‘আমাদের ফুটবল নিয়ে কোনো পরিকল্পনা নেই, এটাই বাস্তবতা’ 

২০০৩ সালের সাফজয়ী বাংলাদেশ দলের অন্যতম সদস্য ছিলেন আলফাজ আহমেদ। জাতীয় দলের সাবেক অধিনায়ক দুই দশক আগে দেশের মাটিতে পাওয়া সেই সাফল্যের স্মৃতিচারণার পাশাপাশি কথা বলেছেন এবারের সাফ ফুটবলে বাংলাদেশের সম্ভাবনা নিয়েও—

বাংলাদেশ জাতীয় ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক আলফাজ আহমেদছবি : শামসুল হক
প্রশ্ন:

২০০৩ সাফজয়ী দলের শক্তির জায়গাটা মূলত কী ছিল?

আলফাজ আহমেদ: আমাদের প্রস্তুতি খুব ভালো ছিল। কোচ জর্জ কোটান দুই বছর সময় নিয়ে দলটাকে তৈরি করেছিলেন। সব পজিশনে ছিল অভিজ্ঞ ফুটবলার। সবচেয়ে বড় কথা, টিম স্পিরিট ছিল দুর্দান্ত। সবাই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ ছিলাম যেহেতু দেশের মাটিতে টুর্নামেন্ট, শিরোপা জিততেই হবে।

প্রশ্ন:

জর্জ কোটানের অধীনে খেলার অভিজ্ঞতা কেমন ছিল?

আলফাজ: দারুণ কোচ ছিলেন কোটান। পুরো দলের সঙ্গে মিশে গিয়েছিলেন। তিনি আমাদের সবার সমস্যা শুনতেন, সমাধান করার চেষ্টা করতেন। তিনি ছিলেন অনুপ্রেরণাদায়ী কোচ। বিদেশি কোচরা পেশাদার, তাঁরা এখানে চাকরি করতে আসেন। কিন্তু কোটান বাংলাদেশের সাফল্যকে নিজের সাফল্য মনে করেছিলেন। তিনি ফিটনেসের ওপর জোর দিয়েছিলেন। নিশ্চিত করতে চেয়েছিলেন, ম্যাচে পুরো দল যেন ৯০ মিনিট সমানতালে খেলতে পারে।

প্রশ্ন:

আক্রমণভাগে রোকনুজ্জামান কাঞ্চনের সঙ্গে আপনার দুর্দান্ত জুটির রসায়নটা কী ছিল?

আলফাজ: কাঞ্চন আমার চেয়ে একটু ছোট, আমরা ঘরোয়া লিগে একসঙ্গে প্রচুর খেলেছি। দুজনই দুজনকে খুব ভালো জানতাম, বুঝতাম। ২০০৩ সাফে কাঞ্চন খুব ভালো খেলেছিল। ফাইনালে মালদ্বীপের বিপক্ষে ওর গোলেই আমরা এগিয়ে গিয়েছিলাম।

২০০৩ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপ জয়ী বাংলাদেশ দল
ফাইল ছবি
এখন সুযোগ–সুবিধা বেড়েছে। ২০০৩ সালের সাফজয়ী দলে কোনো ফিজিও ছিল না, ট্রেনার ছিল না, আলাদা করে গোলকিপিং কোচ ছিল না। আমরা টুর্নামেন্টের আগে প্রস্তুতি হিসেবে কোনো আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলতে পারিনি।
আলফাজ আহমেদ, জাতীয় দলের সাবেক ফুটবলার
প্রশ্ন:

ফাইনালে টাইব্রেকারের সেই রোমাঞ্চের কথা নিশ্চয়ই মনে আছে...

আলফাজ: মালদ্বীপের বিপক্ষে ফাইনালে আমরাই ভালো খেলেছিলাম। কাঞ্চনের গোলে এগিয়ে গেলেও শেষ পর্যন্ত ওরা গোল শোধ করে দিয়েছিল। তখন বেশ টেনশনে পড়ে গিয়েছিলাম। কিন্তু কোটান সবাইকে উজ্জীবিত রেখেছিলেন। টাইব্রেকারে আমরা আত্মবিশ্বাসী ছিলাম; কারণ, আমরা জানতাম আমাদের আমিনুল আছে।

প্রশ্ন:

২০০৩ সাফ জয়ের পর দেশের ফুটবলে আর কোনো সাফল্য নেই। এটাকে কীভাবে দেখেন?

আলফাজ: ২০ বছর কেটে গেছে। অনেকটা সময়...। আমরা এখনো সাফের গণ্ডিতেই আবদ্ধ। আমরা কিন্তু ২০০৫ সালে পরের সাফেও ফাইনালে খেলে ভারতের কাছে হারি। আমরা সাফল্য পাইনি কারণ আমাদের ফুটবল নিয়ে কোনো পরিকল্পনা নেই, এটাই বাস্তবতা। নতুন তারকা ফুটবলার তৈরি করতে পারিনি। অন্য দেশগুলো নানা ধরনের পরিকল্পনা নিয়ে এগিয়ে গেলেও আমরা পিছিয়েছি। 

২০০৩ সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে মালদ্বীপের বিপক্ষে এগিয়ে যাওয়ার পর বাংলাদেশের খেলোয়াড়দের উল্লাস। ১–১ গোলে ড্র ম্যাচটি শেষ পর্যন্ত টাইব্রেকারে জিতে বাংলাদেশ। ওই একবারই সাফের শিরোপা জিতেছিল বাংলাদেশ।
ফাইল ছবি
প্রশ্ন:

কিন্তু জাতীয় দলের সুযোগ–সুবিধা তো এখন অনেক বেড়েছে...

আলফাজ: এটা ঠিক, এখন সুযোগ–সুবিধা বেড়েছে। ২০০৩ সালের সাফজয়ী দলে কোনো ফিজিও ছিল না, ট্রেনার ছিল না, আলাদা করে গোলকিপিং কোচ ছিল না। আমরা টুর্নামেন্টের আগে প্রস্তুতি হিসেবে কোনো আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলতে পারিনি। এখন প্রতিবছরই আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলে বাংলাদেশ দল।  সুযোগ–সুবিধা বেড়েছে, এটা খুব ভালো খবর। জাতীয় দলের জন্য অন্তত ১০ বছর মেয়াদি একটা পরিকল্পনা তৈরি করা উচিত।

প্রশ্ন:

বর্তমান জাতীয় দলটাকে কেমন দেখছেন?

আলফাজ: দলটা অনেক দিন ধরেই একসঙ্গে আছে। কিন্তু বারবার কোচ বদল হলে দল ক্ষতিগ্রস্ত হয়। গত ১০ বছরে জাতীয় দলে কয়জন কোচ এসেছে একবার দেখুন। খেলোয়াড়েরা নিজেদের সাধ্যমতো লড়াই করে। তবে ওদের সামর্থ্যে ঘাটতি আছে। সবচেয়ে বড় ঘাটতির জায়গা, দলে গোল করার কেউ নেই। আমাদের সময় কাঞ্চন ছিল, মনি (সাইফুর রহমান) ছিল, ওরা গোল করতে পরদর্শী ছিল। তারও আগে নকীব ভাই ছিলেন। রুমি ভাই, আসলাম ভাইয়েরা ছিলেন। অনেক বছর ধরেই গোল করার লোক নেই বাংলাদেশ দলে।

প্রশ্ন:

এলিটা কিংসলি দলে থাকলে কি এর একটা সমাধান হতে পারত?

এলিটাকে বাংলাদেশের সাফের দলে রাখা হয়নি
ছবি : বাফুফে

আলফাজ: কোচ নিশ্চয়ই চিন্তাভাবনা করেই তাঁকে বাদ দিয়েছেন। এখানে কোচই সেরা বিচারক। বাইরে থেকে কিছু বলা ঠিক হবে না। আর এলিটা তো লিগেও পুরো ৯০ মিনিট খেলার সুযোগ পায় না। পুরো ম্যাচ খেলার ফিটনেস তাঁর আছে কি না, তা নিয়ে আমারও সন্দেহ আছে। ৯০ মিনিট খেলার সামর্থ্য না থাকলে কোনো খেলোয়াড়ের পক্ষে আন্তর্জাতিক ম্যাচে নামা কঠিন।

প্রশ্ন:

স্ট্রাইকার তৈরি করতে আপনার পরামর্শ কী?

আলফাজ: আগেও বলেছি, আমাদের ঘরোয়া লিগে প্রতিটি দলই স্ট্রাইকিং পজিশনে বিদেশি খেলোয়াড় নিয়ে আসে। দেশিদের খেলার সুযোগ নেই। তাই খেলোয়াড়েরাও স্ট্রাইকিং পজিশনের জন্য নিজেদের তৈরি করে না। ঘরোয়া ফুটবলে দেশি খেলোয়াড়দের স্ট্রাইকার হওয়ার সুযোগ তৈরি করে দিতে হবে।

প্রশ্ন:

এবারের সাফ ফুটবলে বাংলাদেশ দল নিয়ে আপনার প্রত্যাশা?

আলফাজ: দলের প্রতি আমার শুভ কামনা থাকবে, তারা ভালো করুক। তবে আমাদেরও বাস্তবতা বুঝতে হবে। এবার কুয়েত, লেবাননের মতো দুটি বড় দল আছে সাফে। ভারত তো আছেই। মালদ্বীপও খুব ভালো দল। আমি চাই দল মাঠে নেমে নিজেদের সর্বোচ্চটা দিয়ে লড়াই করুক।