‘লারার কাছ থেকে শিখেছি ব্যাটসম্যানশিপ’

অ্যান্টিগার রিক্রিয়েশন গ্রাউন্ডের বর্তমান করুণ চিত্রের কথা তো এখন আপনারাও জানেন। ২০০৩ সালে সে মাঠেই অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে টেস্টে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ৪১৮ রান তাড়া করা জয়ের বিশ্ব রেকর্ডটা হয়েছিল যাঁদের অনবদ্য শতকে, সেই দুজনই গায়ানার মানুষ। একজন শিবনারায়ণ চন্দরপল, বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের মেয়েদের ক্রিকেটের কোচ। আরেকজন রামনরেশ সারওয়ান, তিনিও সপরিবার যুক্তরাষ্ট্রে থাকলেও বর্তমানে ছুটি কাটাতে আছেন জর্জটাউনে। সম্প্রতি ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ডের নির্বাচকের পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে সারওয়ান এখন পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী। প্রভিডেন্স স্টেডিয়ামের ঠিক পাশেই আমাজনিয়া মলের মালিক, সেখানে খুলেছেন নিজের একটা রেস্টুরেন্টও। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে ওয়েস্ট ইন্ডিজের সাবেক অধিনায়ক রামনরেশ সারওয়ানের সঙ্গে কথা হলো তাঁর সেই আরএস ৫৩ রেস্টোবার অ্যান্ড লাউঞ্জে বসেই—

নিজের রেস্টোবারের সামনে রামনরেশ সারওয়ানছবি: প্রথম আলো

প্রশ্ন :

বাংলাদেশ-ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজে নিশ্চয়ই চোখ রাখছেন। টেস্ট ও টি-টোয়েন্টিতে ভালো করার পর ওয়ানডেতে কেন এত খারাপ করছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ?

রামনরেশ সারওয়ান: আমার জন্য বলাটা কঠিন। বড় ছেলে খেলা দেখতে চেয়েছিল বলে ওকে নিয়ে টি-টোয়েন্টি ম্যাচটা দেখতে গিয়েছিলাম। পরে ব্যস্ততার জন্য ওয়ানডেগুলো দেখা হয়নি। তবে আমার যেটা মনে হয় বা যা শুনেছি, আমাদের ব্যাটসম্যানরা স্পিন ভালো খেলতে পারেনি। এটা আমাদের অনেক দিনের সমস্যা, আমাদের ক্রিকেটারদের একটা উন্নতির জায়গাও। আর একটা ব্যাপার, আমরা এখন আর আগের মতো ভালো ক্রিকেটার তুলে আনতে পারছি না। ব্যাটসম্যানদের টেকনিক্যাল অনেক সমস্যা আছে।

জর্জটাউনে রামনরেশ সারওয়ানের আমাজনিয়া মল
ছবি: প্রথম আলো

প্রশ্ন :

কিন্তু ওয়ানডের ঠিক আগে টি-টোয়েন্টি সিরিজটা তো তারা খুব ভালো খেলল...

সারওয়ান: আমাদের অনেক খেলোয়াড়ই টি-টোয়েন্টিতে বেশ মানিয়ে নিতে পারে, যেটা তারা ওয়ানডেতে পারে না। আমাদের বেশ কিছু শক্তিশালী ব্যাটসম্যানও আছে। কিন্তু ওরা খুব বেশি প্রথম শ্রেণির ম্যাচ খেলে না। সে জন্যই আগের ব্যাটসম্যানদের মতো এখনকার ব্যাটসম্যানদের লম্বা ইনিংস খেলার টেম্পারামেন্ট নেই। আর এখন তো সবাই টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটের বাজারের দিকেই তাকিয়ে থাকে।

প্রশ্ন :

টি-টোয়েন্টিতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের ভালো দল হয়ে ওঠায় সিপিএলের কতটা ভূমিকা দেখেন?

সারওয়ান: সিপিএল বেশ ইতিবাচক প্রভাবই ফেলছে। তবে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ডের উচিত সিপিএল ছাড়াও আলাদা একটা টি-টোয়েন্টি টুর্নামেন্ট আয়োজন করা, যেখানে শুধু ওয়েস্ট ইন্ডিজের ক্রিকেটাররা খেলবে। কারণ, সিপিএলে চার-পাঁচটা জায়গা বিদেশি ক্রিকেটাররাই নিয়ে নেয়। তার মানে একটা দলের প্রায় অর্ধেক জায়গাই আমাদের তরুণ ক্রিকেটারদের জন্য বন্ধ হয়ে যায়। সে জন্যই আরও টুর্নামেন্ট আয়োজন করে ওদের আরও বেশি খেলার সুযোগ করে দিতে হবে।

সারওয়ানের রেস্টোবারের নাম আরএস ৫৩
ছবি: প্রথম আলো

প্রশ্ন :

জানেন নিশ্চয়ই, এবারের সিপিএলে সাকিব আল হাসান আপনাদের দল গায়ানা আমাজনের হয়ে খেলবে...

সারওয়ান: হ্যাঁ, জানি। ওর অন্তর্ভুক্তি দলের জন্য ভালো হবে। বছরের পর বছর সে পারফরম্যান্সের ধারাবাহিকতা ধরে রেখেছে। তার অভিজ্ঞতা থেকে গায়ানার তরুণ ক্রিকেটাররাও নিশ্চয়ই কিছু শিখবে।

সারওয়ানের রেস্টোবারের নাম আরএস ৫৩
ছবি: প্রথম আলো

প্রশ্ন :

২০০৩ সালে অ্যান্টিগায় অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে চতুর্থ ইনিংসে রেকর্ড ৪১৮ রান তাড়া করে জেতায় বড় ভূমিকা ছিল আপনার আর শিবনারায়ণ চন্দরপলের সেঞ্চুরির। ক্যারিয়ারের সবচেয়ে বড় অর্জন কি ওটাকেই বলবেন?

সারওয়ান: দেখা হলে সবাই আমাকে এটা নিয়েই জিজ্ঞেস করে। ইতিহাসের অংশ হতে পারাটা তো অবশ্যই দারুণ একটা ব্যাপার। এখন পর্যন্ত আর কোনো দল এটা করতে পারেনি। কাজেই ওই ম্যাচ, ওই ম্যাচে করা সেঞ্চুরি আমার জন্য সারা জীবনই বিশেষ কিছু হয়ে থাকবে।

প্রশ্ন :

৭৪ রানে ৩ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর আপনি উইকেটে এসে লারার সঙ্গে জুটি বাঁধেন। তখন কি ভাবতে পেরেছিলেন এই ম্যাচে জেতাও সম্ভব?

সারওয়ান: ওই সময় লক্ষ্য ছিল আমরা বলের মেধা অনুযায়ী আমাদের স্বাভাবিক খেলাটা খেলব। অস্ট্রেলিয়ার বোলাররা খুব আক্রমণাত্মক বোলিং করছিল। সে জন্য আমাদের সামনে অনেক ফাঁকা জায়গা তৈরি হয়েছিল। সেটা অনেক সাহায্য করেছে আমাদের। তবে রানটা তাড়া করে জিততে হবে, আমরা এই চিন্তা নিয়ে ব্যাট করিনি। আমরা শুধু স্বাভাবিক খেলাটাই খেলতে চেয়েছি এবং সেটা খেলতেও পেরেছি।

আরএস ৫৩ রেস্টোবারের সামনে সারওয়ান
ছবি: প্রথম আলো

প্রশ্ন :

সেই ঐতিহাসিক মাঠ রিক্রিয়েশন গ্রাউন্ডের বর্তমান অবস্থা কি জানেন? এখন তো আর সেখানে ক্রিকেট খেলা হয় না...

সারওয়ান: হ্যাঁ, আমি শুনেছি। এটা খুবই দুঃখজনক। অথচ ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ডের কার্যালয় কিন্তু অ্যান্টিগাতেই। ওই মাঠে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটের অনেক ইতিহাস মিশে আছে।

প্রশ্ন :

লারা ও চন্দরপলের ছায়ায় অনেক দিন খেলেছেন। তাদের কাছ থেকে কি নিতে পেরেছেন, যেটা নিজের খেলায় কাজে লেগেছে?

সারওয়ান: দুজন ছিল দুই রকম মানুষ। লারা খুব ভেবেচিন্তে কিছু করত না। অন্যদিকে শিব (চন্দরপল) ছিল খুবই গোছানো। আমি মনে করি আমার ব্যাটিংয়ে লারার চিন্তাভাবনার অনেকটা ছাপ ছিল। একইভাবে শিবের ধৈর্যটা আমার দারুণ লাগত। নির্দিষ্ট করে যদি বলি, লারার কাছ থেকেই আমি ‘ব্যাটসম্যানশিপ’ শিখেছি। কোন বলটাকে আক্রমণ করা যাবে, কোনটাকে আক্রমণ করা যাবে না বা বাউন্ডারি মারার পরের বলটাতে আমার কী আশা করা উচিত। তার কাছ থেকে কিছু বোলারের ধরন সম্পর্কে বুঝেছি। আর শিবের কাছে শিখেছি উইকেটে লম্বা সময় থাকতে হবে এবং রান করে যেতে হবে (হাসি)।

আরএস ৫৩ রেস্টোবারের ভেতরের দৃশ্য
ছবি: প্রথম আলো

প্রশ্ন :

অ্যান্টিগার সেঞ্চুরির আগে টেস্টে আপনার একটাই সেঞ্চুরি ছিল, বাংলাদেশের বিপক্ষে। কিন্তু অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে ১০৫ রানের ইনিংসের পর নিয়মিত সেঞ্চুরি পেতে শুরু করে অবসরের আগে করলেন আরও ১৩টি সেঞ্চুরি। ৪১৮ তাড়া করে জেতা ম্যাচের সেঞ্চুরি কি তবে আপনার আত্মবিশ্বাস বাড়িয়ে দিয়েছিল?

সারওয়ান: আপনি ঠিকই বলেছেন, ওই ইনিংসটা আমার আত্মবিশ্বাস অনেক বাড়িয়ে দিয়েছিল। আশপাশে যারা ছিল, তারাও তখন আমার কাছে অনেক কিছু শিখতে চাইত। এটাই হয়...আপনি যত বেশি আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলবেন, ততই শিখবেন। খেলাটাকে ভালোভাবে বুঝবেন।

আমাজন মলের ভেতরের একটা অংশ
ছবি: প্রথম আলো

প্রশ্ন :

শৈশবে জর্জটাউনের স্টেলা মারিস প্রাইমারি স্কুল মাঠে আপনার ক্রিকেটে হাতেখড়ি। অবসরের ঘোষণাও দিয়েছেন সেখান থেকেই। এর পেছনে কি কারণ ছিল?

সারওয়ান: আমি যখন খুব ছোট ছিলাম, স্কুলের মাঠে বড়রা খেলত। একদিন আমি তাদের সঙ্গে খেলতে চাইলাম। ব্যাটটা সম্ভবত আমার চেয়ে একটু বড়ই ছিল। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তারা আমাকে খেলায় নিল। এভাবেই আমার ক্রিকেট শুরু। এরপর একসময় স্কুল দলে সুযোগ পেলাম, দেশের অন্যতম সেরা ক্লাব জিসিসিতে (জর্জটাউন ক্রিকেট ক্লাব) খেললাম। আমি খুব সৌভাগ্যবান ছিলাম, কারণ স্কুল থেকে আমাকে অনেক সাহায্য করেছে খেলার ব্যাপারে। অনেক অল্প বয়সে আমাকে খেলতে দিয়েছে। সে কারণেই যেখান থেকে আমার শুরু, সেখানে গিয়ে শেষ করেছি।

প্রশ্ন :

ক্যারিয়ারের শেষ টেস্ট খেলেছেন মাত্র ৩১ বছর বয়সে। এ নিয়ে কোনো আফসোস আছে?

সারওয়ান: তেমন না। হ্যাঁ, আরও কিছুদিন খেলতে পারলে তো ভালোই হতো। আমার মধ্যে হয়তো আরও কিছু দেওয়ার ছিল। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেটা পারিনি। তৃপ্তি-অতৃপ্তি যা-ই থাকুক, আমি কৃতজ্ঞ যে আমি ক্যারিবিয়ানদের প্রতিনিধিত্ব করতে পেরেছি।

প্রশ্ন :

আপনার মাথায় পরা লাল ব্যান্ডানা নিয়ে তো অনেক গল্প। কিন্তু সেটা নাকি কোনো স্টাইল ছিল না, হেলমেট মাথার তুলনায় বড় হতো বলে পরতেন...

সারওয়ান: (হাসি) হ্যাঁ, তখন আমার মাথায় হেলমেটটা অনেক বড় হতো। আমার মাথার মাপের হেলমেট ছিল না। হেলমেটের নিচে এটা পরলে হেলমেটটা ঠিকঠাক মাথায় বসে যেত। কিন্তু অনেকে ভাবত ওটা আমার স্টাইল। কিছু ব্যান্ডানা আমি এখনো রেখে দিয়েছি। বাচ্চারা বড় হলে ওদের দেব।

আমাজনিয়া মলের পাশেই সারওয়ানের বাড়ি
ছবি: প্রথম আলো

প্রশ্ন :

ক্রিকেটের সঙ্গে সম্পর্ক চুকিয়ে পুরোদস্তুর ব্যবসায়ী হয়ে গেছেন। আমাজনিয়া মল আর আরএস রেস্তোবার অ্যান্ড লাউঞ্জ ছাড়া আর কোনো ব্যবসা কি আছে?

সারওয়ান: না, শপিং মল আর রেস্টুরেন্টের ব্যবসাই শুধু। তবে আমার আরেকটা রেস্টুরেন্ট আছে ইন্ডিয়ান ও থাই খাবারের। আসলে খুব অল্প বয়সেই আমি ব্যবসার গুরুত্বটা বুঝে গিয়েছিলাম। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেটে যখন আসি, বুঝতে পারি এখানে কোনো কিছুই নিশ্চিত নয়। নিজের ভাগ্যটা অন্যদের গড়তে না দিয়ে নিজেকেই গড়তে হবে। আমি শুরুতে কানাডায় রেস্টুরেন্ট ব্যবসা শুরু করেছিলাম। সেটা দাঁড় করাতে পারিনি। গায়ানায় তেল পাওয়া যাওয়ার পর এখানে ব্যবসা-বাণিজ্যের ভালো সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে। যাঁরা আমাকে এই ব্যবসা দাঁড় করানোর ক্ষেত্রে সাহায্য করেছেন, সবার কাছেই আমি কৃতজ্ঞ।