‘তারেক রহমান আমাকে ১ টাকা ২৫ পয়সার বার্গার কিনে খাওয়ান’

খেলোয়াড় পরিচয়েই সবাই তাঁদের চেনেন। কিন্তু সেই পরিচয়ের বাইরে তাঁদের অন্য জীবনটা কেমন? সাবেক ও বর্তমান খেলোয়াড়দের সঙ্গে এই ঝটপট প্রশ্নোত্তর পর্বে সেটাই জানার চেষ্টা—

আজকের তারকা: নিয়াজ মোরশেদ
দাবার দুনিয়া তখনো আজকের মতো এত বিস্তৃত হয়নি। ১৯৮৭ সালে খুলে যায় একটা দুয়ার, উপমহাদেশ পায় প্রথম গ্র্যান্ডমাস্টার। তত দিনে বাংলাদেশের ক্রীড়াঙ্গনে উজ্জ্বল এক তারা হয়ে ওঠেন নিয়াজ মোরশেদ। দাবার বাইরের জীবন নিয়ে তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছেন মাসুদ আলম

প্রথম আলো:

আপনার দাবার বাইরের জীবনটা কেমন?

নিয়াজ মোরশেদ: রান্না করতে ভালো লাগে। আগে ব্যায়াম করতাম, সাঁতার কাটতাম। নিয়মিত জিমে যেতাম। এখন এসব কমে গেছে। গানের প্রতি আগ্রহ আছে। ভাষা শেখার শখ হয়েছে একটু দেরিতে, আমার বড় ছেলেকে দেখে। সে চারটি ভাষা—ফ্রেঞ্চ, স্প্যানিশ, জার্মান, রুশ ভালো পারে। চিন্তা করেছি, ও পারলে আমিও একটু চেষ্টা করে দেখি।

প্রথম আলো:

আপনি কী কী ভাষা জানেন?

নিয়াজ: স্প্যানিশটা চালানোর মতো বলতে পারি! ফ্রেঞ্চ ‘এ টু’ কোর্স করেছি। রুশ ‘এ ওয়ান’ লেভেল পর্যন্ত পারি। তুর্কি ভাষার প্রতিও আমার একটু আগ্রহ জন্মেছে।

ভ্রমণের জন্য নিয়াজের প্রিয় দেশ স্পেন। ছবিতে স্পেনের মেরিদায় তিনি।
নিয়াজের অ্যালবাম থেকে
প্রথম আলো:

আপনি গানও গান। গানের সঙ্গে গাঁটছড়া কীভাবে?

নিয়াজ: (হাসি) ১৯৯১ সালে দাবা অলিম্পিয়াডের পর বসনিয়ার তুজলা শহরে খেলতে যাই। বসনিয়া যুদ্ধের চার মাস আগে কথা। পরে যুদ্ধে গুঁড়িয়ে যায় শহরটা। ওই টুর্নামেন্টে (তুজলা ইন্টারন্যাশনাল) খারাপ শুরু করেও আমি চ্যাম্পিয়ন হয়ে যাই। ওখানেই গানের প্রতি অনুরাগ বাড়ে।

আরও পড়ুন
প্রথম আলো:

কীভাবে?

নিয়াজ: একদিন ডে অফ ছিল। রাতে ডিনারের পর হলরুম থেকে উঁকি দিয়ে দেখি পার্টি চলছে। একটা লোক, লম্বা লম্বা চুল। জিপসি টাইপের চেহারা। উচ্চ স্বরে মিউজিক বাজছে। একটা কলেজের নাকি ফেয়ারওয়েল পার্টি। বুলগেরিয়ার দুজনসহ তিনজন গ্র্যান্ডমাস্টার ছিল আমার সঙ্গে। আয়োজকদের বললাম, আমরা কি গান শুনতে পারি? সেদিন গান শুনে মুগ্ধ হই। মনে হচ্ছিল, বাংলায় গান করছেন।

দুই ছেলেকে নিয়ে স্পেনের জারাগোজায় নিয়াজ
নিয়াজের অ্যালবাম থেকে
প্রথম আলো:

গায়কের নাম কী ছিল?

নিয়াজ: জ্লাদিকো বেবেক। অবিভক্ত যুগোস্লাভিয়ার একসময়ের সেরা গায়ক ছিলেন। তিনি ছিলেন ক্রোয়েশিয়ান। ওনার সঙ্গে হ্যান্ডশেক করলাম। পরদিন একটা দোকানে গিয়ে ওনার অনেকগুলো ক্যাসেট কিনি। গানের ভাষাটা বুঝিনি; কিন্তু সুরটা অনেক সুন্দর ছিল। ওই সুরের ওপর পরে আমি বাংলা কথা বসাই। এই প্রথম আমার মিউজিকে আগ্রহ জন্মাল। এই শখটা আমি কন্টিনিউ করেছি।

প্রথম আলো:

আপনি গানের ক্যাসেটও তো বের করেছিলেন।

নিয়াজ: হ্যাঁ। বেবেকের গানগুলো আর কিছু স্প্যানিশ গান নিয়ে আমি একটা ক্যাসেট বের করি ১৯৯৪ সালে। তখন তো আমার গলা বেশ বেসুরো, এখন কিছুটা হলেও ভালো (হাসি)! আমার ওই একটাই ক্যাসেট বের হয়েছিল। নাম অথচ একদিন। পার্থ বড়ুয়া মিউজিক করেছেন। নকীব ভাই, পিলু ভাই সহায়তা করেন। তখন থেকে একটু-আধটু গিটারও বাজাই।

আরও পড়ুন
প্রথম আলো:

গিটার শেখা কীভাবে?

নিয়াজ: রেনেসাঁর ড্রামার পিলু ভাইয়ের (শাহবাজ আহমেদ) কাছে গিটার শিখেছি।  

ছদ্মনামে প্রকাশিত নিয়াজের কবিতার বই
প্রথম আলো:

আপনার তো কবিতার বইও আছে, তাই না?

নিয়াজ: কবিতার বইও একটাই লিখেছি। নাম মাত্র এক কুড়ি। তবে সেটা নিয়াজ মোরশেদ নামে নয়। আমার নাম উল্টো করে একটা নাম দিই। আপনি যদি লিখতে পারেন, এর চেয়ে দারুণ কিছু আর হয় না। প্রথম আলোয় আমি লিখেছি। লেখালেখিটা অবশ্য আমার কাছে কঠিন মনে হয়েছে। তবে আমার লেখা উচিত, এটা মনে হয়।

প্রথম আলো:

আপনার বই পড়ার অভ্যাসও আছে জানি।

নিয়াজ: ছোটবেলায় রুশ সাহিত্যিক আলেকজান্ডার বেলায়েভের উভচর মানুষ আমার প্রিয় বই। এখনো মনে গেঁথে আছে। দস্তয়েভস্কির প্রায় সব উপন্যাস পড়েছি। তলস্তয় পড়েছি। রাশিয়ান বই অনেক পড়েছি। সম্রাট বাবরের ওপর লেখা বাবর: স্টারি নাইটস বইটিও খুব ভালো লেগেছে। আমার এক উজবেক বন্ধু উপহার দিয়েছেন। তিনি এখন উজবেকিস্তানের পর্যটন বোর্ডের চেয়ারম্যান।

আরও পড়ুন
প্রথম আলো:

শৈশবের প্রিয় স্মৃতি কী?

নিয়াজ: ১৯৭৮ সালে মোহাম্মদ আলী ঢাকায় আসেন, ১২ বছর বয়সে তাঁর সঙ্গে হ্যান্ডশেক করার স্মৃতিটা বেশ স্মরণীয়। স্কুলে অনেক স্মৃতি আছে। ভালো ছাত্র ছিলাম। স্কুলে আমার প্রিয় বিষয় ছিল বাংলা। ঢাকার সেন্ট যোসেফ স্কুলে ফণীন্দ্র বণিক নামে আমাদের এক শিক্ষক ছিলেন। উনি একটা ক্লাস টেস্ট নেন। রামায়ণ ও মহাভারতের ওপর কারক এবং বিভক্তি। আগেই বলে দেন ‘তোমরা কেউ ৫-এর বেশি পাবা না, এটা আমার চ্যালেঞ্জ’। বাকি সবাই ৫-এর কম পেলেও আমি দশে দশ পাই। তখন সম্ভবত নবম বা দশম শ্রেণিতে পড়ি, ঘটনাটি ছোট হলেও আমার মনে তা আত্মবিশ্বাস তৈরি করে। স্কুলজীবনেই আরেকটি ঘটনা আছে, সেটা কি বলব?

প্রথম আলো:

অবশ্যই বলবেন, কী সেটা?

নিয়াজ: ১৯৭৯ সালে জাতীয় দাবায় আমি প্রথম চ্যাম্পিয়ন হওয়ার পর স্কুলে একদিন ছুটি দেওয়া হয়। স্কুলের বাস্কেটবল দলও সে সময় চ্যাম্পিয়ন হয় এক টুর্নামেন্টে। বাস্কেটবল টিম আর আমাকে ডাকে স্কুল কর্তৃপক্ষ। সে সময় ক্লাস সেভেনে পড়ি। তৎকালীন রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের ছেলে তারেক রহমান এইটে পড়েন। মনে আছে, তারেক ভাই তখন আমাকে একটা বার্গার খাওয়ান। দাম ছিল ১ টাকা ২৫ পয়সা।

প্রথম আলো:

কোথায় ঘুরতে ভালো লাগে আপনার?

নিয়াজ: প্রায় ৫০টির মতো দেশে গেছি। সবচেয়ে প্রিয় স্পেন। স্পেনের গ্রানাডা, সেভিয়া, বিলবাও শহরের কথা আলাদাভাবে বলব। আজারবাইজানের বাকু, তুরস্কের ইস্তাম্বুলও বেশ ভালো লেগেছে।

আরও পড়ুন
প্রথম আলো:

ছুটি মিললে কোথায় বেড়াতে যেতে চাইবেন?

নিয়াজ: দক্ষিণ আমেরিকায় কখনো যাইনি। তাই সেখানে যেতে চাইব।

প্রথম আলো:

ঘোরার জন্য স্পেন সবচেয়ে প্রিয় বললেন, কখনো সেখানে ফুটবল ম্যাচ দেখেছেন?

নিয়াজ: না, দেখিনি। সময় হয়নি।

প্রথম আলো:

ফুটবলের প্রতি কোনো আকর্ষণ নেই?

নিয়াজ: অনেক আছে; কিন্তু কোনো কারণে হয়নি। অল্প সময়ের জন্য গেছি। তা ছাড়া ম্যাচের টিকিট কাটতে হয় অনেক আগে।

প্রথম আলো:

বাংলাদেশের কোনো খেলা কি মাঠে বসে দেখেছেন?

নিয়াজ: বাংলাদেশের ক্রিকেটের শুরুর দিকের ম্যাচ দেখেছি। ১৯৭৭ সালে এমসিসি প্রথম আসে। সেই ম্যাচ ঢাকা স্টেডিয়ামে বসে দেখেছি। পরে শ্রীলঙ্কা আসে, সেই ম্যাচও দেখেছি। আর ফুটবল দেখেছি অনেক। তখন তো অনেক ছোট ছিলাম। মোহামেডান–আবাহনীর জোয়ার। কাজী সালাহউদ্দিন ভাই বিরাট তারকা। ১৯৮০ সালে ঢাকা স্টেডিয়ামে ফুটবল ম্যাচ দেখতে গিয়ে পুলিশের হাতে মারও খেয়েছি।

প্রথম আলো:

কোন দলের সমর্থক ছিলেন?

নিয়াজ: আবাহনীর সমর্থক ছিলাম। তবে মজার একটা ঘটনা আছে। ১৯৭৭ সালে দাবা লিগে মোহামেডান থেকে ডাকল আমাকে। আমার বয়স তখন ১১। মোহামেডানের অনেকে জিজ্ঞেস করল, আমি কোন দলের সমর্থক। তখন বলতে হয়েছিল আমি মোহামেডানের সমর্থক (হাসি)। কিন্তু বাস্তবে ছিলাম আবাহনী। ১৯৮০–৮২ সালে বিমানে কাটিয়ে ১৯৮৩ সালে আবার মোহামেডানে যোগ দিলাম। এর পর থেকে মোহামেডানের সমর্থক হয়ে গেলাম।

প্রথম আলো:

সুযোগ এলে কার সঙ্গে দেখা করত চান?

নিয়াজ: রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। সংবাদমাধ্যম তাঁকে অনেক আগ্রাসী হিসেবে তুলে ধরে। আসলে তিনি কেমন, সেটা একটু বুঝতে চাইব।

প্রথম আলো:

কিসে ভয় পান?

নিয়াজ: ভূত। একা থাকলে এবং ভূতের সিনেমা-টিনেমা দেখলে বাতি জ্বালিয়ে ঘুমাই।

প্রথম আলো:

দাবা না খেললে কী করতেন?

নিয়াজ: গায়ক বা মিউজিশিয়ান হতাম।

ভোজন-রসিক নিয়াজ, ভিয়েতনামে
নিয়াজের অ্যালবাম থেকে
প্রথম আলো:

আপনার প্রিয় খাবার কী?

নিয়াজ: খাসির মাথা, ঝাল-ভুনা করে এটা খেতে ভালো লাগে। চায়নিজ স্টার ফ্রাই নিজে রান্না করতে পারি, এটিও আমার বেশ প্রিয়। মোটামুটি সব মাছই খাই। তবে ইলিশটা একটু বেশি ভালো লাগে। মাছের কাঁটা ভালো বাছতে পারি আমি। বড় মাছ হলে মাছের মাথাটা খাই। আমি খাদ্যরসিক বলা যায় (হাসি)।

প্রথম আলো:

প্রিয় গায়ক-গায়িকা কে?

নিয়াজ: অনেকেই আছেন। তবে আবদুল জব্বার ও শাহনাজ রহমতউল্লাহর নাম আগে বলব।

প্রথম আলো:

প্রিয় অভিনেতা-অভিনেত্রী?

নিয়াজ: ববিতা ম্যাডাম অনেক ভালো ভালো সিনেমা করেছেন। দেখতেও খুব সুন্দর ছিলেন তিনি। তাঁকে খুব ভালো লাগত। নায়ক হিসেবে জাফর ইকবাল।

প্রথম আলো:

লটারিতে কোটি টাকা পেলে কী করবেন?

নিয়াজ: হা হা হা...। টাকার অনেক ভালো দিক আছে। টাকা দিয়ে কাছের মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে পারবেন, ভ্রমণ করতে পারবেন। আমি হয়তো কিছু টাকা ভ্রমণে ব্যয় করব।

প্রথম আলো:

জীবন নিয়ে কতটা খুশি?

নিয়াজ: যতটুকু আসতে পেরেছি, ঠিক আছে। জীবন নিয়ে আমি অখুশি নই।

প্রথম আলো:

কিন্তু এই জীবনে কোনো অনুতাপ কি নেই?

নিয়াজ: সিদ্ধান্তের দিক থেকে দুই নৌকায় পা দেওয়া ঠিক হয়নি। পড়ালেখা, খেলাধুলা দুটোই চালিয়েছি আমি। এখন মনে হয়, যেকোনো একটায় মনোযোগ বেশি দিলে আরও ভালো হতে পারত।

মায়ের সঙ্গে ছোটবেলায় নিয়াজ (সবার ডানে), ১৯৭০ সালে মিন্টু রোডে
নিয়াজের অ্যালবাম থেকে
প্রথম আলো:

জীবনে করতে চেয়েছেন কিন্তু পারেননি, এমন কিছু কি আছে?

নিয়াজ: মাকে যদি আরেকটু সময় দিতে পারতাম। মাত্র ৪৭ বছর বয়সে ১৯৯২ সালে তিনি মারা যান। আমার বয়স তখন ২৬। এখন আফসোস হয়, মাকে যদি আরেকটু বেশি সময় দিতাম।

আরও পড়ুন