ঢাকা বরাবরই আমাকে আপন করে নিয়েছে

কয়েক দিন আগে পাকির আলী নিজেই ফেসবুকে খবরটা প্রচার করেন। প্রিমিয়ার লিগে বাংলাদেশ পুলিশ ফুটবল দলের কোচ হচ্ছেন তিনি। ঢাকা আবাহনীর হয়ে আশির দশকে সাড়াজাগানো এই শ্রীলঙ্কান ডিফেন্ডার ভালো বাংলা বলতে পারেন, এ দেশকে ভাবেন দ্বিতীয় বাড়ি। আবাহনীতে টানা ১০ বছর খেলে ঢাকায় কোচিংও করিয়েছেন অনেকবার। সব ঠিক থাকলে গত রাত ১১টায় তাঁর ঢাকায় পৌঁছার কথা। কলম্বো থেকে বিমানে ওঠার পর দুপুরে ছিলেন দুবাই বিমানবন্দরে। ফেসবুক মেসেঞ্জারে সেখানে বসেই কথা বললেন প্রথম আলোর সঙ্গে-

প্রশ্ন :

আবারও ঢাকায় আসছেন কোচিং করাতে। অনুভূতি কেমন?

পাকির আলী: অসাধারণ! মনে হয় যেন নিজের দ্বিতীয় বাড়িতে যাচ্ছি। আত্মীয়তার বন্ধন অনুভব করি বাংলাদেশের সঙ্গে। বাংলাদেশের মানুষের ভালোবাসা আর আতিথেয়তাই আমাকে বেশি টানে। ঢাকা বরাবরই আমাকে আপন করে নিয়েছে। এত ভালোবাসা পাব, কখনো ভাবিনি।

অনেকগুলো মৌসুম আবাহনীর জার্সি গায়ে খেলেছেন পাকির আলী। ছবিটি ১৯৮৮ মৌসুমের। সেবার আবাহনীর অধিনায়ক ছিলেন এই শ্রীলঙ্কান।
ছবি: সংগৃহীত

প্রশ্ন :

কিন্তু কোচের চাকরি তো ইংল্যান্ডের বৃষ্টির মতো। এই আছে এই নেই! সেই অনিশ্চয়তার কথাও নিশ্চয়ই ভুলে যাচ্ছেন না...

পাকির আলী: ভুলছি না। তবে বন্ধু, শুভানুধ্যায়ী-সবার কাছে আমি পাকির আলী ছিলাম ও আছি। এই জায়গায় কোনো পরিবর্তন হবে না আশা করি (হাসি)।

প্রশ্ন :

বাংলাদেশ পুলিশ দল গত মৌসুমে শীর্ষ ফুটবলে উঠে আসে অনেক বছর পর। তাদের সঙ্গে চুক্তি কি হয়ে গেছে?

পাকির আলী: এখনো হয়নি। আগে তো যাই। তারপর স্বাক্ষর হবে।

প্রশ্ন :

এর আগে ঢাকায় পিডব্লিউডি, মোহামেডান, আবাহনী ও শেখ জামালের কোচ ছিলেন। এবার পঞ্চম দলের দায়িত্ব নিতে যাচ্ছেন। নতুন দিনের পরিকল্পনা কী?

পাকির আলী: পুলিশ দল সম্পর্কে অল্পবিস্তর জেনেছি। বিস্তারিত জেনে ও দেখে পরিকল্পনা সাজাব।

ঢাকার ফুটবলে পাকির আলী (লাফিয়ে হেড করছেন)। ছবিটি ১৯৮৩ সালের।
ছবি: সংগৃহীত

প্রশ্ন :

বাংলাদেশের ঘরোয়া ফুটবল নিয়ে খোঁজখবর রাখেন এখন?

পাকির আলী: কিছু তো রাখিই। বাংলাদেশ লিগে প্রতিদ্বন্দ্বিতা বেড়েছে। বসুন্ধরা কিংস ভালো করছে। আমার পুরোনো দল আবাহনী তো আছেই।

প্রশ্ন :

ঢাকায় সর্বশেষ ২০১১ সালে শেখ জামালের কোচ হিসেবে আপনার অভিজ্ঞতা ভালো ছিল না। আগস্টে সুপার কাপের সেমিফাইনালে মোহামেডানের কাছে ৪-২ গোলে হারের পর বিদায়। মাত্র কয়েক দিন ছিলেন ক্লাবটিতে। খুব কষ্ট নিয়ে ফিরে যান তখন...

পাকির আলী: হ্যাঁ, কষ্ট পাই তখন। কোচের জীবনই এমন। কখনো ভালো, কখনো খারাপ। তবে আমি ভালোটাই মনে রাখি বেশি।

প্রশ্ন :

ওই সময় ফেসবুকে স্ট্যাটাসে লিখেছিলেন, দল জিতলে কোচ দুনিয়ার সেরা হয়ে যান। আর খেলোয়াড়দের নেতিবাচক মানসিকতার কারণে হারলে বিশ্বের সবচেয়ে বাজে মানুষ হয়ে যান কোচ। মনে আছে?

পাকির আলী: মনে আছে। তখন বলেছিলাম, বাংলাদেশের ফুটবল এগিয়ে নিতে হলে ক্লাব কর্মকর্তা ও খেলোয়াড়দের এ ধরনের চিন্তাভাবনা থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। কর্মকর্তা ও খেলোয়াড়দের কোচের মতামতকেই প্রাধান্য দেওয়া উচিত।

আশির দশকে ঢাকায় পাকির আলী।
ছবি: সংগৃহীত

প্রশ্ন :

পুলিশ দলে সেটা পাবেন মনে করেন?

পাকির আলী: অবশ্যই। তারা কোচের মতামতকে সম্মান করবে।

প্রশ্ন :

একটু পেছনে ফেরা যাক। আপনি ১৯৭৯ সালে ঢাকায় প্রথম আসেন প্রেসিডেন্টস গোল্ডকাপে...

পাকির আলী: হ্যাঁ, হারুন ভাই (আবাহনীর প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক হারুনুর রশিদ) তখন আবাহনীর জন্য আমাকে ঠিক করেন। কিন্তু আবাহনীর সঙ্গে ভুল-বোঝাবুঝিতে সে বছর আমি ভারতের গোয়ায় ভাস্কো স্পোর্টসে খেলতে চলে যাই। খবর পেয়ে আবাহনীর তৎকালীন সভাপতি শামসুল ইসলাম খান, হারুন ভাইয়েরা গোয়া থেকে আমাকে নিয়ে আসেন। সম্ভবত এটা ১৯৮১ সালের কথা।

প্রশ্ন :

আবাহনীতে প্রথম দিনেই আপনার মজার এক অভিজ্ঞতা হয়েছিল। যেটা আপনি আগেও বলেছেন। মনে আছে?

পাকির আলী: হ্যাঁ, প্রথম রাতে আবাহনীর ডাইনিংয়ে ডিনার করতে বসলাম। নানি, মানে বুয়া রান্না করে টেবিলে বসে বললেন, ‘নিন, মুরগি খান।’ আমি তো মুরগি কী, জানি না। নানিকে বললাম, এটা কি চিকেন? কিন্তু তিনি তো ইংরেজি জানেন না। শেষ পর্যন্ত আমি নানিকে কক কক শব্দ করে বোঝালাম এটা চিকেন কি না? নানি তখন বুঝলেন ব্যাপারটা। এ নিয়ে তখন কী যে হাসাহাসি!

ঢাকাকে চিরদিনই তাঁর কাছে আপন।
ছবি: সংগৃহীত

প্রশ্ন :

আপনার আগে শ্রীলঙ্কান ফুটবলার লায়নেল পিরিচ, সিডি সিরিসেনা, নূর ঢাকায় খেলতে আসেন। আপনার পর অশোকা রবীন্দ্র, চন্দ্রসিঁড়ি, প্রেমলালরা আসেন। এরপর এই ধারাটা বন্ধ হয়ে গেল কেন?

পাকির আলী: (কিছুক্ষণ ভেবে) আরও কয়েকজন এসেছিলেন। গোলরক্ষক হাশিম উদ্দিন, মাহেন্দ্রপালা, জহিরের নামও আসবে। এখন বাংলাদেশের ক্লাবগুলো হয়তো শ্রীলঙ্কায় তেমন খেলোয়াড় খুঁজে পায় না।

প্রশ্ন :

আবাহনীর সংগঠক আহমেদ সাজ্জাদুল আলমের বাসায় রোজ যেতেন আপনি। একদিন সকালে গেলে তিনি আপনাকে মজা করে জিজ্ঞাসা করেন, ‘রনি (পাকির আলীর ডাক নাম), নাশতা খাইছ?’ আপনি মাথাটা এমনভাবে ঝাঁকালেন যে তিনি ধরে নেন খাননি। কিন্তু আপনি মাথাটা দুই দিকে ঘুরিয়ে বোঝাতে চেয়েছিলেন খেয়েছেন। কতটা মিস করেন সেই সব দিন?

পাকির আলী: অনেক মিস করি। ববিকে (আহমেদ সাজ্জাদুল আলম) ভাঙা ভাঙা বাংলায় বলতাম, ‘বনদু, চালে এসো আমার বাসায়।’ আবাহনী ক্লাবের উল্টো দিকে বাসা নিয়েছিলাম একসময়।

প্রশ্ন :

১৯৮২ সালে আবাহনীর চার খেলোয়াড়ের জেলে যাওয়ার ঘটনায় আপনাকেও ধরে নেয় পুলিশ।

পাকির আলী: অশোকা, আমাকেসহ আবাহনীর খেলোয়াড়দের ভ্যানে উঠিয়েছিল পুলিশ। গাদাগাদি করে রেখেছিল। সে ছিল ভয়ংকর এক স্মৃতি। ঢাকায় শ্রীলঙ্কান হাইকমিশনের লোকজন এসে অশোকা ও আমাকে ছাড়িয়ে নেন (হাসি)।