সিনিয়রদের ওপর দোষ চাপিয়ে দেওয়া মানতে পারছেন না সাবিনা

বাংলাদেশের ফুটবলে গত কয়েক বছরে যা কিছু সাফল্য, সবই বলতে গেলে মেয়েদের হাত ধরে। সেই নারী ফুটবলের সংসারে এখন অশান্তির আগুন। ব্রিটিশ কোচ পিটার বাটলার থাকলে গণ–অবসরের ঘোষণা দিয়েছেন বাংলাদেশ নারী ফুটবল দলের ১৮ খেলোয়াড়। যাঁদের বেশির ভাগই দুবারের সাফজয়ী। পরশু সন্ধ্যায় বাফুফে ভবনে মেয়েরা সংবাদ সম্মেলন ডেকে নিজেদের এই অবস্থানের কথা জানান। কিন্তু কেন এই চরম অবস্থান? দুবারের সাফজয়ী অধিনায়ক সাবিনা খাতুন সেসব নিয়েই কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে।

প্রথম আলো:

সংবাদ সম্মেলনে তো যা বলার বলেছেনই। সর্বশেষ পরিস্থিতি কী?

সাবিনা খাতুন: আমরা নিজেদের অবস্থান পরিষ্কার করেছি। এটা আমাদের তৃপ্তির জায়গা। আমার তো ভালো অনুভূতি হচ্ছে।

প্রথম আলো:

আপনাদের কঠোর অবস্থানের পর বাফুফে কিছু বলেছে?

সাবিনা: এখনো কিছু বলেনি।

প্রথম আলো:

কোচের বিরুদ্ধে এভাবে নিজেদের অবস্থান জানানোর সিদ্ধান্তটা কখন নিলেন?

সাবিনা: এটা অনেক দিনের ক্ষোভের বিস্ফোরণ। আমরা চেষ্টা করেছি ঘরের মধ্যে সমস্যা সমাধানের। কিন্তু তা হয়নি। এ কারণে মিডিয়ার সামনে সব বলতে হলো। এই জায়গায় আসতে আমাদের বাধ্য করা হয়েছে।

প্রথম আলো:

শুরুটা কোথা থেকে?

সাবিনা: পিটার বাটলার দায়িত্ব নেওয়ার পর (গত জুনে) ঢাকায় চায়নিজ তাইপের বিপক্ষে ম্যাচ থেকেই। তারপর ধাপে ধাপে সাফেও। আমরা চার–পাঁচবার ফেডারেশনকে এসব জানাই। কর্মকর্তারা বলেছিলেন, সাফের সময় কোচকে সরালে লোকে তোমাদের গালাগাল দেবে। আমাদের বলা হয়েছিল, কোচ যে যে কাজগুলো করেন, সেটা আর করবেন না। কিন্তু কিছুই বদলায়নি।

প্রথম আলো:

কিন্তু ফুটবলে তো কোচই সর্বেসর্বা। দিন শেষে তো তিনি সাফজয়ী কোচ, যেমন আপনারা সাফজয়ী খেলোয়াড়। আপনাদের এত অসন্তোষ কেন তাঁকে নিয়ে?

সাবিনা: কোচ নিজ দর্শনে খেলাবেন স্বাভাবিক। কিন্তু তাঁর দেখা উচিত টিমটার শক্তি আর দুর্বলতা কী। খেলোয়াড়দের সঙ্গে পরামর্শ করা উচিত তারা কোনটাতে স্বচ্ছন্দ। বিগত দিনে সব কোচই আমাদের সঙ্গে আলোচনা করতেন। অথচ সাফে যাওয়ার আগে বাটলার বলেছেন, ‘সাফে আমার কোনো প্ল্যানিং নেই। কন্ট্রাক্ট শেষ হলে আমি দেশে চলে যাব।’ কিন্তু আমাদের তো দেশের জন্য ফিলিংস আছে।

৩০ জানুয়ারি সংবাদ সম্মেলন করে কোচ পিটার বাটলারের বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তোলেন ফুটবলাররা
প্রথম আলো
প্রথম আলো:

কোচ কী এমন করেছেন যে আপনারা এমন চরম অবস্থানে চলে গেলেন...

সাবিনা: অনেক কিছু। ভাবুন, একটা টিমের কোচকে খেলোয়াড়দের কনভিন্স করতে হচ্ছে...এই টিমটা নামান। এই টিমটা বেটার করবে।

প্রথম আলো:

কোচ তাঁর কাজ করবেন, আপনারা দেশের জন্য খেলবেন। সেটাই হলে এত দ্বন্দ্ব কেন?

সাবিনা: তাঁর দল নির্বাচন নিয়ে সমস্যা। গত সাফে পাকিস্তানের সঙ্গে নিজের মতো দল নামান। আমরা পাকিস্তানের সঙ্গে হারতে হারতে ড্র করি। অন্য দলগুলো বলেছে, তোমাদের টিমের অবস্থা এমন কেন? তোমাদের টিম বন্ডিং বা টিম স্পিরিট কই? উনি ওনার মতো দল গড়েন। প্লেয়ারদের মতামত কখনো নেন না।

প্রথম আলো:

খেলোয়াড়দের মতামত নেওয়া কি জরুরি?

সাবিনা: জরুরি নয়। চাইলে নিতে পারেন, না–ও নিতে পারেন।

প্রথম আলো:

বাফুফের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, কোচ নিয়োগ দেবে বাফুফে। আপনারা আপত্তি তোলার কে?

সাবিনা: এত বিতর্ক যখন হয়ে গেছে এবং আমরা বিভিন্ন সময় বিষয়টা জানিয়েছি কর্তৃপক্ষকে, তখন অন্তত আমাদের সঙ্গে কথা বলতে পারত। যেহেতু আমরা দুবার সাফ ট্রফি নিয়ে এসেছি, আমরা কি এতটুকু ডিজার্ভ করি না? আমরা সাফের পর এসেও এসব কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছি। কোচ এবার দুই বছরের চুক্তিতে আসার আগেই পরিকল্পনা করেন, ক্যাম্পে সাত-আটজনকে ডাকবেন না। তাঁদের নাকি পারফরম্যান্স নেই।

প্রথম আলো:

কে কে?

সাবিনা: নাম বলব না। সেটা ওনার মাথায় ভালো আছে।  

প্রথম আলো :

কিন্তু কয়েকজনের তো আসলেই আগের মতো ভালো পারফরম্যান্স নেই। আপনারা নিজেদের স্বার্থে কোচের বিরুদ্ধে লেগেছেন, এমন অভিযোগও আছে।

সাবিনা: স্বার্থটা কিসের?

প্রথম আলো:

আপনাদের মধ্যে যাঁদের পারফরম্যান্স খারাপ, তাঁরাও দলে টিকে থাকতে চান।

সাবিনা: উনি যখন আমাকে চায়নিজ তাইপের বিরুদ্ধে দ্বিতীয় ম্যাচে খেলাননি, এটা নিয়ে কোনো কথা তো হয়নি। আমি কোনো স্টেটমেন্ট দিইনি। তখন মাসুরাকেও বসিয়েছে, সে–ও কিছু বলেনি। কিন্তু টিম জেতেনি। আমরা কোনো অভিযোগও করিনি। কোচ তখন বলেছেন, জুনিয়র কাউকে খেলাবেন। আমি বলি ঠিক আছে, খেলাও।

পিটার বাটলারকে নিয়ে যত আপত্তি নারী ফুটবলারদের।
বাফুফে
প্রথম আলো:

অনেকে বলেন, আপনি এসব করাচ্ছেন...।

সাবিনা: মেয়েরা মেয়েদের জায়গা থেকে লড়াই করছে। আমি দীর্ঘদিন দলকে নেতৃত্ব দিচ্ছি, নেতা হিসেবে আমি ওদের পাশে আছি, পাশে থাকব। এটা আমার দায়িত্ব। কিন্তু এত বছর ফুটবল খেলে যদি ক্যামেরার সামনে কাঁদতে হয়, এটা দুঃখজনক।

প্রথম আলো:

আপনি নিজের কোনো ভুল দেখেন?

সাবিনা: আমার কোনো ভুল আছে বলে মনে হয় না। মেয়েদের সাপোর্ট দেওয়া যদি ভুল হয়ে থাকে, এই ভুলটাকে আমি ভুল মনে করছি না।

প্রথম আলো :

সিনিয়রদের নিয়ে দলে গ্রুপিং করার অভিযোগ সম্পর্কে কী বলবেন?

সাবিনা: বাজে কথা। সমস্যা হচ্ছে কোচকে নিয়ে। বলা হয় টিমে সিনিয়র-জুনিয়র দ্বন্দ্ব, আপনি (কোচ) খাবার টেবিলে গিয়ে বলছেন গুড মর্নিং সিনিয়র, গুড মর্নিং জুনিয়র। সমস্যা তো এখান থেকে শুরু হয়। সেই দোষ আপনি সিনিয়রদের ওপর চাপিয়ে দেবেন, এটা হতে পারে না।

প্রথম আলো:

আপনাদের অনেক অভিযোগের একটা বডি শেমিং। তা কারও ওজন বেড়ে গেলে কোচ তাঁকে বলবেন না ওজন কমাতে?

সাবিনা: সবই বলতে পারেন। কিন্তু সবকিছুর একটা পদ্ধতি আছে। চায়নিজ তাইপের ম্যাচে উনি মারিয়াকে বাদ দিয়ে দেন। মারিয়া কেমন খেলোয়াড়, আপনারা জানেন। উনি মারিয়াকে বলতে পারতেন, আগে ফিট হও। আপনি তাকে মোটিভেটেড না করে যখন ডিমোটিভেটেড করেন, ওই খেলোয়াড়টা টিকে থাকবে কীভাবে?

প্রথম আলো:

কোচ যদি কাউকে বাদ দেন, সেটিকে আপনারা কীভাবে খারাপ বলবেন?

সাবিনা: যখন দেখি দলে খারাপ হচ্ছে, তখন বলতেই হয়। আমি বলতে চাইছি, কোচের দলকে মোটিভেট করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। আপনি পুরো দলের সামনে কাউকে বলতে পারেন না ‘ইউ আর নট সেলিব্রিটি’, আপনি এভাবে খোঁচা মারতে পারেন না।

গত অক্টোবরে নেপালে টানা দ্বিতীয় সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জেতে বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দল
বাফুফে
প্রথম আলো:

তাহলে কি বলতে চাইছেন তাঁর আচরণত সমস্যা?

সাবিনা: অবশ্যই।

প্রথম আলো:

কিন্তু কোচ যদি বলেন খেলোয়াড়ের মনোযোগ নেই, ম্যাচের আগে ভিডিও করেন। টিকটিকে ব্যস্ত। ভুলটা কোথায়?

সাবিনা: এগুলোই যদি হয়, তাহলে রেজাল্ট আসে কীভাবে? মেয়েদের কি ব্যক্তিগত জীবন নেই?

প্রথম আলো:

কোচ নিয়োগের আগে বাফুফেকে আপনারা কি বলেছিলেন তাঁকে না নিতে?

সাবিনা: আমরা বলিনি তাঁকে নিয়োগ দেওয়া যাবে না। আমরা বলেছি, উনি আগে যেভাবে কাজ করেছেন ছেলেদের সঙ্গে, সেখানে বা অন্যখানে দিতে। আমরা ওনার সঙ্গে স্বচ্ছন্দ নই। সমস্যার কথা জানানোর পর সর্বশেষ দু–তিনবার বলা হয়েছে, সে আর এ রকম করবে না। অথচ দেখুন, এবার এসে বাফুফেতে ঢুকেই একজন খেলোয়াড়কে টিটকারি মেরেছেন। বাফুফে মিডিয়া ম্যানেজারকে দেখিয়ে বলেছেন, এই হচ্ছে তোমাদের নতুন কোচ।

প্রথম আলো:

এটা হয়তো মজা করেছেন।

সাবিনা: এটা মজা হতে পারে না। এটা সিরিয়াস বিষয়, যখন সবাই বলছে তাঁর সঙ্গে ট্রেনিং করবে না, তখন তিনি ওভাবে কথা বলতে পারেন না।

প্রথম আলো:

অবস্থা যা, দুই পক্ষের মুখোমুখি সংঘর্ষের মতো। আপনাদের কি কোনো দায় নেই?

সাবিনা: আমার আসলে কোনো অনুতাপ নেই। মনে হয় না আমরা কোনো ভুল করেছি। এত কিছুর পর মনে হয় না উনিও চাইবেন আমাদের সঙ্গে কাজ করতে।

প্রথম আলো:

কোচ এবার আসার পর টিম মিটিংয়ে যাননি কেন?

সাবিনা: তাঁর উচিত ছিল সাফের পরই আমাদের সঙ্গে বসা। কিন্তু সেটার প্রয়োজনবোধ করেননি উনি। উল্টো চেয়েছেন এখান থেকে প্লেয়ার বাদ দিতে।

প্রথম আলো:

সাফের পর থেকে নতুন চুক্তি হয়নি আপনাদের। বেতনও বাকি আছে। সেই ক্ষোভও কি আছে?

সাবিনা: তিন মাস ধরে যখন বেতন নেই, তখন তো কারও মাথাব্যথা ছিল না, মেয়েগুলো কেমন আছে। সবাই শুধু খোঁজে যে টাকা পেয়েছ, কী করেছ। এমন ভাব যে মেয়েরা কোটি টাকা পেয়ে গেছে।

প্রথম আলো:

আপনি দেশের ফুটবলের আইকন। একটু কি বিব্রত?

সাবিনা: না। বরং আমি খুশি যে মেয়েরা যা করছে, আমি ওদের সঙ্গে আছি এবং থাকব।

প্রথম আলো:

সমস্যার শেষ কোথায়?

সাবিনা: সমাধান বাফুফে সভাপতি দেবেন। ওনাকে বাদ দিয়ে অন্য যেকোনো কোচকে আমরা মেনে নেব।

প্রথম আলো:

মেয়েদের সব অর্জনে একটু হলেও কি কালি পড়ল?

সাবিনা: পড়েছে তো অবশ্যই।