প্রতিবাদী ওসাকা ও হার না মানা থিম

২০২০ ইউএস ওপেনের ট্রফি হাতে জাপানের নাওমি ওসাকা ও অস্ট্রিয়ার ডমিনিক থিমছবি: ইউএস ওপেন

দুজনের মধ্যে দৃশ্যত কোনো সাদৃশ্য নেই।


অস্ট্রিয়ার ডমিনিক থিমের বয়স ২৭ বছর। জাপানের নাওমি ওসাকার ২২। সাফল্যের সিঁড়ি বেয়ে তরতরিয়ে শিখরে ওঠা প্রতিযোগী ওসাকা। আর পোড় খাওয়া এক খেলোয়াড় থিম! তিনটি গ্র্যান্ড স্লাম ফাইনালে খেলে যেখানে তিনবারই শিরোপা জিতেছেন ওসাকা, সেখানে থিম প্রথম ইউএস ওপেন জিতলেন তিন তিনটি গ্র্যান্ড স্লাম ফাইনালে ব্যথর্তার পর।


এত সব বৈসাদৃশ্যের মধ্যেও একটা সাদৃশ্য খুঁজে পাওয়া যায় তাঁদের মানসিকতায়। সব প্রতিবন্ধকতা মাড়িয়ে লক্ষ্য পৌঁছার ইস্পতসম দৃঢ়তায় দুজনেই এক শতে এক শ!

দুই সেট পিছিয়ে পড়েও প্রত্যাবর্তনের অসাধারণ গল্প লিখে প্রথম গ্র্যান্ড স্লাম জিতলেন থিম। ইউএস ওপেনের ফাইনালে জভেরভকে হারিয়ে দেওয়ার পর
ছবি: রয়টার্স

পেশাদার সার্কিটে থিমের মধ্যে যা বেশি দৃশ্যমান! ক্যারিয়ার শুরু সেই ২০১১ সালে। এর তিন বছর পর থেকেই গ্র্যান্ড স্লামে অংশ নেওয়া। এবার ইউএস ওপেনে ট্রফি জয়ের আগে মাঝের ছয় বছর গ্র্যান্ড স্লামে থেকেছেন ট্রফি শূন্য। এটা অবশ্য তেমন লম্বা সময় নয়। প্রথম শিরোপা হাতে তোলার আগে অ্যান্ডি মারের মতো তারকাকেও অপেক্ষা করতে হয়েছে আট বছর। আর গ্র্যান্ড স্লাম ট্রফি ছুঁয়ে দেখার স্বপ্ন তো কারও কারও ক্যারিয়ারে স্বপ্নই থেকে গেছে।

সুইডেনের রবিন সোডারলিংয়ের কথাই ধরা যাক না। বড় বড় তারকাকে হারানোর কারণে ‘দৈত্য-ঘাতক’ পরিচিতি পেয়ে গিয়েছিলেন। ক্লে কোর্টের রাজা রাফায়েল নাদালকে ফ্রেঞ্চ ওপেনে প্রথম হারের স্বাদ পাইয়ে পাইয়ে দেওয়া প্রথম খেলোয়াড় তিনিই। দুই বার গ্র্যান্ড স্লামের ফাইনালেও খেলেছেন। কিন্তু শিরোপা না জেতার আক্ষেপ নিয়েই ২০১৫ সালে বিদায় জানিয়েছেন টেনিসকে। কিন্তু থিম নিজের ওপর আস্থা হারাননি কখনোই।

থিমের (ডানে) হাতে উঠল এবার বড় ট্রফিটাই
ছবি: রয়টার্স

রজার ফেদেরার, রাফায়েল নাদাল ও নোভাক জোকোভিচের কাছে হেরে বারবার গ্র্যান্ড স্লাম শিরোপার স্বপ্ন ভেস্তে যাওয়ায় মারে একবার বলেই ফেলেছিলেন—‘আমার হয়তো গ্র্যান্ড স্লাম ট্রফি জেতাই হবে না!’ কিন্তু কখনোই এমন ভাবনা পেয়ে বসেনি থিমকে। উল্টো ২০১৮ সালে গ্র্যান্ড স্লামের প্রথম ফাইনালে নাদালের কাছে হারার পর থেকেই অস্ট্রিয়ান তারকার মধ্যে জন্ম নেয় ‘একদিন আমিও জিতব’ আত্মবিশ্বাস। যার কথা করোনাকালের ইউএস ওপেনে খেলতে এসে জানিয়েছেন থিম। ফাইনালে জার্মানির আলেক্সান্দার জভেরভের মুখোমুখি হওয়ার আগে বলে বসেন, ‘যেদিন থেকে বুঝতে পেরেছি, বিশেষ করে ২০১৮ সালের ফ্রেঞ্চ ওপেনের ফাইনালের পর থেকে—গ্র্যান্ড স্লাম শিরোপা জয় আমার পক্ষে সম্ভব, সেদিন থেকেই এটাই আমার সবচেয়ে বড় লক্ষ্য।’ যে লক্ষ্য তিনি পূরণ করলেন জভেরভকে হারিয়ে। তাও কিনা প্রথম দুই সেটে পিছিয়ে পড়ার পর! টিভি সেটের সামনে থাকা সবাই যখন ধরেই নিয়েছিলেন থিমের এবারও হলো না, ঠিক তখনই ঘুরে দাঁড়ালেন তিনি। প্রত্যাবর্তনের গল্প লিখে পরের তিনটি সেট জিতে হলেন চ্যাম্পিয়ন।

২০০৪ সালে ফ্রেঞ্চ ওপেনে আর্জেন্টিনার গাস্তন গাউদিওর পর এবারই প্রথম দুই সেটে পিছিয়ে পড়া প্রথম প্রতিযোগী হিসেবে জিতলেন গ্র্যান্ড স্লাম শিরোপা। আর ফ্লাশিং মিডোর হিসাব করলে ফিরে যেতে হবে ৭১ বছর পেছনে। ১৯৪৯ সালে প্রথম দুই সেটে ১৬-১৮, ২-৬ গেমে পিছয়ে পড়ার পর যুক্তরাষ্ট্রের পাঞ্চো গঞ্জালেস শিরোপা জিতেছিলেন পরের তিন সেট ৬-১, ৬-২, ৬-৪ গেমে স্বদেশি টেড শ্রোডারকে হারিয়ে।

ফেদেরার, নাদাল, জোকোভিচের বিপক্ষে থিমের জয়-পরাজয়ের রেকর্ড ৩-০, ২-১ ও ২-২!

এটা ঠিক, চোটের কারণে রজার ফেদেরার, করোনা সতর্কতায় রাফায়েল নাদালের অংশ না নেওয়া এবং বল দিয়ে লাইন জাজকে আঘাত করে নোভাক জোকোভিচ ‘অযোগ্য’ হয়ে যাওয়ায় শিরোপার পথটা থিমের জন্য কিছুটা মসৃণই হয়েছে। তবে এতে তাঁর কৃতিত্বকে খাট করে দেখার কিছু নেই। আর ২০১৯ সাল থেকে টেনিসের এই বড় তিনের বিপক্ষে তাঁর যে রেকর্ড, সেটাও কিন্তু ফেদেরার-নাদাল-জোকোভিচদের বিপক্ষে থিমকে ‘সেয়ানা’ প্রতিপক্ষ হিসেবেই মেলে ধরে! গত বছর থেকে টেনিসের ‘বড় তিন’-এর বিপক্ষে ১০ বার মুখোমুখি হয়েছেন থিম। সাতবারই জিতেছেন! এই সময়ে ফেদেরার, নাদাল, জোকোভিচের বিপক্ষে তাঁর জয়-পরাজয়ের রেকর্ড ৩-০, ২-১ ও ২-২! এটা সম্ভব হয়েছে নিজকে নিয়ে আত্মবিশ্বাস আর হারার আগেই হার না মানার মানসিকতার কারণে।

কোর্টে থিমের মতো কঠিন পরীক্ষায় অবশ্য খুব কমই পড়তে হয়েছে নাওমি ওসাকাকে। কিন্তু তাঁর লড়াকু মানসিকতার পরিচয় পাওয়া যায় অন্যখানে। আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গদের নিপীড়নের বিরুদ্ধে তাঁর প্রতিবাদে। প্রতিবাদের ধরনে।


তিন বছর বয়সে পরিবারের সঙ্গে আমেরিকায় গিয়ে সেখানেই থিতু হওয়া ওসাকার। বড় হয়ে ওঠার পথে দেখেছেন কীভাবে কৃষ্ণাঙ্গরা অন্যায় অবিচারের শিকার। গায়ের রঙ কালো বলে তারা উপেক্ষা-বঞ্চনার শিকার। এত দিন তুষের আগুনের মতো যা জ্বালিয়েছে তাঁকে, এবার সেটাকেই সামনে এসেছেন ওসাকা। ইউএস ওপেনের প্রস্তুতিমূলক টুর্নামেন্ট সাউদার্ন অ্যান্ড ওয়েস্টার্ন ওপেনের সেমিফাইনালে উঠে আমেরিকায় কৃষ্ণাঙ্গ নিপীড়নের প্রতিবাদে টুর্নামেন্ট বর্জনের ঘোষণা দিয়েছিলেন। পরে অবশ্য সিদ্ধান্ত থেকে সরে এসেছিলেন। কিন্তু সে টুর্নামেন্টে যে প্রতিবাদের শুরু করেছিলেন, ওসাকা সেটিকে টেনে নিয়ে গিয়েছিলেন ইউএস ওপেনেও।

ওসাকার সাফল্যে জাপানি শুধু জাপানিরাই নন, খুশি বর্ণবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার যুক্তরাষ্ট্রের সব শ্রেণির মানুষও
ছবি: রয়টার্স

স্বাস্থ্য বিধি মেনে ইউএস ওপেনে মাস্ক পরে কোর্টে ঢোকার নির্দেশনা ছিল সব প্রতিযোগীদের। আর সবার মতো ওসাকাও মাস্ক পরে এসেছিলেন। সবার চেয়ে ওসাকার মাস্কটি ছিল আলাদা। তাঁর একেক মাস্কে লেখা ছিল আমেরিকান প্রশাসনের অবিচারের শিকার হওয়া একেক কৃষ্ণাঙ্গ নাগরিকের নাম। প্রথম রাউন্ড থেকে ফাইনাল পর্যন্ত সাতটি ম্যাচ খেলেছেন ওসাকা। প্রত্যেকটি ম্যাচেই হতভাগ্য কোনো না কোনো কৃষ্ণাঙ্গের নাম খচিত মাস্ক পরে এসেছেন। সাম্প্রতিক যাঁর মৃত্যুকে ঘিরে সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে ‘ব্ল্যাক লাইভস ম্যাটার’ আন্দোলন, সেই জর্জ ফ্লয়েডের নাম ছাড়াও ওসাকাা কোনো না কোনো  ব্রিয়োনা টেলর, এলাইজা ম্যাক্লেইন, আহমদ আরবারি, ত্রেভোন মারটিন, ফিলান্ডো কাস্টাইলের নাম খচিত মাস্ক পরেছেন।

প্রতিবাদের ভাষা যখন মাস্ক। ইউএস ওপেনের সাত ম্যাচে অংশ নেওয়ার আগে বর্ণবৈষম্যের শিকার ৭ কৃষ্ণাঙ্গের নাম খচিত মাস্ক পরে বর্ণবাদের বিরুদ্ধে লড়াই ওসাকার
ছবি : রয়টার্স

প্রতিবাদের মঞ্চ হিসেবে কেন এই ইউএস ওপেনকেই বেছে নেওয়া? তাঁর মাস্কে এই সব নামগুলো দেখে তাঁদের নিয়ে মানুষ আরও আগ্রহী হবে। ইন্টারনেটে সার্চ দিয়ে তাঁদের সম্পর্কে খোঁজ খবর নেবে। উঠে আসবে তাঁদের ওপর নিপীড়নের গল্প। বণর্বাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হবে আরও বেশি মানুষ। এই আশাতেই ওসাকার অভিনব প্রতিবাদ।

আর এই প্রতিবাদী ওসাকার মধ্যে কেউ কেউ খুঁজে পাচ্ছেন কিংবদন্তি জেসি ওয়েন্সকে।
১৯৩৬ সালের বার্লিন অলিম্পিকে ১০০ মিটার স্প্রিন্ট ও লং জাম্পে জার্মান স্বৈর শাসক অ্যাডলফ হিটলার শ্বেতাঙ্গ কোনো প্রতিযোগীকে, বিশেষ করে দুই জার্মান অ্যাথলেট এরিক বোর্চমায়ার এবং লুজ লংকে চ্যাম্পিয়ন দেখতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাঁকে আশাহত করে এই দুই ইভেন্টে শিরোপা জেতেন কিংবদন্তি অ্যাথলেট জেসি ওয়েন্স। কালো চামড়ার ওয়েন্সের এই বিজয় মেনে নিতে পারেননি হিটলার। তাই দুটি ইভেন্ট শেষে একবারও ওয়েন্সের সঙ্গে হাত মেলাননি হিটলার। লং জাম্প ও ১০০ মিটার স্প্রিন্টের বাইরেও ২০০ মিটার ও ৪* ১০০ মিটারেও সোনা জিতেছিলেন ওয়েন্স। এই দুটি ইভেন্টে গড়েছিলেন বিশ্ব রেকর্ডও। সে অলিম্পিকে তাঁর এই সাফল্যকে কৃষ্ণাঙ্গ মানুষের হয়ে কিংবদন্তি অ্যাাথলেটের প্রতিবাদ, উপেক্ষা-অবজ্ঞার জবাব ধরা হয়ে থাকে।

বাস্তবে ওসাকা যা করছেন তা ওয়েন্সের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আমি তো তাকে জাপানের জেসি ওয়েন্সই মনে করি
বায়ে ম্যাকনিল

বিশ্বজুড়ে কৃষ্ণাঙ্গের নির্যাতনের প্রতিবাদে এবার ইউএস ওপেনের মঞ্চ ব্যবহারে ওসাকার মধ্যেও ওয়েন্সের সেই প্রতিবাদী চরিত্রটি দেখছেন কেউ কেউ। জাপানের আফ্রো-আমেরিকান লেখক বায়ে ম্যাকনিল তাঁদেরই একজন। বলছেন, ‘সে এমন একটি দলে যোগ দিয়েছে যাদের আছে ইতিহাস রয়েছে। আছে ঐতিহ্য। যার শিকড় বিস্তৃত জেসি ওয়েন্স পর্যন্ত। বাস্তবে ওসাকা যা করছেন তা ওয়েন্সের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ। আমি তো তাকে জাপানের জেসি ওয়েন্সই মনে করি।


হার না মানা জেসি ওয়েন্সের সেই মানসিকতাটাই যেন নাওমি ওসাকার! টেনিস কোর্টে সেটা ডমিনিক থিমেরও।