‘বল সেদিন আমার কথা শুনছিল’

জিম্বাবুয়ের অধিনায়ক টাটেন্ডা টাইবুর নিঃসঙ্গ লড়াই থেমেছিল ১৫৩ রানে। ঢাকা টেস্টে বাংলাদেশের জয়ের স্বপ্নটা ফিকে হয়ে যায় তাঁর ওই এক ইনিংসেই। কিন্তু ড্রয়ের সুযোগ তখনো ছিল। আর ঢাকা টেস্টে ড্র মানেই প্রথমবারের মতো টেস্ট সিরিজ জিতবে বাংলাদেশ দল। চট্টগ্রামে প্রথম টেস্টটা যে জিতেছিল বাংলাদেশই!

২০০৫ সালের আজকের এই দিনেই ড্রয়ের জন্য মাটি কামড়ে ব্যাটিং করেছিলেন নাফিস ইকবাল, জাভেদ ওমর, রাজিন সালেহরা। বাংলাদেশ সেদিন হারেনি। ড্র করে প্রথমবারের মতো পায় টেস্ট সিরিজ জয়ের স্বাদ। জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে সেই ঐতিহাসিক টেস্ট সিরিজের মূল নায়ক ছিলেন বাঁহাতি স্পিনার এনামুল হক জুনিয়র। চট্টগ্রামের দ্বিতীয় ইনিংসে ৬ উইকেট, ঢাকায় প্রথম ইনিংসে ৭ উইকেটের পর দ্বিতীয় ইনিংসে নেন আরও ৫ উইকেট। বাংলাদেশের প্রথম টেস্ট সিরিজ জয়ের ম্যাচে তিনিই হয়েছিলেন ম্যান অব দ্য সিরিজ। প্রথম আলোকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে সেই ঐতিহাসিক সিরিজের গল্প শুনিয়েছেন এনামুল—

প্রশ্ন :

দ্বিতীয় টেস্টে প্রথম বাংলাদেশি হিসেবে টেস্টে ১০ উইকেট পান। এর আগে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটেও কখনো এক ম্যাচে ১০ উইকেট পাননি। আপনার উদ্‌যাপনটা কেমন ছিল?

এনামুল: কোনো উদ্‌যাপন হয়নি। যা হয়েছে ম্যাচের শেষে। চতুর্থ দিন শেষে আমরা ড্রয়ের জন্য খেলছিলাম। খেলা শেষে যা হয়েছে, সেটা ছিল স্বপ্নের মতো। আমি মনে হয় একটা ঘোরের মধ্যে ছিলাম। প্রধানমন্ত্রীর সংবর্ধনা, সিলেটে ফেরার পর সংবর্ধনা—এখন বিশ্বকাপ জিতলে যেমন উদ্‌যাপন হয়, প্রথম টেস্ট সিরিজ জয়ের পর দেশের অবস্থাটা তেমনই ছিল।

প্রশ্ন :

তখন কি বুঝতে পারছিলেন কত বড় অর্জন ছিল সেটি?

এনামুল: আমি বয়সে অনেক তরুণ ছিলাম। এখন পেছন ফিরে তাকালে অন্য রকম লাগলেও তখন সবকিছু স্বাভাবিক লেগেছিল। শুনতে হাস্যকর লাগবে। কিন্তু আমার কাছে বিশেষ কিছু মনে হয়নি। হয়তোবা বয়স কম ছিল, ক্রিকেট নিয়ে অত গভীরভাবে চিন্তা করিনি। কিন্তু এখন মনে হয় যে ঢাকা টেস্টের দুই ইনিংস মিলিয়ে ১২ উইকেট বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে অনেক বড় অর্জন ছিল। তখন মনে হয়েছে সিরিজ জিতেছি, আমি টেস্ট সিরিজের সেরা খেলোয়াড় ছিলাম—এই তো!

প্রশ্ন :

আপনি রাতারাতি খ্যাতির শীর্ষে পৌঁছে যান সিরিজ জেতানো পারফরম্যান্স দিয়ে...

এনামুল: আমার মনে হয়, আমি বাংলাদেশ ক্রিকেটকে এক ধাপ এগিয়ে যেতে সাহায্য করেছি। তখন অনেকেই আমার অ্যাকশন নকল করতে চাইত। এখনো অনেকে আমার অ্যাকশন নকল করতে চায়। বিশেষ কিছু ছিল আমার অ্যাকশনে, যা তাদের আকৃষ্ট করত। যারা বাঁহাতি স্পিন করত, তারা অনেকেই আমার মতো বোলিং করতে চাইত। আমি হয়তো বেশি টেস্ট খেলিনি। তবে আমার মনে হয়, ২০০৫ সালে বাংলাদেশকে বিশ্বের কাছে অন্য রকমভাবে চেনাতে পেরেছি।

প্রশ্ন :

সেই সিরিজে আপনার বোলিং যেকোনো বাঁহাতি স্পিনারের জন্য অনুকরণীয় ছিল। তখন নিশ্চয়ই খুব বেশি বিশ্লেষণ করা হয়নি। এখন যখন সেই সিরিজের বোলিং দেখেন, কী মনে হয়?

এনামুল: অনেকে আমার বোলিং উদাহরণ হিসেবে দেখায়। আমি টেনিস বলেও বাঁহাতি স্পিন করতাম। ফ্লাইট, বল ঘোরানো আমার মূল অস্ত্র। মনে আছে, টেস্ট ম্যাচ খেলার পর এক ভেন্যু থেকে আরেক ভেন্যুতে যাওয়ার পথে ইংল্যান্ডের গ্রাহাম থ্রর্প আমার পাশে বসেছিল। সে বলছিল, সে নাকি আমার মতো কম বয়সী কাউকে বল এত ঘোরাতে দেখেনি। একবার শ্রীলঙ্কার সঙ্গে খেলার সময় মুরলি বলেছিলেন, ‘এই ছেলেটা তোমাদের অনেক ম্যাচ জেতাবে।’ দুর্ভাগ্যজনকভাবে সেটা হয়নি। খুব বেশি টেস্ট খেলা হয়নি আমার। আমার হয়তো মেন্টরের অভাব ছিল। কেউ যদি ধরিয়ে দিতেন যে ‘২০০৫ সালে তুমি এভাবে বোলিং করতে, এখন এভাবে করছ...।’ তাহলে হয়তো টিকে থাকা আরও সহজ হতো। প্রতিবছরই দেখা যেত আমার অ্যাকশন পরিবর্তন হচ্ছে। আগের অ্যাকশন আর এখনকার অ্যাকশনে অনেক পার্থক্য। আমাকে দেখিয়ে দেওয়ার কেউ ছিল না।

প্রশ্ন :

২০০৫ সালের সেই সিরিজটাই কি ঘরের মাঠে বাংলাদেশকে আরও আত্মবিশ্বাসী দলে পরিণত করে?

এনামুল: হ্যাঁ, জিম্বাবুয়ের মতো দলের বিপক্ষে আমরা ঘরের মাঠে হারব না—এই মানসিকতা তৈরি হয়েছিল সেই সিরিজ থেকেই। তখন আমাদের সঙ্গে সমানে সমানে ছিল জিম্বাবুয়ে। তাদের সঙ্গে আমরা ঘরের কন্ডিশনে জিতব—এই আত্মবিশ্বাস চলে আসে সবার মধ্যে।

প্রশ্ন :

বাংলাদেশের বোলিং আক্রমণ তখন অনেকটাই বাঁহাতি স্পিননির্ভর ছিল। এখন অতটা নয়। আপনি পার্থক্যটা কীভাবে দেখেন?

এনামুল: এখন তো বাঁহাতি স্পিনার নেই। জাতীয় দলের কোচ চন্ডিকা হাথুরুসিংহের বিতৃষ্ণা ছিল বাঁহাতি স্পিনের প্রতি। তখনই এটা নষ্ট হয়ে গেছে। আমরা পারফরমার ছিলাম, কিন্তু আমাদের খেলায়নি। এরপর যেই বিরতিটা চলে আসে, সেখান থেকে আর বের হতে পারেনি বাংলাদেশের ক্রিকেট। এখন আর কেউ আসছে না। অতিমাত্রায় টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটও দায়ী। লেগ স্পিনার চাই আমরা এখন টি-টোয়েন্টির জন্য। টি-টোয়েন্টিতে লেগ স্পিন খুব কার্যকর। কিন্তু টেস্ট জিততে হলে আপনার বাঁহাতি স্পিন এবং অফ স্পিন লাগবে। সেই নিয়ন্ত্রণ লাগবে, যা লেগ স্পিনে সাধারণত থাকে না। টি-টোয়েন্টি খেললে আপনার অ্যাকুরেসি কমতে বাধ্য। সাকিব ক্যারিয়ারের শুরুতে যতটা অ্যাকুরেট ছিল, এখন তেমন নয়। আপনি টি-টোয়েন্টিতে অ্যাকুরেট হলে মার খাবেন। এক জায়গায় বল করলে মারবেই। উল্টাপাল্টা জায়গায় বল করতে হবে টি-টোয়েন্টিতে, যা টেস্ট ম্যাচে কাজে আসবে না। সবকিছু মিলিয়েই আজ এই আবস্থা।