২০২২ সালের এশিয়া কাপের পর আপনি বাংলাদেশ নারী দলের কোচের দায়িত্ব নেন। শুরুর দিকে অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?
হাশান তিলকরত্নে: শ্রীলঙ্কার মেয়েদের দায়িত্বে যখন ছিলাম, তখন দেখেছি, বাংলাদেশের মেয়েরা অফসাইডে বেশ দুর্বল। এরপর কৌশল বের করলাম কীভাবে তাদের বল করতে হবে। ওই ম্যাচে বাংলাদেশের ব্যাটসম্যানরা ভালো করতে পারেনি। বাংলাদেশের দায়িত্ব নেওয়ার পর প্রথম তিন মাস অনেক টেকনিক্যাল কাজ করেছি। সকাল নয়টার দিকে অনুশীলন শুরু করতাম, সন্ধ্যা ছয়টা-সাতটায় শেষ হতো। ব্যক্তি পর্যায়েও অনেক কাজ করেছি। অনেক ভিডিও দেখতাম, ওদের বলতাম তোমাদের এই এই জায়গায় উন্নতি করতে হবে। এখন আমি খুবই সন্তুষ্ট তাদের পারফরম্যান্সে। তবে তাদের আরও উন্নতি করতে হবে। যদি তারা আগামী দু-তিন বছর এ প্রক্রিয়া ধরে রাখতে পারে, তাহলে দুনিয়া জয় করতে পারবে।
তাঁদের মধ্যে কি সে ক্ষুধা দেখেছেন?
তিলকরত্নে: পারফরম্যান্সের জন্য ক্ষুধা আছে। যখন আপনি সেরা দলের বিপক্ষে খেলবেন, অনেক উত্থান-পতন থাকবে। ভুলও করবেন। হারের ভয় পেলে শিখতে পারবেন না। কোচ হয়ে আসার পর তাদের যেটা করাতে চেয়েছি, শুরুতে তা করতে চাইত না। ৮-১০ মাস সময় নিয়েছে আমাকে বুঝতে। তাদের বিশ্বাস করাতে হয়েছে যে আমি ইতিবাচক একটা পরিবর্তন আনতে চাই।
এখন যখন বিশ্বাসের সম্পর্কটা তৈরি হয়ে গেল, চলে যাচ্ছেন কেন?
তিলকরত্নে: সব ভালো কিছুরই একটা ভালো শেষ আছে। আমি মেয়েদের ক্রিকেটে ছয় বছর ধরে কাজ করছি। আমার মা–বাবা এখন বৃদ্ধ, তাঁরা আমাকে মিস করছেন। আমার সন্তানেরা ক্রিকেট খেলে, তাদের অবহেলা করা হচ্ছে। আমার স্ত্রী রাজনীতিতে ব্যস্ত। তাদের সবারই আমাকে ও আমার তাদের প্রয়োজন। এ জন্যই ভাবলাম, দেশে ফিরে যাই।
বাংলাদেশ নারী দলের কোচ হিসেবে কোনো আফসোস আছে?
তিলকরত্নে: ওয়েস্ট ইন্ডিজ ও দক্ষিণ আফ্রিকাকে তাদের মাটিতে তাদের হারানো ভালো অর্জন। কিন্তু আমাদের পারফরম্যান্স ছিল খুবই সামঞ্জস্যহীন। আমাদের এটা বুঝতে হবে, মেয়েরা প্রথমবার আইসিসি চ্যাম্পিয়নশিপে খেলেছে। এভাবে আরও দু-তিন বছর খেলতে পারলে ওরা বিশ্ব জয় করবে। তাদের ওই স্কিল ও মেধা আছে। আমি মনে করি, জ্ঞান অর্জন করা যায়, স্কিল নয়। যদি এভাবে খেলে যায়, তাহলে ম্যাচ জেতার জন্য যথেষ্ট জ্ঞান ওরা অর্জন করবে।
আপনি নাকি দলের সব সিদ্ধান্ত একাই নিতেন। কী বলবেন এ প্রসঙ্গে?
তিলকরত্নে: যা কিছু করেছি, বাংলাদেশের ক্রিকেটের জন্যই। কিছু বিষয় আমাকে বদলাতে হতো, আমি তা করেছি। এমন নয় যে সব সময় অন্য কোচদের, অধিনায়ককে বা নির্বাচকদের জানিয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছি। কিছু সিদ্ধান্ত আমি নিয়েছি, তাতে কিছু খেলোয়াড় কষ্ট পেয়েছে। কিন্তু আমি বাংলাদেশের ক্রিকেটের ভালোর জন্যই সব সিদ্ধান্ত নিয়েছি।
এসব সিদ্ধান্তের একটি তো সিনিয়র ক্রিকেটারদের বাদ দিয়ে দেওয়া। সেটা কেন করেছিলেন?
তিলকরত্নে: টেস্ট রেকর্ড অনুযায়ী আমার এখনো শ্রীলঙ্কার হয়ে খেলার কথা...(হাসি)। কিন্তু বিষয়টা এমন নয়। আপনি অতীতের পারফরম্যান্স দিয়ে খেলতে পারবেন না। সবকিছুই নির্ভর করছে বর্তমানের ওপর, আপনার ফর্ম কেমন, সেটার ওপর। অনেক নতুন ক্রিকেটার দরজায় কড়া নাড়ছিল, আমার তাদের খেলাতে হতো। আমি যখন দেখলাম কেউ ভালো খেলছে, ফিট আছে, পারফর্ম করতে চায়, তাকে নিয়েছি। সবকিছুই নির্ভর করবে আপনার বর্তমান ফর্ম আর ফিটনেসের ওপর।
বাংলাদেশের মেয়েদের ক্রিকেটে গ্রুপিংয়ের কথা শোনা যায়। আপনি কি এমন কিছু দেখেছেন?
তিলকরত্নে: হ্যাঁ। আমি যখন দায়িত্ব নিই, কয়েকটা গ্রুপ ছিল দলে। আমার এটাতে হস্তক্ষেপ করতে হয়েছে এবং আমি গ্রুপিং বন্ধ করেছি। কিছু জিনিস বদলেছি। কিন্তু সেটা বাংলাদেশ ক্রিকেটের ভালোর জন্যই। আমি এখন স্বস্তির একটা পরিবেশ তৈরি করেছি। খেলোয়াড়দের সঙ্গে কথা বললেই বুঝতে পারবেন। আমি তাদের সমান দৃষ্টিতে দেখেছি, আলাদা করে কাউকে পছন্দ করিনি।
গ্রুপিং দূর করা কতটা কঠিন ছিল?
তিলকরত্নে: শুধু এখানে নয়, শ্রীলঙ্কা মেয়েদের দায়িত্ব নিয়েও একই অবস্থা দেখেছি। দলের জন্য এটা খুব খারাপ। আপনাকে পরিস্থিতিটা বুঝতে হবে। কাউকে কষ্ট না দিয়ে সব ঠিক করতে হবে। কোচ হিসেবে আপনার তাদের এমনভাবে ম্যানেজ করতে হবে যেন কেউ কষ্ট না পায়।
অধিনায়ক নিগার সুলতানার ভূমিকা এতে কেমন ছিল?
তিলকরত্নে: সে খুবই ভালো অধিনায়ক। পরিস্থিতি খুব ভালো বোঝে। ও নিজেও চাইছিল এটা (গ্রুপিং) বদলাতে। আমি চলে যাচ্ছি, এটা নিয়ে সে আপসেট। কিন্তু আমার অবস্থাটা ও বুঝেছে।
বাংলাদেশের ক্রিকেটে ‘শ্রীলঙ্কান সিন্ডিকেট’ নিয়েও আলোচনা আছে। আপনি শুনেছেন এ ব্যাপারে?
তিলকরত্নে: এটা খুবই হতাশার। কিন্তু এটা এক কান দিয়ে শুনি, আরেক কান দিয়ে বের করে দিই। আমিও কয়েকবার কথাটা শুনেছি। কিন্তু আমার কখনো এটাকে সিরিয়াস কিছু মনে হয়নি। এ নিয়ে কখনো শ্রীলঙ্কান কারও সঙ্গে কথাও বলিনি।
মেয়েদের স্পিন বোলিং কোচ হিসেবে আরেক শ্রীলঙ্কান দিনুকা হেত্তিয়ারাচ্চিকে আনা হয়েছে। তিনিও নাকি এই সিন্ডিকেটের অংশ?
তিলকরত্নে: আপনি নাহিদা, রাবেয়া ও বাকি স্পিনারদের দেখলেই বুঝবেন, হেত্তিয়ারাচ্চি খুব ভালো কাজ করছেন। তিনি প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ১ হাজার উইকেট নিয়েছেন, কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে জাতীয় দলের হয়ে খেলতে পারেননি। কারণ, তাকে রঙ্গনা হেরাথের সঙ্গে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে হয়েছিল।
যাওয়ার আগে বাংলাদেশের নারী ক্রিকেটারদের কী বলে যেতে চান?
তিলকরত্নে: ওদের বলেছি, যদি তোমাদের কোনো কিছুতে মনে হয় আমার সঙ্গে কথা বলা দরকার, দরজা খোলা আছে। কোচ আসবে, যাবে। ওরা যতক্ষণ দল হিসেবে খেলবে, বেশি ম্যাচ জিতবে।