একুশ শতকের প্রথম ২৫ বছরের সেরা ক্রীড়াবিদ মেসি, শীর্ষ দশে কারা

২০২৫ সালের সমাপ্তির মাধ্যমে একবিংশ শতাব্দীর এক–চতুর্থাংশ শেষ হতে চলেছে। ২০০০ সালের শুরু থেকে অসাধারণ সব ক্রীড়াবিদের কীর্তি এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে নতুন শতাব্দীর প্রথম এক-চতুর্থাংশে ‘সেরাদের মধ্যে সেরা’ কে—এ প্রশ্ন তোলাটা প্রায় অনিবার্য হয়ে পড়েছে।

কিন্তু সিদ্ধান্ত নেবেন কীভাবে, যখন বাছাই করা প্রত্যেক ক্রীড়াবিদই নিজ নিজ খেলায় ভিন্ন ভিন্নভাবে আধিপত্য দেখিয়েছেন? দলগত খেলাকে অগ্রাধিকার দেবেন নাকি ব্যক্তিগত খেলাকে? অলিম্পিক খেলাধুলা নাকি পেশাদার লিগ? সিদ্ধান্ত নেওয়া সহজ নয়।

তবু ঝুঁকি নিয়ে গত ২৫ বছরের সেরা ২৫ ক্রীড়াবিদের একটি র‍্যাঙ্কিং করেছেন ফরাসি ভাষার কানাডীয় গণমাধ্যম লে জার্নাল কুইবেক। ক্রীড়াবিদের অর্জন ও রেকর্ড, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক প্রভাব, প্রজন্মগত অনুপ্রেরণা আর খেলাধুলার বাইরে ব্যক্তিগত ব্র্যান্ডের ওপর ভিত্তি করে তৈরি করা এই র‍্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষ ১০ দেখুন এখানে।

একবিংশ শতাব্দির প্রথম ২৫ বছরের শীর্ষ ২৫ ক্রীড়াবিদলে জার্নাল কুইবেক

লিওনেল মেসি (ফুটবল)

লিওনেল মেসি
রয়টার্স

বিশ্বজুড়ে ফুটবলের মতো আবেগ জাগানো আর কোনো খেলা নেই। তাঁর প্রজন্মের সেরা কে? নিঃসন্দেহে লিওনেল মেসি। কেউ কেউ তাঁকে সর্বকালের সেরাও বলেন। আর্জেন্টাইন এই মহাতারকার অর্জনের শেষ নেই—১০টি লা লিগা ও ৪টি চ্যাম্পিয়নস লিগ শিরোপা, আটবার ব্যালন ডি’অর।

আর্জেন্টিনা ও এফসি বার্সেলোনার সর্বোচ্চ গোলদাতাও তিনি। তাঁর অর্জন কিংবদন্তি রূপ পেয়েছিল আগেই, ২০২২ সালে ৩৪ বছর বয়সে আর্জেন্টিনাকে বিশ্বকাপ জেতানোর মাধ্যমে তিনি সেটিতে চূড়ান্ত এক বিস্ময়সূচক চিহ্ন যোগ করেন, বিশ্বজুড়ে হয়ে ওঠেন খেলাধুলার বড় আইকন।

টম ব্র্যাডি (আমেরিকান ফুটবল)

টম ব্র্যাডি
ইনস্টাগ্রাম/টম ব্র্যাডি

আমেরিকান ফুটবলকে সবচেয়ে দলনির্ভর খেলা বলা হয়, কিন্তু ব্যক্তিগত প্রভাবের দিক থেকে টম ব্র্যাডির সমকক্ষ কেউ নেই। নিউ ইংল্যান্ড প্যাট্রিয়টসের হয়ে ২০ বছর এবং টাম্পা বে বুকানিয়ার্সের হয়ে তিন বছরে তিনি জিতেছেন সাতটি সুপার বোল। তাঁর আগে কোনো কোয়ার্টারব্যাক চারটির বেশি জেতেননি।

২০০১ সালে প্রথম এবং ২০২০ সালে শেষ সুপার বোল জিতে তাঁর দীর্ঘ ক্যারিয়ার কিংবদন্তিতে পরিণত হয়েছে। তিনবার নিয়মিত মৌসুমের এমভিপি ও পাঁচবার সুপার বোল এমভিপি হয়েছেন তিনি। ২৫১টি জয় ও ৬৪৯টি টাচডাউন পাসসহ অসংখ্য রেকর্ড তাঁর দখলে।

মাইকেল ফেলপস (সাঁতার)

মাইকেল ফেলপস।
এএফপি

অনেকে মনে করেন তালিকার শীর্ষে থাকা উচিত যুক্তরাষ্ট্রের সাঁতারু মাইকেল ফেলপসের, এই যুক্তি অস্বীকার করাও কঠিন। ২০০৪ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে তিনি জিতেছেন ২৮টি অলিম্পিক পদক, যার মধ্যে ২৩টিই সোনা।

২০০৮ বেইজিং অলিম্পিকে ফেলপসের আটটি সোনা সব খেলাধুলা মিলিয়েই অলিম্পিকের এক আসরে সর্বোচ্চ। ওই আসরেই তিনি গড়েছিলেন সাতটি বিশ্ব রেকর্ড। ক্যারিয়ার শেষে তাঁর বিশ্ব রেকর্ডের সংখ্যা দাঁড়ায় ৩৯টিতে। সাঁতারের বৈশ্বিক প্রভাব অন্য খেলাগুলোর মতো না হলেও ফেলপস নিজের খেলাকে ছাড়িয়ে গেছেন।

সেরেনা উইলিয়ামস (টেনিস)

সেরেনা উইলিয়ামস
এএফপি

কোর্টের পারফরম্যান্স নিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা আলোচনা করা যায়, তবে এর চেয়েও বড় হলো নারীদের টেনিসে, সামগ্রিকভাবে খেলাধুলায় এবং কৃষ্ণাঙ্গ সম্প্রদায়ের ওপর সেরেনা উইলিয়ামসের বিপুল প্রভাব।

যুক্তরাষ্ট্রের এই টেনিসকন্যা এক সাংস্কৃতিক আইকনে পরিণত হয়েছেন, বড় বড় বিজ্ঞাপন প্রচারণায় তাঁর উপস্থিতি তাঁকে বিশ্বব্যাপী তারকায় পরিণত করেছে। টেনিসে তিনি ৩১৯ সপ্তাহ ছিলেন ডব্লিউটিএ র‍্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে, জিতেছেন ৭৩টি শিরোপা, যার মধ্যে ২৩টি একক গ্র্যান্ড স্লাম।

উসাইন বোল্ট (অ্যাথলেটিকস)

উসাইন বোল্ট
এএফপি

উসাইন বোল্ট যে ইতিহাসের সেরা স্প্রিন্টার, এ নিয়ে সন্দেহ থাকার কথা নয় কারোরই। অনেক দুর্দান্ত স্প্রিন্টার এসেছেন, এখনো আছেন, কিন্তু বোল্ট সবার চেয়ে ব্যতিক্রম। জ্যামাইকান এই দৌড়বিদ অলিম্পিকে জিতেছেন আটটি সোনা, বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন ১১ বার।

২০০৯ সালে ১০০ মিটারে তাঁর ৯.৫৮ সেকেন্ডের বিশ্ব রেকর্ড এখনো অটুট। ২০১৭ সালে অবসর নেওয়ার আট বছর পরও তিনি বিশ্বের দ্রুততম মানুষ হিসেবে বিবেচিত। টানা তিন অলিম্পিকে ১০০ ও ২০০ মিটার দুই ইভেন্টেই সোনা জেতা একমাত্র স্প্রিন্টার তিনি।

লেব্রন জেমস (বাস্কেটবল)

লেব্রন জেমস
এএফপি

লেব্রন জেমস নাকি মাইকেল জর্ডান—কে সর্বকালের সেরা? এই বিতর্ক অন্যদের জন্য তোলা থাক। তবে ২০০০ থেকে ২০২৫ সময়কালে লেব্রন জেমস যে সবার চেয়ে এগিয়ে, তা নিয়ে কোনো সন্দেহ নেই। ব্যক্তিগতভাবে তিনি এনবিএ ইতিহাসের সর্বোচ্চ পয়েন্ট সংগ্রাহক, জিতেছেন চারটি এমভিপি পুরস্কার, ২০ বার ছিলেন অল-স্টার দলে।

দলগতভাবে চারটি এনবিএ ফাইনাল জিতেছেন লেব্রন, প্রতিবারই হয়েছেন ফাইনালস এমভিপি। মায়ামি হিট, ক্লিভল্যান্ড ক্যাভালিয়ার্স ও লস অ্যাঞ্জেলেস লেকার্স—তিনটি ভিন্ন দলের হয়ে তিনি অংশ নিয়েছেন ১০টি ফাইনালে।

নোভাক জোকোভিচ (টেনিস)

নোভাক জোকোভিচ
রয়টার্স

রজার ফেদেরার ও রাফায়েল নাদালের আধিপত্যের যুগে নিজেকে প্রমাণ করাই নয়, বরং অর্জনের দিক থেকে তাঁদেরও ছাড়িয়ে গেছেন সার্বিয়ান তারকা নোভাক জোকোভিচ। অবিশ্বাস্য ২৪টি গ্র্যান্ড স্লাম শিরোপা জিতে ‘জোকার’ এখন সবার ওপরে।

ক্যারিয়ারে রেকর্ড ৪২৮ সপ্তাহ জোকোভিচ এটিপি র‍্যাঙ্কিংয়ের শীর্ষে ছিলেন, আটবার বছর শেষ করেছেন বিশ্বসেরা হিসেবে। প্রতিটি গ্র্যান্ড স্লাম অন্তত তিনবার করে জিতেছেন তিনি, যার মধ্যে অস্ট্রেলিয়ান ওপেন জিতেছেন ১০ বার। ২০২৪ প্যারিস অলিম্পিকের মাধ্যমে উজ্জ্বল ক্যারিয়ারে যোগ করেছেন অলিম্পিক সোনাও।

সিমোন বাইলস (জিমন্যাস্টিকস)

সিমোন বাইলস
রয়টার্স

আন্তর্জাতিক অঙ্গনে মোট ৪১টি পদক জিতে ইতিহাসের সবচেয়ে সফল জিমন্যাস্ট সিমোন বাইলস। যার মধ্যে ৩০টি বিশ্ব চ্যাম্পিয়নশিপে, ১১টি অলিম্পিকে। ২০১৬ রিও অলিম্পিকে চারটি স্বর্ণপদক জিতে তিনি বৈশ্বিক তারকায় পরিণত হন। তাঁর আধিপত্য এতটাই প্রবল ছিল যে এখন পাঁচটি জিমন্যাস্টিক কৌশল তাঁর নামেই পরিচিত।

২০১৩ থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত ইউএস চ্যাম্পিয়নশিপ, ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়নশিপ এবং অলিম্পিকের অল-অ্যারাউন্ড বিভাগে বাইলস ছিলেন অপরাজিত। ২০২১ টোকিও অলিম্পিকের সময় মানসিক স্বাস্থ্যের কারণে সাময়িক সরে দাঁড়ানোয় তাঁর নাম বিশ্বজুড়ে আলোড়ন তোলে। ২০২৪ প্যারিস অলিম্পিকে ফিরে এসে তিনি জিতেছেন চারটি পদক।

কোবে ব্রায়ান্ট (বাস্কেটবল)

কোবে ব্রায়ান্ট
রয়টার্স

২০২০ সালে হেলিকপ্টার দুর্ঘটনায় নিহত প্রয়াত কোবে ব্রায়ান্ট বাস্কেটবলপ্রেমীদের একটি পুরো প্রজন্মকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছেন। লস অ্যাঞ্জেলেস লেকার্সের হয়ে তিনি জিতেছেন পাঁচটি এনবিএ শিরোপা, জায়গা করে নিয়েছেন ইতিহাসের সর্বকালের সেরাদের কাতারে।

ব্রায়ান্ট দুবার ফাইনালস এমভিপি হয়েছেন, নিয়মিত মৌসুমে অল-স্টার দলে জায়গা পেয়েছেন ১৮ বার। খেলাধুলার বাইরেও তাঁর প্রভাব ছিল সুদূরপ্রসারী—‘মাম্বা মেন্টালিটি’ নামে পরিচিত তাঁর দর্শনটি হয়ে উঠেছে শৃঙ্খলা, নিষ্ঠা ও জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে নিখুঁততার এক প্রতীক।

১০

ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো (ফুটবল)

ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো
রয়টার্স

ফিফা বিশ্বকাপ জেতা বাদে ফুটবলের বাকি সব শীর্ষ প্রতিযোগিতাতেই অবিশ্বাস্য সব অর্জন ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর। বছরের সেরা খেলোয়াড় হিসেবে পাঁচবার ব্যালন ডি’অর জেতা এই পর্তুগিজ তারকা যেখানে খেলেছেন, সেখানেই দুর্দান্ত সব রেকর্ড গড়েছেন। পাঁচটি চ্যাম্পিয়নস লিগ, তিনটি প্রিমিয়ার লিগ আর দুটি লা লিগা শিরোপায় উদ্ভাসিত তাঁর ক্যারিয়ার।

চ্যাম্পিয়নস লিগে সর্বোচ্চ ১৪০ গোল এবং আন্তর্জাতিক ফুটবলে সর্বোচ্চ ১৪৩ গোলের রেকর্ড রোনালদোর দখলে। বিশ্বের একমাত্র খেলোয়াড় হিসেবে তিনি চারটি ভিন্ন ক্লাবের হয়ে ১০০টির বেশি গোল করেছেন, খেলেছেন ১৩ শতাধিক ম্যাচ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এক বিলিয়নের বেশি অনুসারী নিয়ে তাঁর প্রভাব এখনো অটুট।

শীর্ষ দশের পর আছেন যথাক্রমে টাইগার উডস (১১), রজার ফেদেরার (১২), রাফায়েল নাদাল (১৩), স্টিফেন কারি (১৪), লুইস হ্যামিল্টন (১৫), কেটি লেডেকি (১৬), ফ্লয়েড মেওয়েদার (১৭), সিডনি ক্রসবি (১৮), মিকায়েল কিংসবুরি (১৯), মাইকেল শুমাখার (২০), সোহেই ওতানি (২১), মিকায়েলা শিফরিন (২২), প্যাট্রিক মোহামেস (২৩), আলেক্সান্ডার ওভেচকিন (২৪) ও মার্তা দ্য সিলভা (২৫)।