এবারের বিশ্বকাপটা এ পর্যন্ত অনেক গোলের জন্য দারুণ প্রশংসিত হয়েছে। কিন্তু ট্যাকটিক্যাল দৃষ্টিভঙ্গি থেকে চিন্তা করলে খুব বেশি চমক আসলে ছিল না। গোলের সংখ্যার সঙ্গে ভালো খেলা গুলিয়ে ফেলা উচিত নয়। এত গোল হওয়ার বড় কারণ রক্ষণের ভুল। তা-ই সই, কারণ দর্শকের কাছে তো গোলশূন্য ড্রয়ের চেয়ে ৫-৩ স্কোরলাইন ভালো।
তবে আসল বিশ্বকাপ শুরু হলো এখনই। দলগুলোর শক্তিমত্তা ও সৃষ্টি–শীলতা কতটুকু সেটাও এখন থেকেই আমরা দেখতে পাব। এখন আসলে দলগুলোর নিজেদের খেলাকে আরেকটু বেশি উচ্চতায় নিয়ে যেতে হবে। মনে করতে হবে তারা ফাইনালে খেলছে। এখন থেকে যে হারবে তাকেই বিদায় নিতে হবে। যে জিতবে সেও আসলে কিন্তু জিতবে না, শুধু এক ধাপ সামনে এগোবে মাত্র।
এ পর্যন্ত যা দেখলাম, তাতে সবচেয়ে ভালো খেলছে জার্মানি। ওদের শক্তি অনেক বেশি। তাদের কোনো রবিন ফন পার্সি, আরিয়েন রোবেন বা লিওনেল মেসি নেই। কিন্তু তারা দল হিসেবে খেলছে, দলের সবাই ভালো খেলোয়াড়।
আমি মনে করি গ্রুপপর্বে ব্রাজিল আসলেই খারাপ খেলেছে, এমনকি রক্ষণভাগেও তারা ভালো খেলেনি। ব্রাজিলিয়ানরা জন্মগতভাবেই ভালো খেলোয়াড়। কিন্তু এবার ওদের একটু নাজুক অবস্থায় দেখতে পাচ্ছি। একটু বেশিই জায়গা ছেড়ে দিচ্ছে তারা। কিন্তু ব্রাজিল ব্রাজিলই, ওদের সেই টেকনিক আছে। চার থেকে পাঁচজন খেলোয়াড় আছে যারা খুবই ভালো খেলছে।
দ্বিতীয় রাউন্ডে মেক্সিকো-হল্যান্ড ম্যাচেও আলাদা করে চোখ রাখতে হবে। মেক্সিকো মানসিকভাবে অনেকটা পেছনে থেকেই এখানে এসেছিল। বড় শক্তি হয়ে আসেনি। বাছাইপর্বও পার করেছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। কিন্তু নতুন কোচ মিগুয়েল হেরেরা তাদের আত্মবিশ্বাস ফিরিয়ে এনেছে। মেক্সিকো সাম্প্রতিক বছরগুলোতে বিশ্বকাপ থেকে মাথা উঁচু করেই দেশে ফিরতে পেরেছে।
কিন্তু হল্যান্ডের এমন তিনজন খেলোয়াড় আছে, যারা আসলেই ভয়ংকর। বিশেষ করে ফন পার্সি ও রোবেন। মেক্সিকোর জন্য ব্যাপারটা কঠিন হয়ে দাঁড়াতে পারে ওদের কারণেই। এটা সত্যি, মার্কো ফন বাস্তেন বা ইয়োহান ক্রুইফের হল্যান্ডের মতো এই হল্যান্ড খেলতে পারছে না। কিন্তু ওদের দলটা খুবই শক্তিশালী, কীভাবে খেলবে সেটা নিয়েও তাদের পরিষ্কার ধারণা আছে। অনেক দলের মধ্যেই এটা দেখিনি।
আর্জেন্টিনা নাইজেরিয়ার সঙ্গে উন্নতির অনেক ছাপ রেখেছে। তবে খুব যে ভালো খেলেছে, তা নয়। আমার মনে হয় তারা এখনো নিজেদের ফর্মটা খুঁজে পায়নি। সম্ভবত এখন সেটা পাবে। আমি আগেও দেখেছি, গ্রুপপর্ব থেকে ওঠার পর অনেকের খেলার ধরন আমূল বদলে যায়।
আমার কেন যেন মনে হচ্ছে আগুয়েরোর চোটে আর্জেন্টিনার জন্য ভালোই হয়েছে। আমি ঠিক ওর সমালোচনা করছি না, খেলোয়াড় হিসেবে সে অসাধারণ। কিন্তু এটা আর্জেন্টিনার খেলাটাকে আরও বিস্তৃত করার সুযোগ দেবে। আমার মনে হয় আর্জেন্টিনা ফর্মেশনের ওপর যতটা, তার চেয়ে বেশি নির্ভর করে খেলোয়াড়দের ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের ওপর। মাঝমাঠের সমস্যাগুলো দূর করতে পারলে অনেক কিছুই ঠিক হয়ে যাবে। মধ্যমাঠে ওরা অনেক বেশি জায়গা দিচ্ছে। নাইজেরিয়া আমাদের সঙ্গে ২ গোল করেছে, অন্য দলগুলোও আরও গোল করতে পারত। আর এই সুইজারল্যান্ড তো খুবই বিপজ্জনক।
যা-ই হোক, সুইজারল্যান্ড বল নিয়ে যতটা খেলে, ততটা মাথার খেলা খেলে না বা মাথা খাটায় না। তারা বল পায়ে বেশ ভালো, কিন্তু রক্ষণ অত ভালো করতে পারে না। যা-ই হোক, এখন পর্যন্ত যেভাবে খেলেছে আজও যদি সুইজারল্যান্ড সেভাবে খেলে তাহলে আর্জেন্টিনা ভালো খেলার সুযোগ পাবে। আমরা যদি সুইসদের সঙ্গে ভালো খেলতে না পারি, বড় ধরনের বিপদেই পড়ব।
আরেকটা দলকে নিয়ে একটু কথা বলতে চাই, কোস্টারিকা। অনেক মানুষই ওদের নিয়ে কিছু জানে না। দক্ষিণ আমেরিকানরা বা ইউরোপিয়ানদের কারও ধারণাই ছিল না তারা এ রকম খেলবে। কোস্টারিকার খেলোয়াড়েরা শারীরিক দিক দিয়ে বেশ এগিয়ে, এখন তারা খেলাটাও বেশ ভালো বোঝে। দলটা খুবই সুশৃঙ্খল ও প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ মানসিকতা নিয়ে খেলছে।
কিন্তু গ্রিসের সঙ্গে ম্যাচে ওদের দুর্ভোগ পোহাতে হবে। গ্রিকরা জন্মগতভাবে লড়াকু, তাদের ভাষায় যেটাকে বলে ‘কামোরেরো’। তারা প্রতিপক্ষের খেলা নষ্ট করে দিতে পারে। কোস্টারিকা তাদের বিপক্ষে নিজেদের খেলাটা খেলতে পারে কি না এটা দেখার বিষয়। এই ম্যাচটা হবে আলাদা ঘরানার দুটি দলের লড়াই।
সবশেষে আমি বিদায়ী চ্যাম্পিয়ন স্পেনকে নিয়ে কিছু বলতে চাই। আমি বিশ্বাস করি, ওদের প্রতি সুবিচার করা হয়নি। ফুটবলে ওদের প্রভাবটা বিশালই ছিল। ওরা যদি ধরন বদলায়, তার মানে এই নয় তারা আরও ভালো খেলবে। নিজেদের ধরনে খেলেই তাদের আরও শক্তিশালী হয়ে ফিরে আসতে হবে। ওরা এখনো শেষ হয়ে যায়নি।