ্গো: আমার মনে হয়, ভবিষ্যতে সব সংস্করণেই প্রায় আলাদা কোচ, আলাদা ক্রিকেটার থাকবে। আমরা যে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে খেললাম, ওদের দলটা দেখুন। একেক সংস্করণের দল অনেকটাই আলাদা। আমাদের ছয়-সাতজন ক্রিকেটার দেখা যায় সব সংস্করণে খেলে। এখন যে-ই টি-টোয়েন্টি দলের দায়িত্ব পাবে, ক্রিকেটারদের পুলটা বড় হওয়ার পর তাকে দলটা আলাদা করতে হবে। কারণ, টি-টোয়েন্টির দক্ষতা থেকে টেস্টের দক্ষতা সম্পূর্ণ আলাদা। ওয়ানডে সেদিক থেকে অনেকটা টেস্টের মতো। আপনাকে ইনিংস গড়তে হবে। ধৈর্য ধরতে হবে, যখন বোলাররা ভালো স্পেল করে। টেস্ট ও ওয়ানডেতে একই ক্রিকেটার থাকতে পারে। কিন্তু টি-টোয়েন্টি সম্পূর্ণ আলাদা।

প্রশ্ন :

কিন্তু কোচিং স্টাফ আলাদা করার আলোচনাটা আপনার জন্য নতুনই হওয়ার কথা। কারণ, আপনি দুই দিন আগেও এসব কিছুই জানতেন না। এটাকে কীভাবে দেখেন?

ডমিঙ্গো: আমি ধাক্কা খেয়েছি বলব না। কারণ, কোচ হিসেবে আপনাকে সবকিছুর জন্য প্রস্তুত থাকতে হয়। আর দল যদি হারতে থাকে, তাহলে আপনি ভবিষ্যৎ নিয়ে নিশ্চিত করে কিছুই বলতে পারবেন না। আমি জানতাম, দল নিয়ে অনেকের অনেক প্রশ্ন আছে। সেদিক থেকে এটা আমার কাছে খুব যে অপ্রত্যাশিত মনে হচ্ছে, তা নয়।

প্রশ্ন :

এখন প্রায় সব কোচই টি-টোয়েন্টি লিগে কাজ করতে চান। কিন্তু এখানে আপনাকে টি-টোয়েন্টি থেকেই সরিয়ে দেওয়া হলো। আপনার কোচিং ক্যারিয়ারের জন্য ক্ষতি হয়ে গেল না?

ডমিঙ্গো: একদমই না। আমি অন্য কোচদের তুলনায় বেশি ম্যাচ জিতেছি বাংলাদেশের হয়ে। আমরা অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ডকে টি-টোয়েন্টি সিরিজে হারিয়েছি। ভারতে প্রথমবার টি-টোয়েন্টি জিতেছি। এরপর যেভাবে শেষ হয়েছে, সেটা তো হতাশারই। কারণ, আমি মনে করি, টি-টোয়েন্টি দলটা ভালো হওয়া থেকে খুব বেশি দূরে নেই।

প্রশ্ন :

আপনি কি আবার বাংলাদেশে ফিরবেন?

ডমিঙ্গো: এখন পর্যন্ত যে পরিকল্পনা, সে অনুযায়ী আমি এখন বাড়ি ফিরব। এরপর অক্টোবরে ‘এ’ দলের সঙ্গে দুবাই যাব। সেখানে আমাদের কিছু টেস্ট ব্যাটসম্যান থাকবে। তাদের নিয়ে কয়েক সপ্তাহ কাটাব। এরপর নভেম্বরে ভারত সিরিজের আগে ফিরব।

টি-টোয়েন্টি অভিজ্ঞতা এবং কেন পারেননি

টি–টোয়েন্টিতে সাম্প্রতিক কালে শুধু হতাশাই সঙ্গী বাংলাদেশের
প্রথম আলো ফাইল ছবি

প্রশ্ন :

এখন যেহেতু বাংলাদেশে আপনার টি-টোয়েন্টি অধ্যায় শেষ, আপনার নিজের কাজের মূল্যায়ন করতে বললে কী বলবেন?

ডমিঙ্গো: আমি মনে করি, আমরা ভালো টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটই খেলছিলাম। এরপর ২০২১ বিশ্বকাপ আসে, যেখানে ক্রিকেটাররা বাইরের চাপের সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারেনি। মূল পর্বে অবশ্যই আমাদের ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও শ্রীলঙ্কাকে হারানো উচিত ছিল। এরপর অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ইংল্যান্ড আমাদের বিপক্ষে দাপটে জিতেছে, তিনটিই কিন্তু বিশ্বের অন্যতম সেরা দল। এরপর আর দলের মধ্যে সাহস বলতে কিছু ছিল না। দেশে ফিরে এসেই পাকিস্তানের বিপক্ষে হার। তখন থেকেই সব পাল্টে গেল। নির্বাচকেরা দল বদলে ফেলল। নতুন অনেকে এল। ক্রিকেটাররা বিশ্রামে গেল। কোনো ধারবাহিকতা ছিল না। এরপর সব নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেল।

প্রশ্ন :

বাইরের চাপ দিয়ে কী বোঝাচ্ছেন?

ডমিঙ্গো: আমরা বিশ্বকাপের মূল পর্বে দুটি ম্যাচ হারলাম। সাকিব, সাইফউদ্দিন চোটে পড়ল। ওই সময় দলের মধ্যে অনেক টেনশন কাজ করছিল। ক্রিকেটাররা যখন নিজেদের মতো চিন্তা করতে পারে না, তখন এটা হয়। কোচিং, লিডারশিপ থেকে এটা আসে। গত ৮ থেকে ১০ বছরে এই দলের ক্রিকেটাররা সে ধরনের কোচিং পায়নি। ক্রিকেটাররা নিজেদের মতো করে ভাবতে পারে না। কারণ, বোর্ড তাদের কথা শোনায়, ডিরেক্টর অব ক্রিকেট কথা শোনায়, সবাই শোনায়। যদি ক্রিকেটারদের প্রতি পদে পদে বলে দেওয়া হয় কীভাবে কী করতে হবে, তাহলে ওরা শিখবে কীভাবে? ক্রিকেটাররা নিজেরা ভাবতে পারে না। কারণ, সব সময় তাদের বলে দেওয়া হয় কী করতে হবে। এটাই বাংলাদেশ ক্রিকেটের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ। ক্রিকেটাররা তাদের মতো কিছু ভাবতে পারে না, করতে পারে না।

বাংলাদেশ দলের অনুশীলনে রাসেল ডমিঙ্গো
প্রথম আলো ফাইল ছবি

প্রশ্ন :

আপনি ক্রিকেটারদের স্বাধীনতা দিতে চেয়েছিলেন?

ডমিঙ্গো: একদমই তাদের মতো করে ছেড়ে দিতে চাইনি। তবে চিৎকার-চেঁচামেচি করে খুব একটা লাভ হয় না। যখন ওরা ভুল করে, তখন বাজেভাবে সমালোচনা করলে ক্রিকেটারদের সেরাটা পাওয়া যাবে না। আমি এটাই করতে চাইনি। ক্রিকেটাররা ভুল করবে, তাদের সেটা থেকে শিখতে হবে। সে জন্য নিজের মতো করে সিদ্ধান্ত নিতে দিতে হবে। কিন্তু তারা সেটা করতে পারে না। কারণ, তাদের সারাক্ষণ পরামর্শের ওপর রাখা হয়, ধমক দেওয়া হয়। এটা যে একদিক থেকে আসে, তা নয়। চারদিক থেকেই আসে। যে কারণে নিজেদের ক্রিকেটীয় জ্ঞান বাড়ে না। নিজেরা চিন্তা করতে পারে না। ছেলেরা এতে এতই অভ্যস্ত হয়ে গেছে যে সব সময় এখন পরমুখাপেক্ষী হয়ে থাকে।

প্রশ্ন :

প্রধান কোচ হিসেবে এসব থেকে ক্রিকেটারদের দূরে রাখার দায়িত্ব তো আপনার…

ডমিঙ্গো: আপনি ক্রিকেটারদের জিজ্ঞেস করতে পারেন, আমি ড্রেসিংরুমে শান্ত একটা পরিবেশ বজায় রাখার চেষ্টা করেছি। চেয়েছি পরিষ্কার চিন্তাভাবনার ক্রিকেটার তৈরি করতে। কিন্তু দলের আশপাশে এত লোকজনের কথা শোনা যায়, সেটা আমার পক্ষে আর সামলানো সম্ভব ছিল না।

আমাকে সব সময় বলা হতো, ওদের সারাক্ষণ ধমকাতে হবে। কঠোর হতে হবে। এভাবেই নাকি ক্রিকেটারদের সঙ্গে সব সময় আচরণ করা উচিত। আমি নিশ্চিত, আমার আগেও অনেক কোচ একই কাজ করেছে। কিন্তু আগের কোচরাও টি-টোয়েন্টিতে কিছু করতে পারেনি।
রাসেল ডমিঙ্গো

প্রশ্ন :

সে জন্যই কি টি-টোয়েন্টি থেকে বাদ পড়াটা আপনার জন্য অনেকটা স্বস্তির, হতাশার নয়? আপনাকে দেখে মনে হচ্ছে, আপনি ঝামেলা থেকে বাঁচতে পেরে খুব খুশি।

ডমিঙ্গো: হ্যাঁ, ঠিক তা–ই। আমার এখানে আর কিছুই করার নেই। আমাকে সব সময় বলা হতো, ওদের সারাক্ষণ ধমকাতে হবে। কঠোর হতে হবে। এভাবেই নাকি ক্রিকেটারদের সঙ্গে সব সময় আচরণ করা উচিত। আমি নিশ্চিত, আমার আগেও অনেক কোচ একই কাজ করেছে। কিন্তু আগের কোচরাও টি-টোয়েন্টিতে কিছু করতে পারেনি। বরং আমার রেকর্ড আগের তুলনায় ভালোই হওয়ার কথা। কারণ, বাংলাদেশ বিশ্বকাপে ম্যাচ জিতেছে মাত্র একটি। আমি একটা বিশ্বকাপে গিয়েছি এই দলের সঙ্গে। এর আগে তো অনেক কোচ দলটাকে নিয়ে বিশ্বকাপে গিয়েছে। কই, কিছুই তো হয়নি। আমি চেয়েছি ভিন্ন পথে এগোতে।

প্রশ্ন :

দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথম সংবাদ সম্মেলনে আপনাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, বাইরের হস্তক্ষেপ সামলে কীভাবে কোচিং করবেন? আপনি বলেছিলেন, আমি দক্ষিণ আফ্রিকা থেকে এসেছি। এসবে আমি অভ্যস্ত। তিন বছর পর এখন কী বলবেন?

ডমিঙ্গো: এই দলটা একদম অরক্ষিত। সবাই মন্তব্য করতে থাকে, সেটা দল পর্যন্ত পৌঁছেও যায়। দক্ষিণ আফ্রিকায় আমি সাত বছর কাজ করেছি। সেখানে একজন কোচ, স্টাফ, নির্বাচক...এইটুকুই। বাইরের কিছুই দলে ঢোকে না। এখানে সে রকম না। দক্ষিণ আফ্রিকার হস্তক্ষেপ রাজনৈতিক। এখানে সম্পূর্ণ ভিন্ন।

বাংলাদেশ দলের সিনিয়র ক্রিকেটারদের সঙ্গে তাঁর কথিত দ্বন্দ্ব নিয়ে রাসেল ডমিঙ্গোর সাক্ষাৎকারের দ্বিতীয় পর্ব পড়ুন আগামীকাল।
আরও পড়ুন
আরও পড়ুন