অনূর্ধ্ব-২১ জুনিয়র হকি বিশ্বকাপে ২৪ দলের মধ্যে বাংলাদেশের ১৭তম স্থান অর্জনকে কীভাবে মূল্যায়ন করবেন?
সিগফ্রিড আইকমান: বাংলাদেশের এই অবস্থান শুধুই সম্ভাবনার প্রতিফলন নয়, এটি আরও বড় কিছু শুরু হওয়ার সূচনাও হতে পারে, যদি পরবর্তী পদক্ষেপগুলো সঠিকভাবে নেওয়া হয়।
আপনি বললেন ‘সঠিক পদক্ষেপ নেওয়া’ দরকার। সেই পদক্ষেপগুলো কি একটু বিস্তারিত বলবেন?
আইকম্যান: এই দলের বিশাল সম্ভাবনা আছে, যদি খেলোয়াড়দের সঠিকভাবে পরিচর্যা করা হয়। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, ছেলেরা যেন নিয়মিত প্রতিযোগিতা ও অনুশীলন চালিয়ে যেতে পারে। ঘরোয়া লিগ এবং ফ্র্যাঞ্চাইজি লিগে অংশগ্রহণ অপরিহার্য, যাতে তারা শীর্ষস্থানীয় বিদেশি খেলোয়াড়দের সঙ্গে খেলতে পারে এবং শেখার সুযোগ পায়।
বাংলাদেশে তো ঘরোয়া হকি বলতে কিছুই নেই। দেশে দেড় বছর ধরে শীর্ষ লিগ হয় না, নিচের দিকের লিগগুলো হিমাগারে। কোনো জাতীয় বা যুব চ্যাম্পিয়নশিপ নেই। এই পরিস্থিতিতে বিশ্বকাপের সাফল্য হারিয়ে যেতে পারে মনে করছেন অনেকেই। আপনি কী ভাবছেন?
আইকম্যান: এটি হতাশাজনক হবে। আমি বাংলাদেশ হকি ফেডারেশনকে বলব, খেলোয়াড়দের নিয়মিত খেলার সুযোগ দিন এবং তাদের পেছনে বিনিয়োগ করুন, যাতে তারা আপনাদের গর্বিত করতে পারে। সমর্থকদের বলব, এই তরুণ খেলোয়াড়দের সম্ভাবনাকে সমর্থন করুন।
গ্রুপ আরও ভালো খেললে সেরা ১৬-এর মধ্যে থাকতে পারত বাংলাদেশ। এতে কি আফসোস হয়?
আইকম্যান: কিছুটা তো হয়ই। তবে আমরা দেখিয়েছি বিশ্বের সেরা দেশগুলোর সঙ্গে প্রতিযোগিতা করতে পারি। গ্রুপে অস্ট্রেলিয়ার কাছে ৫-৩ হার, দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে ৩-৩ ড্র এবং ফ্রান্সের কাছে ৩-২ হেরেছি। প্রতিটি ম্যাচই যথেষ্ট প্রতিযোগিতামূলক ছিল। তিনটি ম্যাচই জেতার সুযোগ ছিল, কিন্তু অভিজ্ঞতার অভাবে কিছু ভুল করে ধাক্কা খেয়েছি।
স্থান নির্ধারণী পর্বে তিন ম্যাচেই জয়। এতটা আশা করেছিলেন?
আইকম্যান: স্থান নির্ধারণী পর্বে আমরা ওমানকে ১৩-০, কোরিয়াকে ৫-৪ এবং অস্ট্রিয়াকে ৫-৩ গোলে হারিয়েছি। বড় জয় আমাদের শক্তি দেখায়। আমরা প্রতিটি ম্যাচে উন্নতি করেছি, যদিও প্রতিপক্ষ দলগুলো ভিডিও বিশ্লেষণ করে আমাদের শক্তি ও দুর্বলতা বের করে ফেলেছে।
বিশ্বকাপ মাতানো আমিরুল ইসলামের পারফরম্যান্স কেমন আপনার চোখে?
আইকম্যান: আমিরুল অসাধারণ। ছয় ম্যাচে পাঁচটি হ্যাটট্রিক, চার ম্যাচে সেরা খেলোয়াড় এবং সর্বোচ্চ গোলদাতার দৌড়েও এগিয়ে। আমরা ওর ফ্লিকিং স্কিলের ওপর কাজ করেছি। প্রতিপক্ষের পেনাল্টি কর্নার আটকানোর ছক, রক্ষণ আর সামগ্রিক কৌশল সব বিশ্লেষণই ওর কাছে পৌঁছে দিয়েছি। সে জানত সুযোগগুলো কোথায়, শুধু সেগুলো যথাযথভাবে বাস্তবায়ন করতে হয়েছিল। সে অসাধারণভাবে তা করেছে।
আমিরুলের খেলার বিশেষ গুণাবলী কী?
আইকম্যান: সে খুবই শান্ত স্বভাবের। তার ড্র্যাগ ফ্লিক শক্তিশালী, ফিনিশিংয়ের সময় সাবলীল থাকে। কব্জি দক্ষভাবে ব্যবহার করে বলের গতি প্রায় ৩০ শতাংশ বাড়ায়। পেনাল্টি কর্নার (পিসি) দারুণ নেয়, রক্ষণের মার্কিং ও ট্যাকলিংও ভালো। তবে উন্নতির সুযোগ আছে। শারীরিক সক্ষমতা বাড়ানো, ড্র্যাগ আরও দ্রুত নেওয়া, কব্জির ব্যবহার আরও শক্তিশালী করতে হবে ওকে। ম্যাচের শেষ দিকে ক্লান্তিতে সে কিছু ভুল করেছে।
আমিরুলের ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা কেমন?
আইকম্যান: আমিরুল অবশ্যই এশিয়ার এবং বিশ্বের সেরা ড্র্যাগ ফ্লিকারদের একজন হতে পারে। সে শৃঙ্খলাবদ্ধ, কঠোর পরিশ্রমী এবং অনুশীলনে অন্যদের আগে আসে। যদি নিয়মিত অনুশীলন এবং প্রতিযোগিতায় অংশ নিতে পারে, তাহলে ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল।
বিশ্বকাপে বাংলাদেশের কৌশলগত পারফরম্যান্সে আপনি পুরোপুরি খুশি?
আইকম্যান: না। কিছু কৌশলগত ভুল হয়েছে। যেমন অস্ট্রেলিয়া ম্যাচে রক্ষণ সংগঠন ঠিক রাখতে পারিনি আমরা। বলের দিকে অতিরিক্ত ছুটেছি, কখন প্রেস করতে হবে আর কখন পিছিয়ে আসতে হবে তা নিয়ে দ্বিধায় ছিলাম।
গত জুনিয়র বিশ্বকাপের রানার্সআপ ফ্রান্সের বিপক্ষে ম্যাচটি আমরা জিততেও পারতাম। সেটি জিতলে আমরা আরও ওপরের দিকে থাকতে পারতাম, এমনকি সেরা ১২-তেও। তা হয়নি বলে খেলোয়াড়দের মনকষ্ট আমাকে স্পর্শ করেছে। খেলোয়াড়দের দোষ দেওয়া যায় না, কারণ তারা এত ভালো দলের সঙ্গে খেলতে অভ্যস্ত ছিল না। আসলে এই বিশ্বকাপটা ছিল আমাদের শেখার ও অভিজ্ঞতা অর্জনের। দুটোই হয়েছে।
বাংলাদেশের হকির ভবিষ্যত কেমন দেখছেন?
আইকম্যান: বাংলাদেশ যদি এই খেলোয়াড়দের পেছনে নিয়মিত বিনিয়োগ চালিয়ে যায়, তাহলে ভবিষ্যৎ উজ্জ্বল। রকি এবং আমিরুলের মতো খেলোয়াড় খুবই বিশেষ, আর মুন্না ও হুজাইফার মতো তরুণরাও উন্নতি করছে। সামিন, সাজু ও আমানের মতো খেলোয়াড়রা যদি শেখে, তাহলে ভালো ফলই আসবে। এই প্রতিভাগুলোকে বিকশিত করতে হবে।
আপনার সঙ্গে বাংলাদেশ হকি ফেডারেশনের চুক্তি সাড়ে তিন মাসের, বিশ্বকাপ পর্যন্তই। এরপর কী?
আইকম্যান: জানি না। বিশ্বকাপ শেষে ঢাকা হয়ে গন্তব্য হল্যান্ড। আরস্টারডামে আমার মা মারা যান ঢাকায় পাকিস্তানের সঙ্গে সিরিজ খেলার আগের দিন। মায়ের অন্তেষ্টিক্রিয়া শেষে চেন্নাই আসি। বিশ্বকাপ শেষে পরিবার আমায় ডাকছে এখন।