ফ্রেঞ্চ ওপেনের চমক ‘মেড বাই বাংলাদেশি হ্যান্ড’

ঝেং কিনওয়েনের সঙ্গে আখতার হোসেনসৌজন্য ছবি

‘উই আর প্রাউড স্যার।...ইয়োর বিল্ডিং, মাই কান্ট্রি সিমেন্ট। উই আর প্রাউড স্যার।’

কথাগুলো জনপ্রিয় একটি বাংলা বিজ্ঞাপন থেকে নেওয়া। আসলে বিদেশের মাটিতে বাংলাদেশের তৈরি কোনো পণ্য দেখলে যেকোনো বাংলাদেশিরই গর্ব হয়। একটু ভিন্ন কারণে বাংলাদেশের সাবেক টেনিস তারকা আখতার হোসেনকে নিয়ে গর্ব অনুভব করতেই পারেন এ দেশের মানুষ।

তাঁর হাতে বেড়ে ওঠা চীনের টেনিস খেলোয়াড় ঝেং কিনওয়েন যে আলো ছড়াচ্ছেন ফ্রেঞ্চ ওপেনে। প্রথমবারের মতো ক্লে কোর্টে খেলতে গিয়ে ১৯ বছর বয়সী ‘মেড বাই বাংলাদেশি হ্যান্ড’ পৌঁছে গিয়েছেন মেয়েদের এককের চতুর্থ রাউন্ডে।

বাংলাদেশের সাবেক টেনিস তারকা আখতারের হাতে বেড়ে ওঠা কিনওয়েন সবচেয়ে বড় ক্যারিশমাটা দেখিয়েছেন দ্বিতীয় রাউন্ডে। সেখানে তিনি হারিয়ে দিয়েছেন মেয়েদের টেনিসের সাবেক এক নম্বর খেলোয়াড় রোমানিয়ান টেনিস তারকা সিমোনা হালেপকে।

টেনিস বিশ্বে শিরোনাম হয়ে ওঠা কিনওয়েনের কুঁড়ি থেকে ফুল হয়ে ওঠার গল্পটা লেখা হয়েছে আখতারের হাতে। সে গল্পটা শুনলে অনায়াসে বলা যেতে পারে ‘চীনা কিনওয়েন মেড বাই বাংলাদেশ’।

ঝেং কিনওয়েনের সঙ্গে আখতার হোসেন
সৌজন্য ছবি

২০০০ ও ২০০১ সালে জাতীয় টেনিসে চ্যাম্পিয়ন হওয়া আখতারের স্বপ্ন ছিল আন্তর্জাতিক টেনিস তারকা হবেন। বিকেএসপির এই প্রাক্তন ছাত্র খেলেছিলেন ডেভিস কাপেও। কিন্তু বাংলাদেশের টেনিসের প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে এখান থেকে টেনিস তারকা হওয়ার স্বপ্ন দেখা অনেকটা ‘ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে কোটি টাকার স্বপ্ন দেখা’র মতো বিষয়।

তবু স্বপ্ন বলে কথা। মানুষ তো তাঁর স্বপ্নের সমানই বড়। ২০০৫ সালে চীনের বেইজিংয়ের পোটার্স হুইল একাডেমির আমন্ত্রণে তিন মাসের চুক্তিতে চীনে পাড়ি জমিয়েছিলেন আখতার।

চুক্তি অনুযায়ী সেখানে নিজেও অনুশীলন করবেন, পাশাপাশি বাচ্চাদেরও করাবেন অনুশীলন। আখতারের খেলোয়াড়ি সামর্থ্য দেখে একাডেমি কর্তৃপক্ষ বুঝে যায় খেলোয়াড় হিসেবে খুব বেশি দূর যাওয়ার সামর্থ্য আর তাঁর নেই।

ফ্রেঞ্চ ওপেনে আলো ছড়াচ্ছেন ঝেং কিনওয়েন
ছবি: এএফপি

শৃঙ্খলা ও নিবেদিত হওয়ায় প্রতিষ্ঠানটি আখতারকে পছন্দ করে তাদের ভবিষ্যতের কোচ হিসেবে। কোচ হওয়ার জন্য আখতারকে প্রস্তাবও দেয় তারা। আখতারেরও দরকার ছিল একটি ভবিষ্যৎ গড়ার জায়গা। সুযোগ পেয়ে তাদের অধীনেই কোচিং ডিপ্লোমা করে খেলোয়াড় তৈরির কাজ শুরু।

একাডেমিটির সঙ্গে দুই বছর কাজ করার পরে অন্যত্র পাড়ি জমান আখতার। তিন বছর পর ২০১০ সালে আবার সেই একাডেমিতে ফিরে আসেন তিনি। এরই মধ্যে ২০১০ সালে পোটার্স হুইলের সঙ্গে জাস্টিন হেনিনের পাঁচ বছরের অংশীদারি চুক্তি হলে একাডেমির নাম হয় জাস্টিন হেনিন একাডেমি।

২০১৩ সালে এই একাডেমিতে এসে পরীক্ষা দিয়ে উতরে গিয়ে ২০১৮ সাল পর্যন্ত এখানেই বেড়ে ওঠা কিনওয়েনের। প্রথম দুই বছর পুরোপুরি আখতারের অধীনেই করেছেন অনুশীলন। আজ যে সেমি ওয়েস্টার্ন গ্রিপে র‍্যাকেট ধরে থাকেন কিনওয়েন, সেটি আখতারেরই ঠিক করে দেওয়া।

বেইজিং থেকে ফোনে ৯ বছর আগের স্মৃতিচারণা করলেন আখতার, ‘ও যখন আমাদের এখানে আসে এক্সটিম ওয়েস্টার্ন গ্রিপে খেলতে, তখন ওপরের বলে ভালো খেলতে পারলেও নিচের বলে দুর্বলতা ছিল। আমার মনে হলো ও সেমি ওয়েস্টার্ন গ্রিপে ভালো করবে। ওর সঙ্গে আলোচনা করলে ও সম্মতি দেয়।

ঝেং কিনওয়েন
ছবি: এএফপি

আমিও একাডেমির প্রধান কোচ কার্লোস রদ্রিগেজকে ডেকে এনে ওর খেলা দেখিয়ে পরিবর্তনের ভাবনাটা বলি। তিনিও আমার কথায় রাজি হয়ে যান। পরে শুধু গ্রিপ ঠিক করার জন্যই পাঁচ সপ্তাহ কাজ করেছিলাম আমি।’

পরে কিনওয়েনকে তিনবার যুক্তরাষ্ট্রে নিয়ে গেছেন বয়সভিত্তিক ‘অরেঞ্জ বল এডি হার্ড টুর্নামেন্ট’ খেলাতে। ২০১৪ সালে অনূর্ধ্ব-১২ সেই টুর্নামেন্টে সেমিফাইনালে, ২০১৫ সালে অনূর্ধ্ব-১৫ বিভাগে কোয়ার্টার ফাইনালে ওঠেন কিনওয়েন। পরের বছর অনূর্ধ্ব-১৫ বিভাগে রানার্সআপ। তখন থেকেই বোঝা যাচ্ছিল ভবিষ্যতের তারকা হতে যাচ্ছেন কিনওয়েন।

২০১৮ সালের শেষের দিক থেকে পেশাদার খেলোয়াড় হয়ে ওঠায় ব্যস্ততা বাড়ে কিনওয়েনের। ব্যক্তিগত পৃষ্ঠপোষক প্রতিষ্ঠান আইএমজি তাঁকে যুক্তরাষ্ট্রে অনুশীলনের ব্যবস্থা করে দেয়। এরপর খেলা ছাড়া সেখানেই অনুশীলন করে থাকেন।

এরই মধ্যে পোটার্স হুইল একাডেমি ছেড়ে আখতার এখন আরটিজি একাডেমির কোচ। তবু পুরোনো কোচ ও ছাত্রী কিনওয়েনের যোগাযোগটা এখনো আছে। এখনো মাঝেমধ্যে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ‘উই চ্যাটে’ যোগাযোগ করে থাকেন আখতারের সঙ্গে।

ঝেং কিনওয়েনের সঙ্গে আখতার হোসেন
ছবি: সংগৃহীত

শিষ্য বড় খেলোয়াড় হওয়ায় আখতারেও গর্ব, ‘আমার কোচিংয়ের প্রথম কোনো খেলোয়াড় ফ্রেঞ্চ ওপেনে খেলল। কোচ হিসেবে এটাই তো আমার গর্ব। এখন মাত্র ১৯ বছর বয়স। ও যদি কোনো ধরনের চোটে না পড়ে, তাহলে বিশ্বের অন্যতম সেরা খেলোয়াড় হওয়ার সামর্থ্য রাখে ও।’

সেটা হতে পারলে তো বাংলাদেশের জন্যও আনন্দের। চীনের এই তারকা খেলোয়াড় যে ‘মেড বাই বাংলাদেশি হ্যান্ড’।