‘পশ্চিম এশিয়ার চেয়ে বাংলাদেশের লিগ ভালো ছিল’

সবাই ধরে নিয়েছিলেন টানা পঞ্চমবার ঢাকা প্রথম বিভাগ লিগে সর্বোচ্চ গোলদাতা হতে যাচ্ছেন আবাহনীর শেখ আসলাম। কিন্তু কিসের কী! দুই হ্যাটট্রিকে ২৪ গোল করে ১৯৮৮ সালের ঢাকা প্রথম বিভাগ লিগে বাংলাদেশের ফুটবল ইতিহাসে প্রথম বিদেশি হিসেবে সর্বোচ্চ গোলদাতা হন মোহামেডানের ইরানি ফুটবলার ভিজেন তাহিরি। নাসের হেজাজির হাত ধরে বাংলাদেশের ঘরোয়া ফুটবলে এক মৌসুম খেলেই আলো কেড়ে নেওয়া এই স্ট্রাইকার সম্প্রতি ইরান থেকে হোয়াটসঅ্যাপে প্রথম আলোকে বলেছেন বাংলাদেশের সেই সময়ের ফুটবলের কথা-

প্রশ্ন :

বাংলাদেশের নাম শুনলে এখন সবার আগে কী মনে পড়ে?

ভিজেন তাহিরি: বাংলাদেশ আমার জীবনের একটি অংশ। বাংলাদেশের মানুষের কথা অনেক মনে পড়ে। মোহামেডানের হয়ে খেলার স্মৃতি জড়িয়ে আছে আমার জীবনে। গোলের পর সমর্থকদের উৎসাহ আমাকে খুব আনন্দ দিত। রাস্তায় বের হলে মানুষ চিনত, ভালোবাসত। মোহামেডানের হয়ে লিগ শিরোপা জয় ছিল অসাধারণ।

প্রশ্ন :

মোহামেডানের খোঁজখবর রাখেন?

তাহিরি: অবশ্যই। বাংলাদেশে পড়াশোনা করা ইরানের ছাত্রছাত্রীদের কাছে মোহামেডানের কথা জিজ্ঞাসা করি। আমার পরিচিত ইরানের একজন অভিজ্ঞ ডাক্তার দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে আছেন। তাঁর সঙ্গে যোগাযোগ হলে তাঁর কাছ থেকেই মোহামেডান ও বাংলাদেশের ফুটবলের কথা শুনি। কিন্তু কোনো ভালো খবর শুনতে পাই না বলে কষ্ট পাই।

প্রশ্ন :

মোহামেডানের জার্সিতে কলকাতার একটি টুর্নামেন্ট দিয়ে শুরু। এরপর তো বাংলাদেশের ফুটবলে দাপটের সঙ্গেই খেলেছেন। ফেডারেশন কাপে সর্বোচ্চ গোলদাতা। প্রথম বিভাগ ফুটবল লিগে ২১ ম্যাচে দুই হ্যাটট্রিকে করেছিলেন ২৪ গোল...

তাহিরি: নাসের হেজাজি যখন আমাকে বাংলাদেশে খেলার প্রস্তাব দেন, তখনই বলেছিলেন, তুমি সেখানে সেরা গোলদাতা হওয়ার যোগ্যতা রাখো। সেই লক্ষ্য নিয়েই বাংলাদেশে গিয়েছিলাম। ২৪ গোল করে প্রথম বিদেশি খেলোয়াড় হিসেবে লিগে সর্বোচ্চ গোলদাতা হওয়াটা ছিল আমার জন্য গৌরবের। তবে মোহামেডানে খেলা সাবেক ফুটবলার সালাম মুর্শেদীর ২৭ গোলের রেকর্ডটা ভাঙতে পারিনি। কলকাতার টুর্নামেন্ট, ফেডারেশন কাপ, লিগ, এশিয়ান ক্লাব কাপ মিলিয়ে মনে হয় ৩৪ গোল করেছিলাম।

প্রশ্ন :

মোহামেডানের জার্সিতে কোন গোলটিকে এগিয়ে রাখবেন?

তাহিরি: এশিয়ান ক্লাব চ্যাম্পিয়নশিপে কাতারের আল সাদের বিপক্ষে ২-২ গোলে ড্র করা ম্যাচের গোলটিই সেরা। এশিয়ান ক্লাব চ্যাম্পিয়নশিপে পিরুজির বিপক্ষে গোলটিকেও সেরা হিসেবে রাখতে হবে।

১৯৮৮–৮৯ মৌসুমে মোহামেডান দলের সঙ্গে ভিজেন তাহিরি। (দাঁড়ানো বাঁ দিক দিয়ে তৃতীয়)

প্রশ্ন :

বাংলাদেশে আপনার সাফল্যের রেসিপি কী ছিল?

তাহিরি: হেজাজির অধীন আমরা দারুণ একটি দল হয়ে উঠেছিলাম। দলে বেশ কয়েকজন ভালো মিডফিল্ডার ছিলেন। তাঁরা ভালো গোলের সুযোগ তৈরি করে দিতেন আর আমি গোল করতাম। বিশেষ করে সাব্বিরের (রুম্মন বিন ওয়ালি সাব্বির) কথা বলব। তিনি খুবই উঁচু মানের ফুটবলার ছিলেন। তাঁর সঙ্গে আমার বোঝাপড়া ছিল দারুণ। খুব ভালো বলের জোগান দিতেন। আমি তো মনে করি, ওই সময়ে মধ্যপ্রাচ্যের লিগে খেলার যোগ্যতা ছিল সাব্বিরের।

প্রশ্ন :

আপনার জীবনে হেজাজির গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা আছে। তাঁর হাত ধরেই মোহামেডানে খেলা। দুজন একসঙ্গে হলে মোহামেডান নিয়ে কথা হতো?

তাহিরি: তিনি আমার বন্ধু, বড় ভাই ও পরামর্শক ছিলেন। তাঁর জন্যই আমার বাংলাদেশে যাওয়া। ২০১১ সালে হেজাজি মারা যাওয়ার আগের দিন আমি তাঁকে হাসপাতালে দেখতে গিয়েছিলাম। হাসপাতালেও সেদিন আমরা মোহামেডান নিয়ে গল্প করেছি।

১৯৮৮ ফেডারেশন কাপের ফাইনালে আবাহনীর বিপক্ষে ভিজেন তাহিরি।
সংগৃহীত ছবি

প্রশ্ন :

আপনি নিজেও তো এখন কোচ...

তাহিরি: গত দুই বছর ইসতেগলালের (ইরান প্রিমিয়ার লিগের শীর্ষ পর্যায়ের ক্লাব) সহকারী কোচ ছিলাম। এই মৌসুমে সাইপা এফসির (ইরান প্রিমিয়ার লিগের ক্লাব) প্রধান কোচের দায়িত্ব পেয়েছি।

প্রশ্ন :

আপনার ওপর ভরসা রাখতে না পেরে ইস্ট বেঙ্গল থেকে নাইজেরিয়ার স্ট্রাইকার চিমা ওকেরিকে এনেছিল মোহামেডান। এটাকে কীভাবে নিয়েছিলেন?

তাহিরি: আমার সঙ্গে আগে থেকেই নাইজেরিয়ান এমেকা (ইউজিগো) ছিল। চিমাকে আনা হয় পরে। আফ্রিকান ফুটবলারদের গায়ে শুধু শক্তিই আছে, বুদ্ধি তেমন নেই। আমি তাদের চেয়ে অনেক বেশি বুদ্ধিমান খেলোয়াড় ছিলাম এবং গোল করাতেও ছিলাম দক্ষ।

প্রশ্ন :

বাংলাদেশের কোনো ডিফেন্ডারের বিপক্ষে খেলতে কষ্ট হতো?

তাহিরি: অনেক ভালো ভালো ডিফেন্ডার ছিল। আমি সব সময় প্রতিপক্ষ ডিফেন্ডারদের দুর্বলতা কাজে লাগাতাম। যদিও প্রতিপক্ষ কোনো ডিফেন্ডারদের নাম মনে করতে পারছি না। তবে আমাদের নিজের দলের মন্টুর (প্রয়াত আহসানউল্লাহ) বিপক্ষে খেলা কঠিন ছিল।

প্রশ্ন :

বাংলাদেশের লিগের মান তখন কেমন ছিল?

তাহিরি: পশ্চিম এশিয়ার দেশগুলোর চেয়ে বাংলাদেশের লিগ ভালো ছিল। তবে বাংলাদেশের চেয়ে পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর লিগের মান আরও উন্নত ছিল।

প্রশ্ন :

মোহামেডানে কোচিং করার প্রস্তাব পেলে আসবেন?

তাহিরি: মোহামেডানের কোচ হয়ে বাংলাদেশে আসতে পারলে খুবই আনন্দিত হব। নাসের হেজাজির মতো হয়ে মোহামেডানের সম্মান ফিরিয়ে আনতে চাই।