‘আমার শুধু হরমোনের সমস্যা’ 

লিঙ্গ-পরিচয় বিতর্ক এড়িয়ে শুধু খেলার মাঠেই নজর দিতে চান বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর অ্যাথলেট জান্নাত বেগমছবি: প্রথম আলো

অ্যাথলেটিকসে লিঙ্গ–বিতর্কের কথা উঠলেই সবার আগে মনে পড়ে দক্ষিণ আফ্রিকান দৌড়বিদ কেস্টার সেমেনিয়ার কথা। পুরুষ, না মহিলা—এই বিতর্কের জেরে ট্র্যাকের বাইরে থাকতে হয়েছে ভারতীয় স্প্রিন্টার দ্যুতি চাঁদকেও। শেষ পর্যন্ত আন্তর্জাতিক ক্রীড়া আদালতে গিয়ে মামলা জিতে আবার ট্র্যাকে নামার অনুমতি পান দ্যুতি। এবার একই বিতর্কে তোলপাড় বাংলাদেশের অ্যাথলেটিকস। জাতীয় সামার অ্যাথলেটিকসে পরশু মেয়েদের জ্যাভলিন থ্রোয়ে আখেরুন নেসার ২৫ বছরের পুরোনো রেকর্ড ভেঙেছেন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর জান্নাত বেগম। যদিও তাঁকে তৃতীয় লিঙ্গের প্রতিনিধি হিসেবে অভিযোগ করে ফেডারেশনে চিঠি দিয়েছেন আখেরুন। পরীক্ষার মাধ্যমে এই অ্যাথলেটের লিঙ্গ নির্ধারণ করে রেকর্ডটি পুনর্বিবেচনার অনুরোধও করেছেন। এ নিয়ে জান্নাত বেগম কথা বলেছেন প্রথম আলোর সঙ্গে—     

প্রশ্ন:

প্রশ্ন: জ্যাভলিনে ২৫ বছরের পুরোনো জাতীয় রেকর্ড ভেঙে কেমন লাগছে?

জান্নাত বেগম: নতুন রেকর্ড গড়তে পেরে খুশি হয়েছি। আগের রেকর্ডটা ভাঙার ইচ্ছা ছিল অনেক দিন থেকেই। শেষ পর্যন্ত পেরেছি বলে ভালো লাগছে।

প্রশ্ন:

প্রশ্ন: আপনার গড়া রেকর্ড নিয়ে সাবেক অ্যাথলেট আখেরুন নেসা অভিযোগ করেছেন। শুনেছেন নিশ্চয়ই? 

জান্নাত: আমি তাঁর অভিযোগটা শুনেছি। কিন্তু আমাকে অ্যাথলেটিকস ফেডারেশন অনুমতি দিয়েছে বলেই খেলতে এসেছি। সেক্রেটারি স্যার (আবদুর রকিব) ফোনে বলেছেন, ‘তুমি খেলতে আসবে। কোনো সমস্যা হবে না।’ এখন আখেরুন আপা কিছু বললেই কি আর আমার রেকর্ড মুছে যাবে? 

প্রশ্ন:

প্রশ্ন: এর আগে ২০১৯ সালে জাতীয় অ্যাথলেটিকসে আপনি জ্যাভলিন থ্রোয়ে সোনা জিতলেও পদকটা তো বাতিল করা হয়েছিল।

জান্নাত: পদক বাতিল করা হয়েছিল কি না, তা জানা নেই। তবে আমার পদক বাড়িতেই আছে। সার্টিফিকেটও আছে।

যাঁর রেকর্ড ভেঙেছেন, সেই আখেরুনের সঙ্গে জান্নাত (বাঁয়ে)
ছবি: প্রথম আলো
প্রশ্ন:

প্রশ্ন: তাহলে ফেডারেশন পরের বছর আপনাকে বাংলাদেশ গেমস ও জাতীয় অ্যাথলেটিকসে অংশ নিতে দেয়নি কেন?

জান্নাত: তখন স্যাররা বলেছিলেন, তুমি আপাতত খেলতে পারবে না। তাঁরা জানিয়েছিলেন, আমার হরমোন ও টেস্টোস্টোরেন পরীক্ষার রিপোর্ট হাতে পাওয়ার পর খেলার অনুমতি দেবেন। এ জন্য অপেক্ষা করতে বলেছিলেন।

প্রশ্ন:

প্রশ্ন: সেই রিপোর্ট কি পেয়েছেন?

জান্নাত: সেটা ফেডারেশনে আছে। তবে স্যাররা আমার জাতীয় পরিচয়পত্র এবং একাডেমিক সার্টিফিকেটে নারী প্রমাণ পাওয়ার পর এখানে খেলার অনুমতি দিয়েছেন।

প্রশ্ন:

প্রশ্ন: আপনার কণ্ঠস্বর পুরুষদের মতো, এটার কারণ কী?

জান্নাত: হরমোন সমস্যার কারণে এমনটা হয়েছে। ডাক্তার বলেছেন, চিকিৎসা করালে ভালো হয়ে যাব। সেনাবাহিনীর স্যাররা বলেছেন, আমার চিকিৎসা করাবেন। এরপর সেনাবাহিনীতে চাকরি দেবেন। 

বর্ষা নিক্ষেপ করছেন জান্নাত বেগম
ছবি: সংগৃহীত
প্রশ্ন:

প্রশ্ন: খেলার সময় বা ক্যাম্পে কোনো নেতিবাচক কথা শুনতে হয়? 

জান্নাত: মানুষ তো বলবেই। আমি যেভাবে জন্মেছি, সেই সমস্যা তো আমার না। এখানে আমার কিছু করার নেই। আমার শুধু হরমোনের সমস্যা। তবে পাছে লোকে কিছু বললেও আমি সেটা মনে রাখি না। যারা নেতিবাচক বলার, তারা বলবেই।

প্রশ্ন:

প্রশ্ন: ভারতীয় অ্যাথলেট দ্যুতি চাঁদকেও আপনার মতো সমস্যায় পড়তে হয়েছিল। এটা কি জানেন?

জান্নাত: তাঁর নাম শুনেছি আমি। বিতর্কের কারণে তাঁর ক্যারিয়ার হুমকির মুখে পড়েছিল। তবে তিনি কিন্তু ঠিকই ফিরে এসেছিলেন নিজেকে প্রমাণ করে। আমাদের ফেডারেশনের স্যাররাও ইতিবাচকভাবে সবকিছু করছেন। এতে আমার মনোবল বেড়ে গেছে। আমার লক্ষ্যে আমি এগিয়ে যেতে চাই।  

প্রশ্ন:

প্রশ্ন: আপনার এই সমস্যা নিয়ে পরিবারের কেউ কিছু বলে?

জান্নাত: না। পরিবারের সবাই জানে আমার হরমোনের সমস্যা আছে।

প্রশ্ন:

প্রশ্ন: আপনি পড়াশোনা করেছেন কোথায়? স্কুল ও কলেজে কোনো সমস্যা হয়েছে?

জান্নাত: আমি কিশোরগঞ্জের রাজ্জাকুন্নেছা পাইলট বালিকা বিদ্যালয় ও কলেজ থেকে উচ্চমাধ্যমিক পাস করেছি। এবার স্নাতকে ভর্তি হয়েছি বাজিতপুর সরকারি কলেজে। আমার শিক্ষক ও বান্ধবীদের কেউই কখনো এসব নিয়ে প্রশ্ন তোলেনি। 

জিম করছেন জান্নাত বেগম
ছবি: সংগৃহীত
প্রশ্ন:

প্রশ্ন: আপনি কীভাবে খেলাধুলায় এলেন?

জান্নাত: জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের প্রতিভা অন্বেষণ কর্মসূচির অধীনে কাবাডি দলে সুযোগ পাই। শিলা ম্যাডাম (জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কারপ্রাপ্ত সাইক্লিস্ট ফারহানা সুলতানা) আমাকে কাবাডি খেলায় আনেন। তিনি ঢাকায় তাঁর বাড়িতে রেখে অনুশীলন করার সুযোগ করে দেন। ওখানেও কিছু মানুষ ম্যাডামকে বলত, কাকে রেখেছ? ওরা নোংরা মন্তব্য করত। তবে এসব শুনেও কখনো হাল ছাড়িনি। ভেঙে পড়িনি। আমার ক্যারিয়ারে অনেক বাধা এসেছে। এসব শুনে একটু কষ্ট পেয়েছি। জেদ ছিল, বড় কিছু অর্জন করে ওদের দেখিয়ে দেব। এবার দেশের জন্য কিছু একটা করতে চাই। যেহেতু একটা ভালো ফল করেছি, এবার এসএ গেমসে পদক জিততে চাই।

প্রশ্ন:

প্রশ্ন: পরিবার থেকে কোনো বাধা পেয়েছেন?

জান্নাত: আমরা তিন বোন, দুই ভাই। খুব দরিদ্র পরিবারে বেড়ে উঠেছি। বাবা অন্যের জমিতে কৃষিকাজ করেন। যখন কাজ থাকে না, বাবা বাদাম বিক্রি করেন। আমি খেলাধুলা করে যে টাকা পাই, সবটাই মায়ের হাতে তুলে দিই। এ জন্য আমাকে কখনো খেলতে বাধা দেয়নি কেউ। সবাই আমাকে ভালোবাসে।