ক্রিকেটের তিন ফরম্যাটের মধ্যে কোনটা আপনার সবচেয়ে প্রিয়?
লিটন: টেস্ট। আমার কাছে মনে হয় টেস্ট ক্রিকেটটা একটু অন্য রকম। আমি যখন খেলা শুরু করেছি, আমরা খুব বাজেভাবে হারতাম। আমি দেখতাম, ১৯০ ওভার কিপিং করছি; এরপর দুবার অলআউট হয়ে যাচ্ছি খুব তাড়াতাড়ি। আমাদের ওই সময়টায় অনেক ঘাটতি ছিল, বোলিং অ্যাটাকটাও এত ভালো ছিল না। এখন কিন্তু আমাদের বোলিং অনেক ভালো হয়েছে।
ওই সময়টায় যেটা হতো, অন্য দলগুলো আমাদের সঙ্গে চার শ–পাঁচ শ করে মন যখন চায় ডিক্লেয়ার দিয়ে দিত। আমি তো ৫ নম্বরে ব্যাট করতাম, ড্রেসটা খুলে বসতে না বসতেই আবার ব্যাটিংয়ে যাওয়া লাগত। তখন সৌরভ ভাই (মুমিনুল) অধিনায়ক ছিলেন…আমার কাছে মনে হয় সবচেয়ে আনলাকি একটা ক্যাপ্টেন।
কারণ, উনি যখন ক্যাপ্টেন হিসেবে দায়িত্ব নিয়েছেন, না ওনার হাতে কোয়ালিটি স্পিনার ছিল, না কোয়ালিটি অব পেসার ছিল। পুরো দলও পাননি সব সময়। একটা অধিনায়ক যখন দেখবে হাতে পেস বোলিংয়ে কোনো অপশন নেই। ওই সময় ইবাদত নতুন নতুন দলে ঢুকেছে, ইবাদত খুব একটা ভালো বোলারও ছিল না ওই সময়। আমার এখনো মনে আছে, কিপিং করতে দাঁড়ালে আমি জানতাম প্রথম বলটা লেগ সাইড দিয়েই যাবে। নরমালি একটা উইকেটকিপার প্রস্তুত থাকে যে টেস্ট ক্রিকেটের প্রথম বল এজ আসতে পারে। কিন্তু আমার মনে হতো, বল লেগ সাইড দিয়ে যাবে এবং বাইরে গিয়ে আমাকে ওয়াইড সেভ করতে হবে।
ওটা হওয়ার সম্ভাবনাই বেশি ছিল। এখনকার ইবাদত আর তখনকার ইবাদতে অনেক পার্থক্য। ওই সময় আর কোনো পেসার ছিল না ও রকম, যারা ১৪০-এ বল করে প্রতিপক্ষকে প্রেশারে ফেলবে। হ্যাঁ, তাইজুল ভাই, মিরাজ খুবই ভালো বোলার ছিল। কিন্তু দেশের বাইরে কোয়ালিটি পেসার না থাকলে আপনি ভালো করতে পারবেন না।
এ কারণেই বলি, সৌরভ ভাই অনেক আনলাকি ক্যাপ্টেন, উনি জেতার চিন্তাই করতে পারেননি। আপনার হাতে যদি অস্ত্র না থাকে, আপনি তো কখনো ওই ধাপে যেতে পারবেন না। ওই সময় থেকে আমার মাথায় এই জিনিসগুলো কাজ করত। বাংলাদেশ দল এত স্ট্রাগল করছে, কী করা যায়, সৌরভ ভাইয়ের সঙ্গে, মিরাজের সঙ্গে এ নিয়ে অনেক কথাবার্তা হতো।
আমি অনেক টেস্ট খেলা দেখি। অ্যাশেজ দেখেছি, বড় বড় খেলোয়াড়ের খেলা দেখেছি। ওখান থেকেই একটা ভালো লাগা কাজ করে। টেস্ট ক্রিকেটে ফিলটা কী, সেশন অনুযায়ী খেলা চেঞ্জ হয়। ধরেন আজকে হোটেল থেকে বের হলাম, টি–টোয়েন্টি খেলা, চিন্তা থাকে আজ সারা দিন মারব। ওয়ানডেতে চিন্তা করলাম প্রথম ১০ ওভার দেখে খেলব, পরে স্পিন এলে এই শট খেলব, ওই শট খেলব। কিন্তু টেস্ট ক্রিকেটের প্যাটার্ন টোটালি আলাদা। বর্তমানে থেকেই আপনাকে পাঁচ দিনের চিন্তা করতে হবে। আমি মনে করি, টেস্ট ক্রিকেটে ডে ওয়ানে খেলতে যাচ্ছি, রেজাল্ট নিয়ে চিন্তা না করে অন্তত ডে থ্রি পর্যন্ত চিন্তা করে যাওয়া। আমি সব সময় এভাবে ভাবি।
আপনি খুব খারাপ না খেললে এক সেশনে অলআউট হবেন না। তারপর ওরাও আপনাকে ছেড়ে দেবে না। তারপর আবার গিয়ে অলআউট হবেন না। সো এক দিনে খেলা শেষ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। এটা আমার খুব ভালো লাগে। একসময় তো আমরা টেস্টে তিন দিনের বেশি খেলতে পারতাম না। প্রথম লক্ষ্য ছিল খেলাটা পঞ্চম দিনে নিয়ে যাওয়া। এটাই কিন্তু হওয়ার কথা ছিল। আপনি যদি বিশ্ব ক্রিকেটের সঙ্গে তুলনা করতে চান, আপনাকে প্রথমে জানতে হবে কীভাবে পাঁচ দিন পর্যন্ত যেতে হয়। পঞ্চম দিনের টি পর্যন্ত কীভাবে খেলতে হয়, এটা প্রত্যেক খেলোয়াড়ের জানা উচিত।
মিরপুরের কথা আলাদা, এখানে তিন দিনেও রেজাল্ট চলে আসে। কিন্তু বড় দলগুলোর খেলা দেখেন, সাড়ে চার থেকে পাঁচ দিন পর্যন্ত খেলা যায়…ইদানীং অবশ্য দেখা যায় যে চার দিনেও খেলা শেষ হয়ে যাচ্ছে। তবে আপনাকে এটাও জানতে হবে, কীভাবে পাঁচ দিন অবধি যেতে হয়। পাঁচ দিন অবধি যেতে হলে আপনাকে পরিকল্পনা ওভাবেই সাজাতে হবে।
টেস্টের মজা হলো, ডে ওয়ানের উইকেট ও ডে টুয়ের উইকেটের মধ্যে অনেক পার্থক্য। ডে টুয়ের সঙ্গে থ্রি, থ্রির সঙ্গে ফোরের, ফোরের সঙ্গে ফাইভের মধ্যে অনেক পার্থক্য। আপনি হয়তো বোলিং টিম হিসেবে ডে ওয়ানে স্ট্রাগল করছেন, ডে ফাইভে গিয়ে আপনি তার থেকে বেশি বেনিফিট পেতে পারেন।
আমার কাছে তো সব খেলা মিলিয়েই টেস্ট ক্রিকেটের মতো আর কিছু নেই। প্রথম দিন হয়তো একরকম মনে হলো, পরদিনই তা বদলে গেল, শেষে গিয়ে কী হবে, কেউ জানে না…
লিটন: ঠিক বলেছেন। শুধু ক্রিকেটার হিসেবে না, দর্শক হিসেবেও টেস্ট ক্রিকেট নিয়ে আমার ভালো লাগা কাজ করে। ব্যাটিং করার সময় কোনো বোলারকে যদি আমি ১০ ওভার করে বল করাতে পারি, ওর থার্ড স্পেলে গিয়ে খুব মজা লাগে। টায়ার্ড থাকে বডি। তখন কী প্ল্যানিংয়ে যাচ্ছে। এটা ওভারঅল বলছি, এই জিনিসটার মজা একটু অন্য রকম।
যেদিন আমি হয়তো ভালো খেলি, আমার সতীর্থরা ভালো খেলে না। আমি যেদিন খারাপ খেলি, আমার সতীর্থরা ভালো খেলে। দুটি মিলে যায়নি কখনো।
২৬ রানে ৬ উইকেট নেই। সেখান থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে পাকিস্তানের বিপক্ষে টেস্ট জেতাটা রীতিমতো রূপকথা (২০২৪ সালে রাওয়ালপিন্ডিতে)। আপনার ১৩৮ রানের ইনিংসটির যেটিতে বড় ভূমিকা। আমার কাছে তাই আপনার সেরা ইনিংস মনে হয় এটিকে। আপনি নিজে মনে হয়, ২০২১ সালে চট্টগ্রামে পাকিস্তানের বিপক্ষে ১১৪-কে এগিয়ে রাখেন, তাই না?
লিটন: আপনি খেয়াল করে দেখবেন, আমার যতগুলো সেঞ্চুরি, সবই দলের খারাপ অবস্থাতেই হয়েছে। আমি নিজেকে একটা আনলাকি খেলোয়াড় বলি। আনলাকি এই কারণে যে অনেক কিছু এই জন্য হাইলাইটস হয়নি, আমার যত বড় বড় ইনিংসগুলো ছিল, বেশির ভাগ সময়ই বাংলাদেশ ওখান থেকে রেজাল্ট আউট করতে পারেনি।
কেন মানুষ আমাকে ৯৪-এর (২০১৯ বিশ্বকাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে) কথা মনে করে। কারণ, ওই ম্যাচটা আমরা জিতেছি। (২০১৮) এশিয়া কাপ ফাইনালে আমি ১২১ করেছি। যদি ওই ম্যাচটা জিততে পারতাম ওই দিন, আমি কেন, পুরো বাংলাদেশ আমাকে মনে রাখত, একা একটা খেলোয়াড় ১২১ করেছে, সঙ্গে দল কিছুটা অবদান রেখে ম্যাচটা জিতেছে।
একই কথা বলি অ্যাডিলেডে (ভারতের বিপক্ষে ২০২২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে) ওই ম্যাচটা জিতলে ম্যান অব দ্য ম্যাচ আমারই হওয়ার চান্স ছিল। এ রকম অনেক ইনিংসই আছে। যেমন শ্রীলঙ্কার সঙ্গে যখন সেঞ্চুরি করলাম, পাকিস্তানের মতোই অবস্থা (২৪ রানে বাংলাদেশের ৫ উইকেট পড়েছিল)। আমি ১৪১ রান করলাম, মুশফিক ভাইও এক শ কত যেন করলেন (অপরাজিত ১৭৫)। ওই ম্যাচটাতেও তো আমরা রেজাল্ট আউট করতে পারলাম না। আমার ভালো ভালো অনেক ইনিংসই আছে, যেগুলোতে আমরা জিততে পারিনি।
১১৪ রানের যে ইনিংসটার কথা বললেন—আমি বলব, জীবনে যেকোনো প্রথম জিনিসের ফিলিংস আলাদা। আমি জীবনে টেস্ট সেঞ্চুরি করিনি। অপেক্ষা ছিল সেঞ্চুরি কবে হবে, কবে হবে। সেঞ্চুরি করার আগে আমি ৯৪ রান করেছি, আরেকবার ৯৫। আবার দেখেন, এই সেঞ্চুরির ম্যাচটাও কিন্তু আমরা হেরে গিয়েছি। এ জন্য আমি নিজেকে আনলাকি বলি, যেদিন আমি হয়তো ভালো খেলি, আমার সতীর্থরা ভালো খেলে না। আমি যেদিন খারাপ খেলি, আমার সতীর্থরা ভালো খেলে। দুটি মিলে যায়নি কখনো। ওই টেস্টটাও যদি ড্র হতো বা আমরা যদি রেজাল্ট আউট করতে পারতাম, তাহলে সবার অন্য রকমভাবে মনে থাকত।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে কোন ইনিংসটা খেলার সময় আপনার মনে হয়েছে, আপনি যা করতে চাইছেন, তা-ই করতে পারছেন।
লিটন: আমার কাছে মনে হয় দুইটা ইনিংস হতে পারে, এক হচ্ছে ভারতের সঙ্গে ওটা (২০২২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপে অ্যাডিলেডে ২৭ বলে ৬০)। আমি যে রকম চেয়েছি, সে রকমই খেলতে পেয়েছি। আরেকটা হচ্ছে চিটাগংয়ে আয়ারল্যান্ডের সঙ্গে ১৮ বলে যে পঞ্চাশ করলাম। ৮৩ করে আউট হয়ে গেলাম (২০২৩ সালের মার্চে টি-টোয়েন্টিতে)।
ক্রাইস্টচার্চে সেঞ্চুরির কথাটাও মনে পড়ছে। এমন না যে বাংলাদেশ জিতেছে, এমন ম্যাচে আমি পারফর্মই করিনি। হয়তো পারফর্ম করেছি, তবে বড় কিছু করতে পারিনি। কিন্তু যেসব ম্যাচে হয়তো একদিকে আমি খেলে গেছি, অন্যরা স্ট্রাগল করেছে—সেগুলো জিততে পারিনি।
শট তো অনেকেই খেলে, ধরেন সূর্যকুমারও শট খেলে এবং ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার, ওই তিনজন খেলোয়াড়ের চেয়ে হয়তো বেশি ডিমান্ডেবল (ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে)। অন্যরা যদি ৪০ বলে ৬০ করে, ও ৮০ করে। কিন্তু ব্যাটিংয়ে সৌন্দর্যের একটা ব্যাপার আছে না…
আপনার ব্যাটিং দেখতে খুব সুন্দর, এটা তো সবাই বলে। আপনিও এ কথা অনেক শুনেছেন। দেখার জন্য আপনার প্রিয় ব্যাটসম্যান কে? সংখ্যাটা একাধিকও হতে পারে।
লিটন: আমি শচীন টেন্ডুলকারের খেলা খুব দেখতাম। শেবাগ ব্যাটিং করলে টিভির সামনে বসে থাকতাম। মাইকেল ক্লার্কের ব্যাটিং দেখতাম। মাহেলার (জয়াবর্ধনে) ব্যাটিং দেখতাম। আমি অনেক খেলোয়াড় দেখেছি, কিন্তু মাহেলার মতো দেখিনি। এত সুন্দর করে খেলত, ১৪০-এর বলও মনে হতো স্পিন বোলিং খেলছে।
এখনকার ব্যাটসম্যানদের মধ্যে আমার জো রুটের খেলা দেখতে ভালো লাগে। কেইন (উইলিয়ামসন), জো রুট, বিরাট (কোহলি) এদের খেলার যে প্যাটার্ন, যে আক্রমণাত্মক মানসিকতা নিয়ে ক্রিকেট খেলে…। বিরাট তো টোটালি অ্যাগ্রেসিভ মাইন্ডের খেলোয়াড়। কিন্তু কেইনকে দেখবেন, তার প্যাটার্ন অনেক স্লো। শুরুটা অনেক স্লো, কিন্তু যখন ফিনিশ করে, তখন কাভার করে ফেলে। জো রুট এক প্যাটার্নেই খেলে। এই কয়েকজনের খেলা আমার খুব পছন্দের। কখনো যদি দেখি টিভিতে এরা খেলছে, আমি খেলাটা দেখি।
ব্যাটিং দেখতে সুন্দর লাগাটা আপনার কাছে কতটা গুরুত্বপূর্ণ?
লিটন: আমার কাছে দেখতে সুন্দরটা একটু গুরুত্বপূর্ণই। শট তো অনেকেই খেলে, ধরেন সূর্যকুমারও শট খেলে এবং ইমপ্যাক্ট প্লেয়ার, ওই তিনজন খেলোয়াড়ের চেয়ে হয়তো বেশি ডিমান্ডেবল (ফ্র্যাঞ্চাইজি ক্রিকেটে)। অন্যরা যদি ৪০ বলে ৬০ করে, ও ৮০ করে। কিন্তু ব্যাটিংয়ে সৌন্দর্যের একটা ব্যাপার আছে না…হয়তো আমি যদি কোনো দিন চেষ্টা করি ওসব শট খেলার, তাহলে হয়তো দেখব সূর্যকুমার কীভাবে খেলে।
আমি যে প্যাটার্নে ক্রিকেট খেলি, তাতে আমি দেখব বিরাট কোহলি কীভাবে কাভারের ওপর দিয়ে মারে, লো রিস্ক শটে কীভাবে সে রান করতে পারছে। আমি দেখব, ও কীভাবে স্পিন বোলিংয়ে কাভারের ওপর দিয়ে মারছে, কীভাবে সাইট স্ক্রিন বরাবর মারছে।
এটা তো ব্যাটসম্যান হিসেবে আপনার টেকনিক্যাল চোখে দেখার ব্যাপার। আমি যদি শুধু দেখতে সুন্দর ব্যাটিংয়ের কথা বলি, কার কথা বলবেন? প্রশ্নটা এ জন্য করছি, আপনার ব্যাটিংকে তো ইয়ান বিশপ লেওনার্দো দা ভিঞ্চির মোনালিসা আঁকার সঙ্গে তুলনা করেছেন। আপনি খারাপ করলে কথাটা অনেক ব্যঙ্গার্থেও ব্যবহার করে। ইয়ান বিশপ কি আপনার ক্ষতিই করেছেন মনে হয়?
এম এস ধোনির যে স্টাম্পিং, অন্য কারও সঙ্গে এর তুলনা চলে না। ধোনি তো বল খুব কুইক লাগায়। কিন্তু আমি যখন রিয়েল ফ্যান হিসেবে বলব কার কিপিং ভালো লাগে, তখন আমি বলব ম্যাককালাম।
লিটন: মনে হয় করতে পারে (হাসি)। আমার কাছে মাইকেল ক্লার্কের ব্যাটিং দেখতে ভালো লাগত। শুধু ব্যাটিং না, সবকিছুই। ক্যাপ্টেন হিসেবে যখন স্লিপে দাঁড়াত, ওর ড্রেসআপ, পুরো প্যাকেজটাই আমার কাছে ভালো লাগে।
আপনার কি কোনো আইডল ছিল, যাঁর মতো হতে চেয়েছিলেন?
লিটন: মাইকেল ক্লার্ককে আমি অনেক ফলো করছি, তার ব্যাটিং আমি অনেক দেখেছি। সত্যি কথা বলতে, যখন থেকে আমি ক্রিকেট দেখি, আমি উইকেটকিপার হিসেবে যখন বড় হচ্ছি, আমি কাকে দেখব, আমি দেখছি গিলক্রিস্টকে, আমি দেখছি ম্যাককালামকে, দেখেই ভালো লাগছে।
বিশেষ করে ম্যাককালামকে—যখন ওর কিপিং দেখবেন, ও খুব স্মার্ট ওয়েতে কিপিং করত, ড্রেসআপ থেকে শুরু করে সবকিছুই অন্য রকম। বিশ্ব ক্রিকেটে একমাত্র কিপার ছিল, প্যাডট্যাড ছাড়াই কিপিং করে ফেলত। এরপর যদি কারও কথা বলি, এম এস ধোনির যে স্টাম্পিং, অন্য কারও সঙ্গে এর তুলনা চলে না। ধোনি তো বল খুব কুইক লাগায়। কিন্তু আমি যখন রিয়েল ফ্যান হিসেবে বলব কার কিপিং ভালো লাগে, তখন আমি বলব ম্যাককালাম।
ব্যাটসম্যান লিটন বেশি ভালো, না উইকেটকিপার লিটন—এ প্রশ্নটা কিন্তু আমার মনে প্রায়ই জাগে। আপনার কিপার হওয়ার গল্পটা কী? ফুটবলে গোলকিপার আর ক্রিকেটে উইকেটকিপার তো বেশির ভাগই ঘটনাচক্রে হয়ে যাওয়া…
লিটন: আমরা যখন এলাকাভিত্তিক খেলতাম, তখন তো টেনিস বলে খেলতাম। টেপ টেনিসও খেলতাম না। ম্যাককালামের কিপিং দেখে এত ভালো লাগত যে যখন টেনিস বলে খেলতাম, তখনো বড় ভাইদের বলতাম আমাকে কিপিংয়েই রাখতে হবে। আমি কিপারই ছিলাম, ব্যাটিং পারতামও না। আমার হাতে কোনো শট ছিল না। আমি জাস্ট ঠেকিয়ে এক-দুই রান নিতে পারতাম। টেনিস বলে তো আর গ্লাভস লাগে না। তারপরও আমি যখন কিপিংয়ে দাঁড়াতাম, ম্যাককালামের কথা মনে করে হাতে গ্লাভস পরতাম।
যখন বিকেএসপিতে ভর্তি হলাম, ৬–৭-এ ব্যাটিং করতাম। আমার খেলাটা ছিল এ রকম যে বড় শট মারতে পারতাম না, কিন্তু এক রান আটকাত না আমার। পেস হোক বা স্পিন, আমি ঠিকই এক রান নিয়ে নিতাম। স্যার (বিকেএসপির কোচ মন্টু দত্ত) একদিন আমাকে বললেন, ‘তুমি যদি বড় খেলোয়াড় হতে চাও, তুমি যেখানে ব্যাটিং করো, এখানে আসলে লাভ হবে না, তুমি ওপেন করতে শুরু করো।’
স্যারই আমাকে জোর করেছেন ওপেন করতে। তারপর ওপেন ওপেন ওপেন…কিপিং কিন্তু কখনো ছাড়িনি। আমি যখন ১৯-এ (অনূর্ধ্ব–১৯ জাতীয় দল) আসলাম, আমি–সোহান–বিজয়, দলে তিনটা কিপার। কিপিং তো একজনই করবে, বাকিদের ফিল্ডিং করতে হবে। আমি যেহেতু ওপেনার ছিলাম, আমাকে বলল, তুমি শুধু ওপেন নিয়ে চিন্তা করো। আমি ১৯–এ খেললাম শুধু ওপেনার হিসেবে। আবার যখন জোনে (আঞ্চলিক দলে) ছিলাম, তখন কিপার ছিলাম, ওপেনারও ছিলাম। আমি চার দিনের খেলায় ১০০–১১০ ওভার কিপিং করার পর ওপেনিংয়ে নেমে ১০০–১৫০ রান করতাম। আমার কাছে তখন এটা কঠিন মনে হয়নি, আমি উপভোগ করেছি।
কিন্তু যখন আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে এলাম, তখন মুশফিক ভাই ছিলেন কিপার। উনি যেহেতু নিয়মিত কিপিং করেন, আমার তো টিমে খেলতে হলে ব্যাটসম্যান আর ফিল্ডার হিসেবে খেলতে হবে। আমি আবার ভালো ফিল্ডার ছিলাম না। আমি নিজেকে এই জায়গায় ডেভেলপ করেছি, আমাকে কেউ পুশ করেনি কিন্তু। আমি জানতাম, খেলতে হলে আমাকে ভালো ফিল্ডার হতে হবে। এই সময়টায় আমাকে সাহায্য করেছে (এবি) ডি ভিলিয়ার্স। কারণ, আমি তাকে দেখতাম, যখন দলের প্রয়োজন কিপিং করত, আবার দলের ওয়ান অব দ্য বেস্ট ফিল্ডার। আমি চিন্তা করেছি যে আমাকেও এমন হতে হবে। ব্যাটিং চালিয়ে যাব, যদি সুযোগ আসে কিপিংয়ের, কিপিং করব, না হলে আমাকে সেরা ফিল্ডার হতে হবে। ফিল্ডিং প্র্যাকটিস করতে করতে আমি তখন খুব ভালো ফিল্ডার হয়ে গিয়েছিলাম।
এতে আপনার কিপিংটা কি ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি?
লিটন: আমি সুযোগই পাইনি, ক্ষতিগ্রস্ত তো দূরের কথা। অনেকে তো জানতই না যে আমি কিপার। যখন আমি আইপিএলে খেলতে গিয়েছি, আইপিএলে আমার ইন্ডিয়ান টিমমেটরাও জানত না আমি কিপিং পারি। যখন আমি টেস্ট ক্রিকেটে কিপার হিসেবে খেললাম, তখন মানুষ জানতে পারল আমি কিপিংও করতে পারি। যেসব খেলোয়াড় আমার সঙ্গে খেলবে, তারা যখন দেখবে আমি ফিল্ডিং আর ব্যাটিং করি, তারা তো আমাকে সেভাবেই চিনবে। কিপিংয়ে আমি তাই অনেক পেছনে চলে গিয়েছিলাম। এরপর তো টেস্ট ক্রিকেটে টানাই কিপিং করে আসছি।
কিপিং গ্লাভস হাতে নেওয়া নিয়ে কি আপনার ও মুশফিকের মধ্যে কোনো টানাপোড়েন হয়েছে?
লিটন: না, না। এমন ছিল না যে আমাকে কিপিং করতেই হবে। আমার জিনিসটা ভালো লাগে। একটা হচ্ছে করতেই হবে, আরেকটা হলো ভালো লাগে। টিম আমাকে বারবারই বলেছে যে তোমাকে খেললে ফিল্ডার হিসেবেই খেলতে হবে। আমি আমার ওই রাস্তাটা বেছে নিয়েছি। কিন্তু কখনো এটাতে গ্যাপ রাখিনি যে আমাকে কোনো দিন কিপিং গ্লাভস তুলে দেয়, আমি যেন রেডি থাকতে পারি। এটা তো একটা নরমাল প্যাটার্ন, আপনি যখন টানা একটা কাজ করবেন, সেটার ধারাবাহিকতা আপনার ভালো হবে। যখন হুটহাট কিছু করবেন, তখন ধারাবাহিকতা চেঞ্জ হতেই পারে।
আপনার হয়তো মনে আছে, আমরা যখন (২০১৮) এশিয়া কাপ খেলতে গেলাম, মুশফিক ভাই বুকে ব্যথা পেলেন...তখন কিন্তু আমি কিপিং করেছি। আমার জিনিসটা ছিল এ রকম—বড় ভাই যখন ইনজুরড ছিল বা কোনো কারণে খেলতে পারেননি, তখন আমি কিপিং গ্লাভস হাতে পেয়েছি।
ম্যাককালাম তো আপনার ছেলেবেলার কিপিং–হিরো, এখনকার কিপারদের মধ্যে কাকে ভালো লাগে?
লিটন: এই মুহূর্তে যদি ফেবারিট কিপার বলেন, সত্যি কথা বলতে যাকে দেখে পাঁচ-ছয় বছর ধরে আমি নিজেকে কিপিংয়ে বদলেছি, সে ডি কক।
কেন, কুইন্টন ডি কক কেন? তাঁর স্পেশালিটি কী?
লিটন: স্পেশালিটি বলতে আমার কাছে মনে হয়েছে আগে লিটন দাস কিপিংটাকে যত বাড়তি প্রেশার হিসেবে নিত, এখনকার লিটন দাস কিপিং জিনিসটাকে এত বাড়তি প্রেশার হিসেবে নেয় না। বরং এভাবে ভাবে, যে কাভারে ফিল্ডিং করে, তার কাছেও একটা বল আসে; যে কিপিং করে, তার কাছেও একটা বল আসে। আসল কাজ হচ্ছে বলটা ধরা। আপনি কত সুন্দরভাবে ধরলেন, এটা কোনো ব্যাপার না।
আগের লিটন দাসের কথা যদি বলি, নাইন্টিনের (২০১৯) শুরুর দিকে আমি ভাবতাম, বলটা কত সুন্দরভাবে ধরতে পারব। এখনকার লিটন দাস ভাবে, যেভাবে হোক বলটা ধরতে হবে।
এটা তো চাপ অনেক কমিয়ে দেয়...
লিটন: আমার কাছেও মনে হয়, অনেক চাপ কমিয়ে দেয়। ডি কককে দেখবেন কিপিংয়ের সময় বসেও না। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কিপিং করছে। আমিও অনেক ম্যাচে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কিপিং করেছি। কেন আমি এই কথা বলি, আপনি যখন ১২০টা ওভার উঠবেন-বসবেন, সে সময় আপনার অনেক এনার্জি ক্ষয় হবে। আর একটা ব্যাপার, ট্রু উইকেটে কিপিং করার সময় আমি জানি বল কখনো ওয়ান বাউন্সে আসবে না। তো আমি কেন বসব?
আমি যদি চেয়ার পজিশনে থাকি, সে ক্ষেত্রে জাম্পটা বেশি দিতে পারব। আবার যখন ঘূর্ণি উইকেটে খেলি, আমি জানি আমাকে বসতে হবে। কারণ, আমি জানি বল ঘুরবে। কারণ, আমি যদি আপরাইট হয়ে থাকি, তখন তো আমি মুভমেন্ট করতে পারব না।
