বাংলাদেশ দলে ‘লো রিস্ক, হাই বেনিফিট’ খুঁজছেন সাকিব

আবারও আলোচনায় সাকিব আল হাসান। জাতীয় দলের হয়ে নাকি বিদেশের মাটিতে খেলতে পারেন রাজনৈতিক কারণে বাংলাদেশের ক্রিকেটে ব্রাত্য হয়ে পড়া এই অলরাউন্ডার। স্বয়ং বিসিবি সভাপতি আমিনুল ইসলাম বলেছেন, সাকিবের সঙ্গে তিনি কথা বলবেন। কিন্তু এ নিয়ে সাকিব কী বলছেন? তিনি কি প্রস্তুত আবার জাতীয় দলে ফিরতে? এসব প্রসঙ্গ এড়িয়ে যেতে চাইলেও গায়ানা থেকে মুঠোফোনে তারেক মাহমুদকে দেওয়া তাঁর সাক্ষাৎকারে স্পষ্ট—বাংলাদেশ দল নিয়ে পরিকল্পনার জাল বোনা চলছে সাকিবের ক্ষুরধার ক্রিকেট মস্তিষ্কে।

প্রশ্ন:

গ্লোবাল টি–টোয়েন্টি খেলতে গায়ানায় আছেন। প্রথম ম্যাচটা তো দারুণ খেললেন, পরের দুই ম্যাচ যদিও ভালো যায়নি। সব মিলিয়ে কেমন লাগছে?

সাকিব: ভালোই লাগছে। পরের ম্যাচগুলো ভালো হলে আরও ভালো লাগত। গায়ানা সুন্দর দেশ। যে দেশে আমাজনের মতো জঙ্গল আছে, সেই দেশ তো সুন্দর হবেই। হ্যাঁ, যদি আপনি সমুদ্র দেখতে ভালোবাসেন, সেটা ভিন্ন কথা। যেখানে খেলা হচ্ছে, সেখানে বিচ নেই।

প্রশ্ন:

বাংলাদেশ–শ্রীলঙ্কা সিরিজের ম্যাচগুলো কি দেখছেন?

সাকিব: এখানে (গায়ানা) এই সিরিজের খেলা সরাসরি দেখা যায় না। হাইলাইটস দেখি, স্কোর দেখে খেলা ফলো করার চেষ্টা করি। খোঁজখবর রাখি।

গায়ানায় গ্লোবাল সুপার লিগে দুবাই ক্যাপিটালসের হয়ে খেলছেন সাকিব
ছবি: জিএসএল
আরও পড়ুন
প্রশ্ন:

বাংলাদেশ দলে আপনাদের মতো অভিজ্ঞ ক্রিকেটারদের অনুপস্থিতিতে একটা সংকট মনে হয় তৈরি হয়েছে দলে। আপনি কী মনে করেন?

সাকিব: অভিজ্ঞতার সংকট কেন হবে! দলে অনেক খেলোয়াড় আছে ৮–৯–১০ বছর খেলছে। ওরা এত দিন অন্যের ছায়ায় ছিল, যে কারণে ওদের সামর্থ্যটা বিকশিত হতে পারেনি। এখন ছায়ার বাইরে এসে হঠাৎ করে বুঝতে পারছে না কী করতে হবে। তবে তারা এটা বুঝে ফেলবে। খেলতে খেলতে, বিভিন্ন পরিস্থিতিতে পড়তে পড়তেই বুঝতে পারবে কী করতে হবে। এত খারাপ সিরিজেও তো একটা ওয়ানডে জিতেছে, একটা টেস্ট ড্র করেছে, টি–টোয়েন্টি একটা জিতেছে। আমার বিশ্বাস, এক বছরের মধ্যে এই দলটাই অনেক ভালো দল হবে।

প্রশ্ন:

আপনাদের সঙ্গে খেলার সময়ই কেন এই ক্রিকেটাররা দায়িত্ব নেওয়ার মতো প্রস্তুত হলেন না? যথেষ্ট সময় তো পেয়েছেন তাঁরা…

সাকিব: যারা জাতীয় দলে খেলে, তারা সবাই এই পর্যায়ে খেলার জন্য প্রস্তুত। এখন তারা কিছু নির্দিষ্ট দায়িত্ব পালন করছে, যেগুলো আগে পালন করেনি। স্বাভাবিকভাবেই শুরুতে সব বুঝবে না। তবে দায়িত্ব যখন নিয়েছে, কয়েক দিনের মধ্যে বুঝে যাবে। আগে এক ভূমিকা পালন করতে হয়েছে, তখন সেটা বুঝেছে। এখন আরেক ভূমিকায় এসেছে, এখন এটাও বুঝবে। ট্রানজিশন পিরিয়ডে যেটুকু সময় লাগে, তা দিতে হবে।

প্রশ্ন:

আবার তিন সংস্করণে বাংলাদেশের তিন অধিনায়ক—এটাকে কীভাবে দেখেন?

সাকিব: বিসিবি যেটা ভালো মনে করেছে, সেটা করেছে। এ নিয়ে কিছু বলার নেই। আমার মত দিয়ে তো কিছু হবে না। যেটাতে ভালো ফল আসবে, সেটাই আসলে আদর্শ।

বাংলাদেশের বর্তমান দল এক বছরের মধ্যে ভালো করবে বলে বিশ্বাস সাকিবের
ছবি: এএফপি
প্রশ্ন:

গল টেস্টে ড্র বা সফরে এখন পর্যন্ত দুটি ম্যাচ জিতলেও শ্রীলঙ্কায় সার্বিকভাবে ব্যাটিংটা তো ভালো হয়নি…

সাকিব: ভালো হওয়ার সম্ভাবনা, লক্ষণ তো দেখা যাচ্ছে। কেউ ইনিংস বড় করতে পারছে না, এটাই সমস্যা। ভালো শুরু পাচ্ছে, ভালো খেলছে, কিন্তু আউট হয়ে যাচ্ছে। এক থেকে চার–পাঁচ নম্বর পর্যন্ত যদি প্রতি ম্যাচে একটা করে সেঞ্চুরি হয় বা ৮০ পর্যন্তও যদি একটা ইনিংস যায়, তাহলেই ভালো একটা অবস্থায় দাঁড়াবে দল। সে রকম কাউকে ধরে দলের পরিকল্পনা গোছাতে হবে। কেউ আক্রমণাত্মক থাকবে, কারও একটু ধরে খেলতে হবে। দলে এই ভূমিকাগুলো আরও পরিষ্কার হয়ে গেলে আশা করি ওরা আরও ভালো খেলবে। আমাদের বোলিং আক্রমণ অনেক ভালো। তবে আমি মনে করি, শ্রীলঙ্কায় রিশাদকে ওয়ানডেতে খেলানো দরকার ছিল। যে ম্যাচে খেলার অবস্থায় ছিল হয়তো কম্বিনেশনে আসেনি; তারপরও কোনোভাবে তার জন্য জায়গা বের করা দরকার ছিল।

আরও পড়ুন
প্রশ্ন:

টি–টোয়েন্টির মিডল অর্ডারটা কি আরও গোছানো দরকার? শামীমকে কি আরও ওপরে সুযোগ দিলে ভালো হতো?

সাকিব: টি–টোয়েন্টিতে আসলে মিডল অর্ডার বলে কিছু নেই। হয় টপ অর্ডার, নয় মারার জায়গা। এক, দুই, তিন নম্বর ব্যাটসম্যান খেলবে নতুন বলে আর মাঝের ওভারে। বাকিরা খেলবে শেষ ১০ ওভার। এখানে মাঝের ওভার বলেও আসলে কিছু নেই। যদি ধরতে চান, ৭ থেকে ১১/১২ ওভার পর্যন্ত ধরতে পারেন। ওই ৫ ওভারে ওপরের কোনো ব্যাটসম্যান থাকলেই তো আর ঝামেলা হয় না।

প্রশ্ন:

টি–টোয়েন্টি অধিনায়ক লিটন দাস বলেছেন তানজিম হাসানকে পেস বোলিং অলরাউন্ডার হিসেবে তৈরি করতে চান…

সাকিব: দলে একজন পেস বোলিং অলরাউন্ডার থাকলে খুবই ভালো। সাকিব (তানজিম) ব্যাটিং ভালো করছে। বেশ কয়েকটি ম্যাচে দেখা গেছে দলের প্রয়োজনে ও রান করতে পেরেছে। বোলিং ভালো, ভালো ফিল্ডার…সব মিলিয়ে আক্রমণাত্মক। এদেরকে একটু ভূমিকা রাখতে দিলে আমার বিশ্বাস দলটা অনেক ভালো হবে।

লিটনের মতো সাকিবেরও চাওয়া তানজিম পেস বোলিং অলরাউন্ডার হয়ে উঠুন
ছবি: এএফপি
আরও পড়ুন
প্রশ্ন:

মোস্তাফিজের বোলিংটা ঠিক আগের মতো হচ্ছে না, সেটা নিশ্চয়ই খেয়াল করেছেন। এর কারণ কী মনে হয়?

সাকিব: দুনিয়ার কোনো খেলোয়াড়ই সব সময় একই রকম পারফর্ম করতে পারে না। এটা নিয়ে চিন্তিত হওয়ার কিছু নেই। বাংলাদেশে সব সময় ও–ই এক নম্বর বোলার হয়ে থাকবে, এমন কোনো কথা নেই। এই সিরিজে একজন এক নম্বর বোলার হবে, আরেক সিরিজে আরেকজন। তারপর হয়তো আবার মোস্তাফিজ ওর মতো বোলিং করবে। প্রয়োজনের সময় কাজটা করে দিলেই হলো।

প্রশ্ন:

সাইফউদ্দিন ও নাঈম অনেক দিন পর টি–টোয়েন্টি দলে ফিরলেন। তবে প্রথম টি–টোয়েন্টিতে নাঈমকে খেলানো হলো চার নম্বরে। এশিয়া কাপ টি–টোয়েন্টি এবং টি–টোয়েন্টি বিশ্বকাপ সামনে রেখে এই পরীক্ষা–নিরীক্ষাগুলোকে আপনি কীভাবে দেখছেন?

সাকিব: ওয়ানডে ও টি–টোয়েন্টিতে কমবেশি এক দলই খেলে। মাত্র কয়েকটা জায়গায় পরিবর্তন হয়। যার যে জায়গা, সে জায়গায় ব্যাটিং করলেই ভালো, যদিও পরিস্থিতির কারণে অনেক সময় সেটা সম্ভব হয় না। তবে আমাদের টি–টোয়েন্টির ব্যাটিং লাইনআপ খুবই ভালো। ওয়ানডেতে আমার কাছে একটাই ঘাটতি মনে হয়েছে। মাঝের ওভারে কীভাবে খেলাটাকে বড় করবে, উইকেট না হারিয়ে ৫–৬ করে রান করবে, ওটা নিয়ে কাজ করার আছে। এখনকার ক্রিকেটে ২–৩ রান করে করলে হবে না; অন্তত ৪–৫ করে করতে হবে। ওভারপ্রতি ৫ করে করতে পারলেও মোটামুটি একটা ভালো রান আসে।

বাংলাদেশ ওয়ানডে দলে একটা ঘাটতি দেখছেন সাকিব
ছবি: প্রথম আলো
প্রশ্ন:

সেই সামর্থ্য কি দেখেন ব্যাটসম্যানদের মধ্যে?

সাকিব: সামর্থ্য আমাদের দলের সবার আছে। কিন্তু মাঠে কাজটা কীভাবে করবে, এটা ওদের বুঝতে হবে। কোন অপশনে গেলে আমাদের ‘লো রিস্ক, হাই বেনিফিট’, তা জানতে হবে। ওপরে–নিচের ব্যাটিং ভালো আছে। ওপেনার যারাই আছে, আক্রমণাত্মক। সমানে পিটায়, দেখতেও ভাল্লাগে (হাসি)। জাকের, শামীমরা যদি প্রতিষ্ঠিত হয়ে যেতে পারে, মাঝখানের ওভারের ওই কাজটুকু কেউ করে দিলেই হবে।

প্রশ্ন:

ওয়ানডে এখন তিন শর বেশি রানের খেলা, যেটা বাংলাদেশ দল প্রায়ই করতে পারে না। মাঝের ওভারের যে সমস্যার কথা বললেন, পারে না কি সে কারণেই?

সাকিব: প্রথমত শ্রীলঙ্কার উইকেট ও রকম ছিল না। এখানে আগে ব্যাট করা দলই জেতে। আর বলতে পারব না কবে এ রকম শেষ হয়েছে যে প্রতিপক্ষ তিন শ-সাড়ে তিন শ করছে, কিন্তু আমরা ২০০-২৫০ রানে অলআউট হয়ে গেছি। আমরা পারছি না ঠিক আছে, অন্যরা পারছে কি না, সেটাও দেখতে হবে। যদি দেখা যায় কোনো দলই পারছে না, দোষ হচ্ছে বাংলাদেশ দলের; সেটা ঠিক নয়।

বাংলাদেশ দল এই মুহূর্তে ওয়ানডে র‍্যাঙ্কিংয়ের ১০ নম্বরে আছে
ছবি: এএফপি
প্রশ্ন:

ওয়ানডে র‍্যাঙ্কিংয়ে বাংলাদেশ এখন ১০ নম্বরে। এখান থেকে সরাসরি বিশ্বকাপে যাওয়া কতটা চ্যালেঞ্জিং?

সাকিব: আমাদের জন্য কঠিন চ্যালেঞ্জ হলো দশের মধ্যে থাকা। এখন জিম্বাবুয়ে যদি অটোমেটিক কোয়ালিফাই করে, দক্ষিণ আফ্রিকাও করে; আমরা কিন্তু তখন ৯–এ থাকলেও ১০ নম্বরে থাকব। ১০–এ থাকলে ১১–তে। কারণ, জিম্বাবুয়ে আমাদের নিচে হলেও ওরা ওপরেই থাকছে। কাজেই আমাদের শ্রীলঙ্কা, আফগানিস্তানকে হারাতে হবে। র‍্যাংঙ্কিংয়ের দিক থেকে ইংল্যান্ডের (৮) অবস্থাও খুব খারাপ এখন। এই দলগুলোর মধ্যে দুটির ওপরে যেতে হবে আমাদের। তাহলে ১০–এর মধ্যে থাকব। যদিও বড় দলের সঙ্গে জিতে গেলে পয়েন্ট তাড়াতাড়ি বেড়ে যাবে। ওই একটা সুবিধা আছে।

প্রশ্ন:

শ্রীলঙ্কা সিরিজের পর তো এ বছর বাংলাদেশের সব খেলাই ঘরের মাঠে। এতে কি সুবিধা হলো?

সাকিব: লক্ষ্য রাখতে হবে হোম সিরিজে যেন ওগুলো আমরা মিস না করি। বাইরে তো ভালো উইকেটই থাকে ওয়ানডেতে। সেখানেও আক্রমণাত্মক ক্রিকেট খেলতে হবে। সিরিজের তিন ম্যাচ না জিতি, একটা জিতলেও হয়। আমাদের প্রথম লক্ষ্য সরাসরি বিশ্বকাপে যাওয়া। তারপরও আপনি অবশ্যই চাইবেন অন্তত ঘরের মাঠে সিরিজগুলো জিততে। বাইরেও যদি দু–একটা জেতা যায় তো খুবই ভালো।

রাজনীতিতে ঢোকার অভিজ্ঞতা নিয়ে নতুন করে কিছু বলতে চান না সাকিব
ছবি: এএফপি
প্রশ্ন:

শেষ প্রশ্ন, শ্রীলঙ্কায় সনাৎ জয়াসুরিয়া প্রথম আলোকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, তাঁর রাজনীতিতে আসার সিদ্ধান্তটা ছিল চরম ভুল। ক্রিকেটারদের কাজ রাজনীতি করা নয়। রাজনীতিতে ঢোকার অভিজ্ঞতা থেকে আপনিও কি একই কথা বলবেন?

সাকিব: জয়াসুরিয়া যেটা ভালো মনে করেছেন বলেছেন। তাঁর জায়গা থেকে তিনি এটা বলেছেন। এটা নিয়ে আমার কিছু বলার নেই। সবার মত আলাদা।