‘চাঁদে অবতরণ’ নাদালের

ফ্রেঞ্চ ওপেনের শিরোপা নিয়ে লকার রুমে রাফায়েল নাদাল।ছবি: এএফপি

বছরটা এমন যে কোনো কিছুই স্বাভাবিক না। লাল দুর্গে অবশ্য এসব খাটেনি। রোঁলা গাঁরোয় ১০২তম ম্যাচে এসে ১০০তম জয়, ১৩তম শিরোপা—রাফায়েল নাদাল পরশু আবারও প্রমাণ করলেন ফ্রেঞ্চ ওপেনের লাল মাটি তাঁর রাজপাট। সেটিও এমনভাবে, ফাইনাল দেখে মনে হয়েছে, ৩৪ বছরের ‘এল ম্যাটাডোর’ যেন ফিরে গিয়েছিলেন কুড়ি বছর বয়সে! একটা গেম জিততে ৫৪ মিনিট লেগেছে সার্বিয়ান ‘জোকার’-এর। অন্য প্রান্তে ১২টি শিরোপা আর ৯৯ জয়ের পর নাদাল জমা করে রেখেছিলেন ক্যারিয়ারের অন্যতম সেরা পারফরম্যান্স।

তাতে ফলটা দাঁড়ায় ৬-০, ৬-২, ৭-৫। ক্যারিয়ারে এর আগে বড় টুর্নামেন্টের ফাইনালে কখনো কোনো সেটে ‘হোয়াইটওয়াশ’ হননি জোকাভোচি। নাদালের কারণে পরশু তাঁকে এ অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে। আর স্প্যানিশ কিংবদন্তি টের পেয়েছেন রজার ফেদেরারের অনুভূতি—২০তম গ্র্যান্ডস্লাম শিরোপাজয়ের স্বাদ। ওপেন যুগে প্রথম পুরুষ খেলোয়াড় হিসেবে কোনো সেট না হেরে চারটি গ্র্যান্ডস্লাম জয়ের নজিরও গড়লেন নাদাল—এবার লাল দুর্গের মুকুট জিতে। এই বয়সে মায়োর্কানের ফর্ম দেখে সমর্থকেরা আশা করতেই পারেন, রোঁলা গাঁরো থেকে আরও দু-চারটে শিরোপা তিনি তুলে নিতে পারেন।

ক্যারিয়ারের সেরা ফাইনালটাই যেন খেললেন তিনি ১৩তম ফ্রেঞ্চ ওপেন জয়ের পথে।
ছবি: এএফপি

ইতিহাসে কেউ এক টুর্নামেন্ট ১৩ বার জিততে পারেননি। এখন তো মনে হচ্ছে নাদালের জন্য ১৫ বার জেতাও অস্বাভাবিক কিছু না! অন্তত যত দিন ফ্রেঞ্চ ওপেনের খেলোয়াড় তালিকায় তাঁর নাম থাকবে, তাঁকে ফেবারিট ভেবে নিতেই হবে। এবার কোর্টে দাঁড়িয়েই বলেছেন, ‘রোঁলা গাঁরো আমার কাছে সবকিছু। টেনিস ক্যারিয়ারের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময় এখানে কাটিয়েছি।’ সে তো বটেই। কিন্তু নাদালের এই অর্জন ঠিক কোথায় মানানসই? খেলার এমন সব রেকর্ড, যা কখনো ভাঙবে না বলে মনে করা হয়—ইসনার ও মাহুতের ১১ ঘণ্টার ম্যাচ কিংবা (১৯৮৪) ভিকি নেলসন-জ্যাঁ হেপনারের ৬৪৩ শটের র‌্যালি—তাতে নাদালের অর্জন শোভা পাবে কোথায়?

টেনিসে এমন কীর্তি কম নেই। কাদা মাটির কোর্টে ক্রিস এভার্টের টানা ১২৫ জয়, ১৯৮৮ সালে স্টেফি গ্রাফের গোল্ডেন স্লাম, রড লেভারের দুটি ক্যালেন্ডার গ্র্যান্ডস্লাম কিংবা ইস্থার ভের্জারের ১৬২ একক ও ১৩৪ ডাবলস হুইলচেয়ার টেনিস শিরোপা জয়—এসব এমন অর্জন যা কখনো কেউ ছুঁতে পারবে না বলে মনে করা হয়। যেমন ধরুন অলিম্পিকে মাইকেল ফেলপসের ২৩ পদক, বব বিমনের ৮.৯ মিটারের লং জাম্প, উসাইন বোল্টের স্প্রিন্ট রেকর্ড, ১৩ বছর বয়সে অলিম্পিক ডাইভিংয়ে মারোয়ি গেস্ট্রিংয়ের সোনা জয়। বাস্কেটবলে উইল্ট চেম্বারলিনের ১৯৬২ সালে ম্যাচপ্রতি গড়ে ৫০.৪ পয়েন্ট, সে বছরই তাঁর এক ম্যাচে ১০০ পয়েন্ট অর্জন, আইস হকিতে ওয়েন গ্রেটেৎজকির এক মৌসুমে ২১৫ পয়েন্ট ও ৯২ গোল, ২৮৫৭ ক্যারিয়ার পয়েন্ট কিংবা ফুটবলে পেলের তিন বিশ্বকাপজয়, ৯২ হ্যাটট্রিক, বক্সিংয়ে রকি মার্সিয়ানোর একমাত্র হেভিওয়েট চ্যাম্পিয়ন হিসেবে ৪৯-০ ব্যবধানে অপরাজিত থেকে ক্যারিয়ার শেষ করা, গলফে ১৯৯৭ সালে টাইগার উডসের ১২ স্ট্রোকে ইউএস ওপেন জয়, স্কোয়াশ কিংবদন্তি জাহাঙ্গির খানের ১০ বার ব্রিটিশ ওপেন জয়, ক্রিকেটে ডন ব্রাডম্যানের ৯৯.৯৪ গড়—ফ্রেঞ্চ ওপেনে নাদালের কীর্তি তাঁদের এসব অর্জনের পাশেই শোভা পাবে।

ফ্রেঞ্চ ওপেনের কিংবদন্তি হিসেবে আগেই জায়গা পাকা করেছেন নাদাল। ছবি: এএফপি
ছবি: এএফপি

কারণ, ওই লাল দুর্গে আর কেউ-ই সম্ভবত নাদালের এই অর্জন ধরতে পারবে না। অবশ্যই নাদাল তো এখনই থামছেন না। এই ‘১৩’ শেষ পর্যন্ত কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় কে জানে! তবুও কেউ তাঁকে তাঁর রাজপাটে ধরতে চাইলে সেখানে শিরোপা জিততে হবে ক্যারিয়ারের শুরু থেকে। এই ধরুন ২০-২১ বছর বয়স থেকে। মনে আছে, নাদাল এই টুর্নামেন্ট জেতা শুরু করেছিলেন যখন, ফেসবুক প্রাথমিক পর্যায়ে, টুইটার তখনো ব্যবসায়িক পরিকল্পনা। এটিপির পেজে তাই লেখা হয়েছে নাদালের এই অর্জন খেলাধুলার জন্য ‘চাঁদে অবতরণ’-এর মতোই বিষয়। নাদাল যে অসম্ভব লিখে চলছেন!