চলে গেলেন ফুটবলার জহিরুল হক

জহিরুল হক (৫ জানুয়ারি ১৯৩৫–৬ জানুয়ারি ২০২৪)প্রথম আলো

হৃদ্‌যন্ত্রের সমস্যা নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন দুই দিন আগে। কিন্তু আর বাসায় ফেরা হলো না। আজ সকাল সাতটায় না ফেরার দেশে চলে গেছেন পঞ্চাশের দশকের নামী ফুটবলার জহিরুল হক।

শুধু সাবেক ফুটবলার বললে তাঁর সম্পর্কে সবটা বলা হয় না। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান থেকে হাতে গোনা যে কজন ফুটবলার পাকিস্তান জাতীয় দলে খেলেছিলেন, তিনি তাঁদেরই একজন। সেই পরিচয় ছাপিয়ে জহিরুল হক স্বমহিমায় উদ্ভাসিত হন ঢাকা মোহামেডানের জার্সিতে। ১৯৬০ থেকে ১৯৭৬ পর্যন্ত সাদা–কালো শিবিরে কাটিয়ে হয়ে ওঠেন মোহামেডানের ঘরের ছেলে, ঐতিহ্যবাহী ক্লাবটির কিংবদন্তি ফুটবলারদেরও একজন। মোহামেডানের অধিনায়ক ছিলেন পাঁচবার। তাঁকে ‘মোহামেডানের জহির ভাই’ বলেই বেশি ডাকতেন সমকালীন ফুটবলাররা। রাইটব্যাকে তাঁর মতো ফুটবলার কমই এসেছেন এই ভূখণ্ডে।

১৯৫৪ সালে তেজগাঁও ফ্রেন্ডস ইউনিয়ন ক্লাব দিয়ে ঢাকার ফুটবলে তাঁর যাত্রা শুরু। ১৯৫৬ সাল পর্যন্ত এই ক্লাবে খেলে পরের দুই বছর খেলেন সেন্ট্রাল প্রিন্টিং অ্যান্ড স্টেশনারিতে। পুলিশ দলে খেলেন ১৯৫৯ সালে। পূর্ব পাকিস্তান দলে খেলেছেন ১৯৫৭-৬০ পর্যন্ত। ’৬০ সালে ছিলেন পূর্ব পাকিস্তান দলের অধিনায়ক। পাকিস্তান জাতীয় দলের জার্সিতে ১৯৬১ সালে ঢাকা ও চট্টগ্রামে দুটি ম্যাচ খেলেন বার্মার সঙ্গে। ১৯৬২ সালে খেলেছেন মালয়েশিয়ার মারদেকা কাপে। ওই বছর জাকার্তা এশিয়ান গেমসে খেলার অভিজ্ঞতা হয়েছে।

১৯৬৪ সালে খেলেছেন চীনের পিকিংয়ে (এখন বেইজিং) দেশটির স্বাধীনতা দিবস টুর্নামেন্টে। ওই টুর্নামেন্টে তিনি ছিলেন পাকিস্তান দলে পূর্ব পাকিস্তানের একমাত্র খেলোয়াড়। ১৯৬৫ সালে রাশিয়ার বাকু ওয়েল মিল দলের বিপক্ষে ঢাকা, চট্টগ্রাম ও করাচিতে খেলেছেন পাকিস্তান জাতীয় দলের জার্সিতে।

ফুটবল ক্যারিয়ারে পাওয়া এমন অনেক পুরস্কার ও ব্যাজ সংরক্ষণ করে রেখে গেছেন জহিরুল হক। বাসায় অতিথিদের দেখাতেন
সংগৃহীত

পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবস ফুটবলের ১৩টি ফাইনাল খেলা ফুটবলার তিনি। চারবার আগা খান গোল্ডকাপে ফাইনাল খেলেছেন। মোহামেডানের হয়ে দুবার তাতে চ্যাম্পিয়ন। ১৯৬৪ সালে ক্রীড়ালেখক সমিতির বর্ষসেরা ফুটবলার হন।

২০০১ সালে পেয়েছেন জাতীয় ক্রীড়া পুরস্কার। প্রথম আলোর ক্রীড়া পুরস্কারে আজীবন সম্মাননা পান ২০১২ সালে। ২২টি ব্লেজার পেয়েছেন দীর্ঘ খেলোয়াড়ি জীবনে, যেগুলো খুব গর্ব নিয়ে দেখাতেন বাসায় আগত অতিথিদের। মিরপুর ১ নম্বর আনসার ক্যাম্পের পাশে নিজ বাসায় সেসব পুরস্কার রেখে তিনি চলে গেলেন।

জন্ম ১৯৩৫ সালের ৫ জানুয়ারি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগরে। গতকালই ৮৯তম জন্মদিন পূর্ণ হয়। এদিনই কিনা হাসপাতালের বিছানায় অচেতন ছিলেন! ছেলে রেজওয়ানুল হক জানিয়েছেন, গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়লে তাঁকে ইবনে সিনা হাসপাতালে নেওয়া হয়। সেখানেই শেষনিশ্বাস ত্যাগ করেন তিনি। আজ বাদ জোহর তাঁর প্রথম জানাজা হবে আনসার ক্যাম্পের পাশের মসজিদে। দ্বিতীয় জানাজা হবে সন্ধ্যায় মণিপুরিপাড়ায় খেজুরবাগান জামে মসজিদে। আজই বনানী কবরস্থানে তাঁকে দাফন করা হবে।

প্রথম আলো ক্রীড়া পুরস্কার–২০১২ আজীবন সন্মাননা পেয়েছিলেন জহিরুল হক
প্রথম আলো

জহিরুল হকের মৃত্যুতে একটু বেশিই ব্যথিত গোলাম সারোয়ার টিপু। ১৯৬৪ সালে ঢাকার ফুটবলে ক্যারিয়ার শুরু করা সাবেক এই ফুটবলার বলেন, ‘ষাটের দশকে আমি থাকতাম ফার্মগেটে। আর পাশেই মণিপুরিপাড়ায় থাকতেন জহির ভাই। মোহামেডানে তিনিই আমাকে নিয়ে যান। একদিন ভেসপা নিয়ে এসে বলেন, “টিপু, চল মোহামেডানে।” নবীনগরে তাঁর আর আমার বাড়ি এক মাইলের মধ্যে। নানাভাবে সহায়তা করেন আমাকে। খুব শৃঙ্খলাপরায়ণ মানুষ ছিলেন। বাংলাদেশের ফুটবলে তাঁর অবদান কখনো ভোলার নয়।’

বাংলাদেশে জহিরুল হকের চেয়ে বেশি বয়সী ফুটবলার বেঁচে আছেন শুধু একজন—পূর্ব পাকিস্তান দলের গোলকিপার রণজিৎ দাশ। তিনি থাকেন সিলেটে।