‘প্রতিপক্ষকে জানাতে চাই আমাদের শক্তি আছে’

জিম্বাবুয়ের প্রথম টেস্ট অধিনায়ক ডেভ হটন এখন দলটির প্রধান কোচছবি: প্রথম আলো
ক্রিকেট, ফুটবল, হকি—দক্ষ ছিলেন সব খেলাতেই। আর পছন্দ ছিল ‘কিপারে’র জায়গাটা। ফুটবল ও হকি যতটুকু খেলেছেন, ছিলেন গোলকিপারই। উইকেটকিপিং করেছেন ক্রিকেট ক্যারিয়ারের শুরুতেও। ডেভ হটন পরে পরিচিতি পেয়েছেন জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট ইতিহাসের অন্যতম সেরা ব্যাটসম্যান হিসেবে। তবু ‘কিপার’-এর মানবীয় দিকটা তিনি ধরে রেখেছেন সব সময়। খেলোয়াড় হিসেবে ছিলেন দেশের ক্রিকেটের ত্রাণকর্তা, এখন প্রধান কোচ হিসেবেও ভূমিকাটা একই। হারারেতে প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে ডেভ হটন শুনিয়েছেন নিজের ক্রিকেটদর্শন আর খেলাটা নিয়ে তাঁর ভবিষ্যৎ চিন্তার কথা—

প্রশ্ন :

আইসিসির সহযোগী সদস্য থাকার সময়ও তো বাংলাদেশের সঙ্গে খেলেছেন। সেই সময়ের স্মৃতি কতটা মনে আছে?

ডেভ হটন: আমার বাংলাদেশ স্মৃতি অনেক পুরোনো। ১৯৮৬ সালেও আমরা বাংলাদেশের বিপক্ষে আইসিসি ট্রফির ম্যাচ খেলেছিলাম। সেদিন এখানে ধারাভাষ্য দিতে আসা আতাহার আলী খানের সঙ্গে এ নিয়ে কথা হচ্ছিল। ১৯৯০ সালে তো বাংলাদেশের বিপক্ষে আইসিসি ট্রফির সেমিফাইনালও খেলেছি। কোচ হিসেবেও আমি এর আগে বাংলাদেশের প্রতিপক্ষ দলে ছিলাম।

প্রশ্ন :

বাংলাদেশ তো ১৯৯২ সালেই বিশ্বকাপ খেলতে পারত। আপনার কারণেই হয়তো সেটি হয়নি। ১৯৯০ সালের আইসিসি ট্রফির সেমিফাইনালে আপনার ইনিংসটাই নাকি হারিয়েছিল বাংলাদেশকে। আপনারও তাই মনে হয়?

হটন: আমি যে সেই টুর্নামেন্টে খুব ভালো খেলছিলাম তা নয়। কিন্তু খেলা হয়েছিল ইংল্যান্ডে। আমি টুর্নামেন্টের আগে সেখানে লিগ ক্রিকেট খেলছিলাম। উইকেট, কন্ডিশন সম্পর্কে জানতাম। সেদিন আমি ৮০ রানের মতো করেছিলাম মনে হয়। হ্যাঁ, খুব ভালো স্মৃতি।

প্রশ্ন :

তখন ক্রিকেটার হিসেবে বাছাইপর্ব লড়তেন, এখন কোচ হিসেবে...

হটন: আমি সপ্তাহ দুয়েক আগে এটাই বলছিলাম ছেলেদের। ৩০ বছর আগে আমাদের বাছাইপর্ব খেলতে হতো, যেখানে প্রতিটা ম্যাচই ছিল খুবই চাপের। হারলেই চার বছর পিছিয়ে যাব, এমন চাপ। আমাদের ভাগ্য ভালো যে আমরা টানা ৮ বছর সহযোগী সদস্যদেশগুলোর টুর্নামেন্ট জিতে তিনটি বিশ্বকাপে জায়গা করে নিয়েছি। এখন আবার ছেলেদের একই চক্রের ভেতর দিতে যেতে হয়েছে। যেটা হতাশাজনকই ছিল। ছেলেরাও এবারের টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব খেলে সেটা বুঝতে পেরেছে। আমি ক্রিকেটার হিসেবে যে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি, এখন কোচ হিসেবে একই অভিজ্ঞতা অর্জন করছি।

ভক্তদের সঙ্গে ডেভ হটন
ছবি: টুইটার

প্রশ্ন :

প্রশ্ন: কিন্তু আপনাদের প্রজন্ম তো জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটটাকে একটা পর্যায়ে এনে দিয়েছিল। এরপর কী হলো?

হটন: খেলাটা যে প্রতিযোগিতাপূর্ণ হচ্ছে এটাই তার প্রমাণ। শীর্ষ পর্যায়ে টিকে থাকতে হলে ভালো খেলে যেতে হবে। আপনি যদি বাছাইপর্বে ভালো করেন এবং বিশ্বকাপেও ভালো করতে পারেন, তাহলে তো সমস্যা নেই। এটা ধরে রাখা নিয়ে হলো কথা। গত কয়েক বছর আমরা ভালো করিনি। সে জন্যই টি-টোয়েন্টির বাছাইপর্ব খেলতে হয়েছে। খেলতে হবে ওয়ানডের বাছাইপর্বও।

প্রশ্ন :

আপনি দায়িত্ব নেওয়ার পরই দল জিততে শুরু করেছে। আপনাকে তো জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটেরই ‘কিপার’ (রক্ষক) বলা যায়...

হটন: ‘কিপার’ শব্দটা অনেক বড়। আমি আর যা–ই হোক, জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটকে উদ্ধার করছি না বলে মনে হয় না। কিন্তু আমার কোচিংয়ের অভিজ্ঞতা দীর্ঘদিনের। যখন খেলতাম, তখন থেকেই আমি কোচের ভূমিকায়। টেস্ট খেলতাম, পাশাপাশি কাউন্টি ক্রিকেটে কোচিং করাতাম। সেই অভিজ্ঞতাটাই নিজের দেশকে দিচ্ছি, যা আমি সব সময় করার চেষ্টা করেছি।

প্রশ্ন :

এবার কোচের দায়িত্ব নেওয়ার আগে কী পরিকল্পনা ছিল?

হটন: আমি ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের ক্ষেত্রেও সাহায্য করতে রাজি হয়েছি। কারণ, ঘরোয়া ক্রিকেটটা ঠিক থাকলে জাতীয় দল নিয়ে খুব একটা ভাবতে হয় না। সেখানে কিছু কাজ করেছি। এখন ঘরোয়া ক্রিকেট আগের চেয়ে ভালো। প্রতিটি দলে দুজন করে বিদেশি ক্রিকেটার খেলছে। পরে বোর্ড থেকে বলা হলো জাতীয় দলকে বাছাইপর্বে সাহায্য করতে। আমি জানি না কত দিন প্রধান কোচ থাকব। কারণ, আমি ঘরোয়া ক্রিকেটে যা শুরু করেছিলাম, সেটা শেষ করতে চাই। ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটটাকে শক্ত করতে চাই।

বাংলাদেশের বিপক্ষে টি–টোয়েন্টি সিরিজ জিতেছে জিম্বাবুয়ে
ছবি: এএফপি

প্রশ্ন :

বাছাইপর্ব পার করে বাংলাদেশকেও টি-টোয়েন্টি সিরিজে হারিয়ে দিয়েছে জিম্বাবুয়ে। এত দ্রুত সব পাল্টে গেল কীভাবে?

হটন: বিশেষ কিছু নয়। আমি ছেলেদের সবাইকে চিনি। ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে আমি ওদের দেখি। ওরা সবাই ভালো ক্রিকেটার, দারুণ প্রতিভা। সমস্যা হলো, ওরা খেলত হেরে যাওয়ার ভয় নিয়ে। মাঠে নামতই ভুল করার ভয় নিয়ে। এই মানসিকতা নিয়ে ক্রিকেট খেলা কঠিন। আমি দায়িত্ব নিয়ে এই জায়গাতেই পরিবর্তন আনতে চেয়েছি। বলেছি, তোমরা ভুল শট খেলে আউট হলেও কিছু হবে না। আমি তোমাদের ইতিবাচক দেখতে চাই, আগ্রাসী দেখতে চাই। ছেলেরা যেন মুখে হাসি নিয়ে খেলতে নামে, সেটা দেখতে চাই। আমি শুধু ওদের স্বাধীনভাবে খেলতে বলেছি। কারণ, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আপনি যদি প্যাডেল থেকে একবার পা সরান, তাহলেই শেষ। আমি চেয়েছি ৬ উইকেট পড়ে গেলেও যেন ছেলেরা মেরে খেলে। প্রতিপক্ষকে জানাতে চাই আমাদের শক্তি আছে। যদি আগের জিম্বাবুয়ে হতো, তাহলে শেষ টি-টোয়েন্টি ম্যাচে ব্যাটসম্যানরা মুখ রক্ষার রান করে চলে আসত। সেটা না করে আমরা ঝুঁকি নিয়েছি, জিতেছি। হারতেও পারতাম। কিন্তু ঝুঁকি নিয়ে জেতার সুযোগ তৈরি করেছি। পরিবর্তন এটুকুই। আর কিছু নয়।

প্রশ্ন :

জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের অনেক ‘প্রথমে’র সঙ্গেই আপনার নাম জড়িয়ে। প্রথম টেস্ট অধিনায়ক, প্রথম সেঞ্চুরিয়ান। এটা নিশ্চয়ই গর্বের...

হটন: নিজ দেশের প্রথম টেস্ট ম্যাচে অধিনায়কত্ব করা অবশ্যই গর্বের। দর্শক ভরা মাঠে শক্তিশালী ভারতের বিপক্ষে খেলেছিলাম। আমি সেঞ্চুরি করি সেই ম্যাচে। আবার আক্ষেপও আছে। নিজেদের প্রথম টেস্ট ম্যাচটা আমরা জিততেও পারতাম। ভারতকে ফলোঅনে ফেলতে পারতাম। আমাদের প্রথম টেস্ট জয় পাকিস্তানের বিপক্ষে, সেটাও স্মরণীয়।

প্রশ্ন :

অনেক বছর ধরেই আপনি ক্রিকেটে আছেন। সময়ের সঙ্গে কীভাবে নিজেকে পরিবর্তন করেছেন?

হটন: আমি গত ২৫ বছর ইংলিশ কাউন্টিতে কাজ করছি। সেখানে তিন সংস্করণের ক্রিকেটই হয়। যে কারণে সহজেই পরিবর্তিত ক্রিকেট বিশ্বের সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলা যায়। ক্রিকেট আমার জীবন। আমি যদি আজ অবসর নিই, কাল পা তুলে এই খেলাটাই দেখতে চাইব। আমার নাতিরাও এখন খেলছে। একজন ডার্বিশায়ার কাউন্টির বয়সভিত্তিক দলে আছে, মাত্র ১০ বছর বয়স। সে কেমন ক্রিকেটার হয়ে ওঠে, সেটাও দেখতে চাইব।

জিম্বাবুয়ের অনুশীলনে ডেভ হটন
ছবি: টুইটার

প্রশ্ন :

আপনার পর জিম্বাবুয়েতে অনেক কিংবদন্তি ক্রিকেটার এসেছেন। পরে যাঁরা কোচ হিসেবেও ছিলেন দারুণ সফল। কিন্তু ডানকান ফ্লেচার, অ্যান্ডি ফ্লাওয়ারদের কেউই দেশের ক্রিকেটে কাজ করেননি। এর কোনো বিশেষ কারণ?

হটন: আমি জানি না কেন। উত্তর জানতে তাদের জিজ্ঞেস করতে হবে। আমি আমার কথা বলতে পারি। এটা আমার দেশ। দেশের হয়ে খেলে অনেক কিছু অর্জন করেছি। এখন যতটা পারি দেশের ক্রিকেটকে ফিরিয়ে দিতে চাই।

প্রশ্ন :

আপনাদের সময় জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটেরও একটা পরিচিতি ছিল। এখন জিম্বাবুয়ে কোন ধরনের ক্রিকেট খেলে, সেটিই যেন কেউ বুঝতে পারে না! আপনার কি মনে হয়, জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের স্টাইলটা আসলে কেমন?

হটন: হ্যাঁ, বাংলাদেশ স্পিনের দেশ, স্পিনার আছে অনেক। ব্যাটসম্যানরাও স্পিন ভালো খেলে। এটাই তাদের স্টাইল। অস্ট্রেলিয়ার চারজন ফাস্ট বোলার থাকে। দক্ষিণ আফ্রিকা, ইংল্যান্ডেও। এখন প্রশ্ন, জিম্বাবুয়ের স্টাইল কী? আমাদের কোনো স্টাইল নেই। ঘরের মাঠে খেলা হলেও আমরা জানি না কোনটাতে আমরা ভালো। সবুজ উইকেটে নাকি স্পিন–সহায়ক উইকেটে! পেস বোলিং নাকি স্পিন—আমরা জানি না। আমাদের অনেক স্পিনার আছে, হয়তো আমরা স্পিনারদেরই দেশ হব। কিন্তু আমাদের ব্যাটসম্যানরা স্পিনে তেমন ভালো নয়।

প্রশ্ন :

প্রশ্ন: জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটের দুই যুগের পার্থক্য করতে বললে কী বলবেন?

হটন: দেখুন, ক্রিকেটারদের মধ্যে তেমন পার্থক্য নেই। সামর্থ্য আগে যেমন ছিল, এখনো তেমনই। পার্থক্য মানসিকতায়। ম্যাচ জেতায় যারা, তাদের ভাবনাটা থাকে ব্যতিক্রম। এখন কোনো অ্যান্ডি ফ্লাওয়ার, হিথ স্ট্রিক নেই। আমি এখনকার ছেলেদের দুই দলে ভাগ করে খেলালে একই মানের ক্রিকেট দেখতে পাব। আমাদের সিকান্দার রাজা আছে যে একজন ম্যাচ উইনার, মুজারাবানি আছেন। আমরা এগোচ্ছি। দ্রুতই আগের পর্যায়ে পৌঁছাতে পারব আশা করি।

তবে যদি জানতে চান, ১০ বছর পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কোন দিকে যাবে, তাহলে বলব, প্রতিটি দেশেই হয়তো তখন টি-টোয়েন্টি লিগ বছরের ৯ মাস ধরে চলবে, অনেকটা ফুটবলের মতো।
ডেভ হটন

প্রশ্ন :

আন্তর্জাতিক ক্রিকেট তো বদলে যাচ্ছে। ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটের পরিবর্তিত বাস্তবতায় আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে জিম্বাবুয়ের কী ভবিষ্যৎ দেখেন?

হটন: পরিবর্তন আসছে ঠিকই, কিন্তু সেটা কত দ্রুত আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে আঘাত করবে, আমি নিশ্চিত নই। কারণ, আমি যদি জিম্বাবুয়ের আন্তর্জাতিক সূচি দেখি, সেখানে অনেক ব্যস্ততা। আগামী দুই বছরে ১২-১৫টা টেস্ট খেলার কথা। অথচ আমরা গত দুই বছর টেস্ট পাইনি বললেই চলে। আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কমে আসার সমস্যাটা যখন সামনে আসবে, তখনই দেখা যাবে কী করা যায়। তবে যদি জানতে চান, ১০ বছর পর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কোন দিকে যাবে, তাহলে বলব, প্রতিটি দেশেই হয়তো তখন টি-টোয়েন্টি লিগ বছরের ৯ মাস ধরে চলবে, অনেকটা ফুটবলের মতো।

প্রশ্ন :

সে ক্ষেত্রে জিম্বাবুয়ে, বাংলাদেশের কী হবে, যাদের বড় টি-টোয়েন্ট লিগ নেই?

হটন: তখন আমাদেরই আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট আয়োজন করতে হবে। মোটা অঙ্কের টাকা ঢালতে হবে স্পনসরদের। আমি কি দেখতে চাই জানেন? আমি চাই সাফারির পাশেই একটা ক্রিকেট মাঠ, ভিক্টোরিয়া ফলসের পাশে ক্রিকেট মাঠ। যেখানে মানুষ প্রকৃতি দেখার পাশাপাশি ক্রিকেট দেখবে। এভাবে হয়তো ক্রিকেটকে আরও পরিচিত করা যাবে এই দেশে। তবে এটা নিশ্চিত, আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে আগামী ১০ বছরে আরও চমকপ্রদ হতে যাচ্ছে।