‘আফগানিস্তান এখনো নিরাপদ নয়’

মাসিহ সাইগানি।ছবি: প্রথম আলো
ডিফেন্ডার হলেও গোল করতে ভালোবাসেন। বাংলাদেশে এই মুহূর্তে খেলা ৫২ জন বিদেশি ফুটবলারের মধ্যে ১০–১১ জন খেলেন রক্ষণে। কিন্তু সবার চেয়ে আলাদা আফগানিস্তানের মাসিহ সাইগানি। আবাহনী লিমিটেডের জার্সিতে এখন পর্যন্ত করেছেন ৯ গোল। বেশ কয়েকটি ম্যাচেই হয়েছেন আকাশি-নীলের জয়ের নায়ক।
সম্প্রতি আবাহনী ক্লাবে বসে প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে মাসিহ শুনিয়েছেন তাঁর জীবনের গল্প—

প্রশ্ন :

আপনার জন্ম কোথায়?

কাবুলে। কাবুলের পরিস্থিতি তখন ছিল খুব খারাপ। যুদ্ধের কারণে বোমা, গুলি ছিল নিত্য ব্যাপার। এসব থেকে পরিত্রাণ পেতে ১৯৮৮ সালে আমরা পুরো পরিবার জার্মানির ফ্রাঙ্কফুর্টে চলে যাই। তখন আমার বয়স মাত্র দুই বছর।

প্রশ্ন :

শৈশব, বেড়ে ওঠা, স্কুল—সবই তাহলে জার্মানিতে...

হ্যাঁ, সবই। আফগানিস্তানে আমার কিছুই নেই। সেখানকার কোনো স্মৃতিও মনে করতে পারি না। আমার বড় তিন ভাইয়ের জন্ম কাবুলেই, ছোট বোনের জার্মানিতে। ফ্রাঙ্কফুর্টে আমাদের নিকটাত্মীয়রা ছিল। ফলে সমস্যা হয়নি। জার্মানিতে জীবনযাত্রা সহজ, স্বাভাবিক ও খুবই ভালো। বিশেষ করে শিশুদের বেড়ে ওঠার জন্য। সবকিছু গোছানো ও পরিকল্পিত। জার্মান ছেলেদের সঙ্গেই পড়ালেখা করেছি। অন্য দেশের ছেলেরাও ছিল।

প্রশ্ন :

বাবা কী করতেন তখন?

বাবা আবদুল হামিদ আফগানিস্তানে চিকিৎসক ছিলেন। মা আইনজীবী। তাঁরা জার্মানি গিয়ে ভিন্ন ভাষা, ভিন্ন সংস্কৃতির মধ্যে পড়ে যান। বাবার পক্ষে চিকিৎসা পেশা চালিয়ে যাওয়া সম্ভব ছিল না। ওখানে গিয়ে তিনি স্মৃতিভ্রষ্ট মানুষদের দেখাশোনার কাজ নেন।

প্রশ্ন :

ফুটবলার হলেন কীভাবে?

আমার বড় তিন ভাই ফুটবল খেলতেন। একদিন বড় ভাই আমাকে বললেন, স্থানীয় একটা ক্লাবে যোগ দিতে। আমি দিলাম। তখন আমার বয়স ১৫ বছর। প্রতিদিন স্কুল থেকে ফিরেই খেলতে যেতাম। আমার খেলার আগ্রহ দেখে উৎসাহ পান ভাই। পরে শহরের বড় একটি ক্লাব আমাকে নেয়। যার নাম মারবুর্গ। তারপর ধাপে ধাপে পঞ্চম, চতুর্থ, তৃতীয় বিভাগ খেলি। চার বছর আগে ভারতের আই লিগের দল আইজল এফসি থেকে প্রস্তাব পাই। সেটিই আমার প্রথম বিদেশে খেলা। তবে এর আগে ২০১৫ সাল থেকে আফগানিস্তান জাতীয় দলে খেলা শুরু করি। নানা সমস্যায় ২০১৮ সালে জাতীয় দল ছেড়ে দিয়েছি। আমি কিন্তু আফগানিস্তান জাতীয় দলের হয়ে প্রথম গোলটা বাংলাদেশের বিপক্ষেই করেছি।

মাসিহ সাইগানি।
ছবি: প্রথম আলো

প্রশ্ন :

সেই গোলের স্মৃতি মনে আছে?

হ্যাঁ, আছে। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে ভারতের কেরালায় সাফ টুর্নামেন্টে করেছিলাম ওই গোল। কর্নার থেকে হেডে দ্বিতীয় পোস্ট দিয়ে বল জালে পাঠাই। ভুটানের বিপক্ষে দ্বিতীয় ম্যাচেও আমি গোল করি। ওই সাফ কাপে আমার দুটি গোল। ফাইনালে আমরা হেরে যাই ভারতের কাছে। ২০১৫ সালের জুনে বিশ্বকাপ বাছাইপর্ব থেকে ২০১৮ পর্যন্ত জাতীয় দলে ১৫টি ম্যাচ খেলেছি। কয়েকটি গোলও করেছি।

প্রশ্ন :

আফগানিস্তান জাতীয় দল ছেড়ে দিয়েছেন বললেন। কেন?

দেখুন, আমরা খুব সফল একটা দল ছিলাম। পিটার সিগ্রাত ছিলেন কোচ। খুব ভালো কোচ, লম্বা চুল। কিন্তু দুর্নীতিগ্রস্ত ফেডারেশন পিটারকে বিদায় করে কোনো কারণ ছাড়াই। তারা কোচ করে ২৯ বছরের এক তরুণকে, যে আগে কোথাও কোচিং করায়নি। সে কখনো পেশাদার কোচ ছিল না। হল্যান্ডের একটি একাডেমির কোচ ছিল। ম্যাচ গড়াপেটার অভিযোগ ছিল দলের ভেতর। এসব কারণে আমি জাতীয় দল ছেড়ে দিই।

প্রশ্ন :

আপনি তো জার্মানিতে ছিলেন। আফগানিস্তানের কোচ আপনাকে কীভাবে খুঁজে পেলেন?

২০১৫ সালে আফগানিস্তান দলের ক্যাম্প হয় জার্মানিতে। তৎকালীন আফগান কোচ সারা বিশ্বের আফগান খেলোয়াড়দের আমন্ত্রণ জানালেন ট্রায়ালে আসতে। আমার বাসার পাশেই ক্যাম্প হওয়ায় আমিও যাই। অন্য অনেকে আসে। সেখান থেকে জাতীয় দলের জন্য তিন থেকে চারজনকে বেছে নেন কোচ। আমাকেও পছন্দ করেন।

প্রশ্ন :

২০১৫ সালের সাফে মামুনুল ছিলেন বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক। ওয়ালী ফয়সাল, সোহেলসহ সেই দলের অনেকে এখন আবাহনীতে আপনার ক্লাব সতীর্থ। বাংলাদেশ জাতীয় দলে তখন আর এখনকার মধ্যে কোনো পার্থক্য খুঁজে পান?

আগের চেয়ে এখন দলটা শক্তিশালী। বাংলাদেশ লিগের মান ওপরের দিকে যাচ্ছে। শুধু আবাহনী বা বসুন্ধরা নয়, চট্টগ্রাম আবাহনী, শেখ রাসেল, শেখ জামাল, সাইফ শক্তিশালী দল। ভালো বিদেশি ফুটবলার, ভালো বিদেশি কোচ আসছে। মতিন মিয়াকে কেউ চিনত না। এখন চেনে। আমাদের নাবিব নেওয়াজ ভালো করছে। সোহেল রানা, সাদরা ভালো ফুটবলার।

প্রশ্ন :

২০১৮-১৯, আবাহনীতে এক মৌসুম খেলেই সাড়া ফেলে দেন। এরপর চলে গিয়েছিলেন কেন?

আমার কিছু বন্ধু ভারতের আইএসএলে খেলেছে। সেখানে সুযোগ–সুবিধা, পরিচিতি সবই ভালো। টাকাও বেশি। আমি দেখতে চেয়েছি, আইএসএলে কেমন করি। তাই চেন্নাইয়িন এএফসির প্রস্তাব পেয়ে না করিনি। ভালো অভিজ্ঞতা হয়েছে। ১২ ম্যাচে ১ গোল করেছি।

প্রশ্ন :

আবাহনীতে ফিরলেন যে আবার...

ভারতে থাকতেই আবাহনীর সঙ্গে যোগাযোগ ছিল। ম্যাচের আগে আমি আবাহনীকে শুভেচ্ছা জানাতাম। ২০১৯ সালটা এই ক্লাবে দারুণ কাটে আমার। একদিন কোচ মারিও লেমোস বললেন, ‘মাসিহ, আমি চাই তুমি আবাহনীতে ফিরে আসো। চেন্নাইয়িনের সঙ্গে আমার এক বছরের চুক্তিও তখন শেষ। কলকাতা মোহামেডানসহ কয়েকটি দলের হয়ে ভারতের আই লিগে খেলার প্রস্তাব পেলেও খেলিনি। জানি, বাংলাদেশের জামাল ভূঁইয়া এখন কলকাতা মোহামেডানের হয়ে আই লিগ খেলছেন। কিন্তু আই লিগটা আকষর্ণীয় মনে হয়নি আমার কাছে। তাই বাংলাদেশে ফিরে আসাটাই ভালো মনে করেছি।

প্রশ্ন :

স্টপার ব্যাক হিসেবে খেলেও এত গোল করেন কীভাবে?

আমি গোল খেতে নই, গোল করতে মাঠে নামি। আবাহনী প্রচুর কর্নার পায়। থ্রো তো আছেই। আমার উচ্চতা (৬ ফুট ২ ইঞ্চি) ও টাইমিং ভালো। কোচ আমাকে বলেন, সেট পিচে যেতে এবং আক্রমণ করতে। কিছু সময় আমি ভাগ্যগুণেও গোল পাই।

মাসিহ সাইগানি।
ছবি: প্রথম আলো

প্রশ্ন :

আবাহনীর হয়ে কোন গোলটি বেশি স্মরণীয়?

সব কটিই। এএফসি কাপে ৩টি, ফেডারেশন কাপে ৩টি, লিগে ২টি ও স্বাধীনতা কাপে ১টি গোল আমার। বেশির ভাগই গুরুত্বপূর্ণ। এএফসি কাপে মানাং মার্সিয়াংদির বিপক্ষে আমার একমাত্র গোলে জয় আসে। চেন্নাইয়িন এফসির বিপক্ষে ফ্রি–কিকে সরাসরি গোলে ২-১–এ এগিয়ে যায় আবাহনী। চেন্নাইয়িন ২-২ করার পর মামুনুলের গোলে ৩-২ জয়। গুয়াহাটিতে মিনার্ভা পাঞ্জাবের বিপক্ষে শেষ গ্রুপ ম্যাচে অতিরিক্ত সময়ে আমার গোলে আবাহনী প্রথমবারের মতো এএফসি কাপের দ্বিতীয় রাউন্ডে ওঠে। ড্র হলে আবাহনী বিদায় নিত। আমার গোলটি ছিল হেডে।

প্রশ্ন :

জার্মান নাগরিকত্ব নিয়েছেন?

৩২ বছর জার্মানিতে বাস করছি, কিন্তু জার্মান হইনি। আফগান পাসপোর্টই ব্যবহার করি। এর সুবিধাও পাচ্ছি। আবাহনীতে আমি খেলছি এশিয়ান কোটায়। ফুটবল ছেড়ে জার্মানির নাগরিকত্ব চাইব। এখন জার্মান পাসপোর্ট নিলে আফগানিস্তানেরটা ছাড়তে হবে।

প্রশ্ন :

আফগানিস্তানে যান?

দুই বছর বয়সে জার্মানি পাড়ি দেওয়ার পর আমার এই ৩৪ বছরের জীবনে কাবুল গিয়েছি মাত্র একবার। সেটিও ২০১৫ সালে সাফ টুর্নামেন্ট খেলার পর। পৃষ্ঠপোষক আমাদের আমন্ত্রণ জানিয়েছিল। মাত্র দুই দিন ছিলাম। এ ছাড়া আর কখনোই যাওয়া হয়নি। আসলে আফগানিস্তান এখনো নিরাপদ নয়। ২০১৫ সাফের পর যখন যাই, তখনো কাবুলে গুলি–বোমার শব্দ শুনেছি। জার্মানি বা অন্য যেখানেই থাকি, টিভি খুললেই আফগানিস্তানের বোমা বিস্ফোরণের খবর। এখনো তালেবানদের লড়াই, এটা–ওটা চলছেই। তাই কাবুল আজও নিরাপদ নয়। তা ছাড়া কাবুলে আমাদের কিছু নেইও এখন আর। মা বলেন, ‘আমরা আর আফগানিস্তানে ফিরে যাব না। আমরা সেখান থেকে চলে এসেছি ছেলেমেয়েদের ভালো জীবনের জন্য।’ কখনো পরিস্থিতি ভালো হলে হয়তো বেড়াতে যাব কাবুলে।

প্রশ্ন :

আপনার আদর্শ কে?

ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো। তাঁর কঠিন পরিশ্রম ও ফুটবলের প্রতি নিবেদন—সবই আকর্ষণীয়।

প্রশ্ন :

বাংলাদেশে কেমন লাগে?

ভালোই। জার্মানির চেয়ে এখানকার জীবন আলাদা বলাই বাহুল্য। রাস্তায় ট্রাফিক বেশি। অনেক মানুষ। এখানকার ঝালযুক্ত খাবারে আমার সমস্যা হয় না। সমস্যা হচ্ছে ব্রাজিলিয়ানদের। আমার রুমমেট বেলফোর্টেরও সমস্যা হয়।

প্রশ্ন :

খেলা না থাকলে কী করেন?

জিম করি। করোনায় দূরে যাওয়ার সুযোগ নেই। সতীর্থ খেলোয়াড়দের সঙ্গে থাকি, গল্প করি।

প্রশ্ন :

খেলা ছেড়ে দেওয়ার পর কী পরিকল্পনা?

যত দিন পারি ফুটবল খেলব। তারপর জার্মানিতে আমার ভাইয়ের সঙ্গে হয়তো ছোটখাটো ব্যবসা শুরু করব। সেটা হতে পারে ছোট কোনো কফিশপ, রেস্টুরেন্ট বা বার। তখন বিয়ের ব্যাপারটাও ভাবব।

প্রশ্ন :

কী মনে হয়, আবাহনী এবার প্রিমিয়ার লিগ জিততে পারবে? সর্বশেষ চারটি টুর্নামেন্টে চ্যাম্পিয়ন কিন্তু বসুন্ধরা কিংস...

অবশ্যই পারবে। আমরা ভালো দল। আমি বিশ্বাস করি না, বসুন্ধরা আমাদের চেয়ে ভালো।