ইডেনে ক্যারিবীয় দিন ক্যারিবীয় রাত

ছয়, ছয়, ছয়, ছয়! শেষ ওভারে কার্লোস ব্রাফেটের ব্যাটিং-তাণ্ডবে জিতল ওয়েস্ট ইন্ডিজ, অবিশ্বাস আর হতাশায় মুখ ঢাকলেন ইংল্যান্ড পেসার বেন স্টোকস। টি-টোয়েন্টিতে বিশ্বজয়ের পর ব্রাফেটের সঙ্গী মারলন স্যামুয়েলস। কাল ইডেন গার্ডেনে l রয়টার্স
ছয়, ছয়, ছয়, ছয়! শেষ ওভারে কার্লোস ব্রাফেটের ব্যাটিং-তাণ্ডবে জিতল ওয়েস্ট ইন্ডিজ, অবিশ্বাস আর হতাশায় মুখ ঢাকলেন ইংল্যান্ড পেসার বেন স্টোকস। টি-টোয়েন্টিতে বিশ্বজয়ের পর ব্রাফেটের সঙ্গী মারলন স্যামুয়েলস। কাল ইডেন গার্ডেনে l রয়টার্স

ড্যারেন ব্রাভোর আদুল গা, পরনে শুধু শর্টস। এদিকে ছুটছেন, ওদিকে ছুটছেন। তাঁর পেছনে পেছনে সতীর্থরা। দেখে কারও মনে হতেই পারত, একটু আগে কি একটা ক্রিকেট ম্যাচ শেষ হলো নাকি ফুটবল! এটা তো জয়ের পর ফুটবলারের ছবি! ক্রিকেট এমন কিছু কি কখনো দেখেছে আগে!

তা এমন ক্রিকেট ম্যাচই বা কে দেখেছে কবে! বিশ্বকাপ ফাইনাল, এ কথা নাহয় ভুলেই যান। এর আগে কোন ক্রিকেট ম্যাচে এমন হয়েছে, শেষ ওভারে জয়ের জন্য প্রয়োজন ১৯ রান, আর প্রথম তিন বলেই ছক্কা মেরে স্কোর সমান করে ফেলেছেন ব্যাটসম্যান। চতুর্থ বলেও আরেকটি ছক্কাতেই শেষ হয়েছে ম্যাচ!
না, দারুণ ম্যাচ, উত্তেজনাময় ম্যাচ—এসব দিয়ে আসলে কিছুই বোঝানো যাচ্ছে না। ক্রিকেটের অমর রূপকথা বললে যদি ২০১৬ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ফাইনালকে কিছুটা বোঝানো যায়!
তা কে এই সমাপ্তির নায়ক? ক্রিস গেইল নন, আন্দ্রে রাসেল নন, নন মারলন স্যামুয়েলসও। রূপকথার এই সমাপ্তির নায়ক কার্লোস ব্রাফেট! ফাইনালের আগে মাত্র ৭টিই টি-টোয়েন্টি খেলেছেন। ৪ ইনিংসে ব্যাট করে রান মাত্র ২৫। আর এখানে এক ইনিংসেই ৩৪! সেটিও কি যেমন-তেমন ৩৪। মাত্র ১০ বলের ওই ইনিংসটিই দারুণভাবে ফিরে আসা ইংল্যান্ডকে ধ্বংস করে দিল।
বোলার বেন স্টোকসকে যেমন ‘জীবন্ত ধ্বংসস্তূপ’ মনে হচ্ছিল, তেমনি ইংল্যান্ড অধিনায়ক এউইন মরগানকেও। প্রথম তিন বলে ছক্কায় এমনই হতচকিত যে, স্কোর সমান হয়ে যাওয়ার পরও বাউন্ডারি লাইনে তিন ফিল্ডারকে রেখে দিলেন!
যতবার এই ম্যাচের কথা উঠবে, সবার আগে মনে পড়বে কার্লোস ব্রাফেটের ওই ছক্কার ঝড়। ম্যাচসেরার ট্রফিটা অবশ্য তারপরও তাঁর হাতে উঠল না। সেটি পেলেন মারলন স্যামুয়েলস। তাতে যে খুব বেশি অন্যায় হয়েছে, তা বলা যাবে না। স্যামুয়েলসের অপরাজিত ৮৫ রানের ইনিংসটিই তো ধরে রাখল ভেঙে পড়তে বসা ওয়েস্ট ইন্ডিজের ব্যাটিংকে। যা দেখতে দেখতে ওয়েস্ট ইন্ডিজের আগের টি-টোয়েন্টি শিরোপাটির কথাও মনে পড়ছিল। কলম্বোতে ২০১২ টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ফাইনালেও শুরুতেই ছন্নছাড়া ওয়েস্ট ইন্ডিজকে প্রায় একাই দাঁড় করিয়েছিলেন আবার। দলের ১৩৭ রানের মধ্যে ৭৮-ই ছিল তাঁর। সেটিকেও ছাড়িয়ে টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপ ফাইনালে সর্বোচ্চ স্কোর এখন স্যামুয়েলসের।
খেলার ধরনে, উদ্যাপনে এই বিশ্বকাপকে ফাইনালের আগেই রাঙিয়ে দিয়েছে ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ফাইনালে তো আরও বেশি। ইচ্ছামতো ছয় মারার যে অবিশ্বাস্য ক্ষমতা তাঁদের আলাদা করে দিয়েছে, সেটির সবচেয়ে বড় প্রমাণ হয়ে থাকল এই ফাইনাল। ব্রাভোর উদ্ভাবিত ‘চ্যাম্পিয়নস’ নাচ এই ওয়েস্ট ইন্ডিজের সিগনেচার উদ্যাপন হয়ে গেছে আগেই। ট্রফি জেতার আগেই বেশ কবার তা দেখে ফেলল ইডেনের প্রায় ৫০ হাজার দর্শক। ইংল্যান্ডের একটা করে উইকেট পড়ে আর শুরু হয়ে যায় ব্রাভোদের ‘চ্যাম্পিয়নস’ নাচ। ম্যাচ শুরুর আগেই যা নেচেছেন এমিরেটসের বিমানবালারা। পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠানে ব্রাভো-গেইলদের সঙ্গে আবারও।
অথচ একসময় মনে হচ্ছিল ‘ব্যর্থ’ দুই অধিনায়কের মধ্যে মর্গানই বোধ হয় শেষ পর্যন্ত শিরোপার রঙে উজ্জ্বল হয়ে উঠবেন! ফাইনালিস্ট দুই দলের অধিনায়ক যেন এই টুর্নামেন্টে ‘নন প্লেয়িং ক্যাপ্টেন’! ড্যারেন স্যামি ফাইনালের আগে ১১টি বল খেলেছেন, করেছেন ১২টি বল। কাল এক ওভার বোলিং করলেন, ১৪ রান দেওয়ার পর ওখানেই শেষ। ব্যাটিংয়ে ২ বলে ২।
আগের পাঁচ ম্যাচে মর্গানের ২টি ‘গোল্ডেন ডাক’। কাল শূন্যের চক্কর থেকে বেরোতে সাত বল লাগল। বদ্রি কোনটা লেগ ব্রেক ছাড়ছেন আর কোনটা গুগলি বুঝতেই পারছিলেন না। শেষ পর্যন্ত সেই গুগলি না বুঝেই স্লিপে ক্যাচ। এই বিশ্বকাপে ৬ ইনিংসে তাঁর রান মাত্র ৬৬। যা ফিরিয়ে আনছে ২০১৫ বিশ্বকাপের স্মৃতি। ওখানে ৫ ইনিংসে করেছিলেন ৯০।
কিন্তু নিজের ব্যাটিং ব্যর্থতা অধিনায়কত্বের ঝলকে প্রায় ভুলিয়েই দিয়েছিলেন মর্গান! দ্বিতীয় ওভারেই জো রুটকে বোলিংয়ে আনার ফাটকা খেলা ছাড়া আর কিছুই মনে হচ্ছিল না। এর আগে ১৯টি আন্তর্জাতিক টি-টোয়েন্টির মাত্র ৬টিতেই বোলিং করেছেন। সব মিলিয়ে মাত্র ১০ ওভার। তাতেই অবশ্য ৪ উইকেট। কোনো ম্যাচেই একটির বেশি নয়। এবার তিন বলের মধ্যে ২ উইকেট। যা তাঁর প্রথম তিন বলও। দুই ওপেনার জনসন চার্লস ও ক্রিস গেইলকে হারিয়ে ওয়েস্ট ইন্ডিজ ২ উইকেটে ৫। কিছুক্ষণের মধ্যেই তা ৩ উইকেটে ১১।
ইংল্যান্ডের অমন দুঃস্বপ্নের সূচনাকেও তখন অনেক ভদ্রস্থ দেখাচ্ছে। প্রথম দুই ওভারে দুই ওপেনারকে হারানোর সময় তো ইংল্যান্ডের স্কোর ছিল ২ উইকেটে ৮। এখানেও ত্রাতার ভূমিকায় জো রুট। টি-টোয়েন্টি ব্যাটিং যে শুধুই শক্তির প্রদর্শনী নয়, ক্রিকেটিং শট খেলেও এখানে যথেষ্টই দ্রুত রান করা যায়, বিরাট কোহলি যেমন এটি বুঝিয়ে যাচ্ছেন, তেমনি রুটও। ধ্বংসস্তূপের মধ্যে দাঁড়িয়ে কী দারুণ ব্যাটিংই না করলেন!
শেষটা অবশ্য আবার মনে করিয়ে দিল মাইক গ্যাটিংকে। ১৯৮৭ বিশ্বকাপ ফাইনালে রিভার্স সুইপ খেলতে গিয়ে আউট হয়েছিলেন গ্যাটিং। রুট আউট হলেন স্কুপ করতে গিয়ে। বদলে যাওয়া ব্যাটিং দর্শনের কারণে সেই রিভার্স সুইপ আর এই স্কুপকে মেলানো হয়তো ঠিক নয়। আবার পরিস্থিতি বিবেচনায় ঠিকও। আগের ওভারেই তিন বলের মধ্যে স্টোকস ও মঈন আলীকে ফিরিয়ে দিয়েছেন ব্রাভো। শুরুর ধাক্কা সামলে যখন ডানা মেলতে যাওয়া ইংল্যান্ডের ইনিংস ওই যুগল আঘাতে আবার টলোমলো। রুটের স্কুপটা এ কারণেই বেশি চোখে লাগল।
উইলির ১৪ বলে ২১ তারপরও ইংল্যান্ডকে লড়াই করার পুঁজি দিয়েছিল। ওই ১৫৫-ই যে ম্যাচটাকে এমন রুদ্ধশ্বাস সমাপ্তির দিকে নিয়ে যাবে, সেটি অনুমান করা তখন কঠিনই ছিল। দুপুরে মেয়েদের ফাইনালে টানা তিনবারের চ্যাম্পিয়ন অস্ট্রেলিয়াকে হারিয়ে শিরোপা জিতেছে ওয়েস্ট ইন্ডিজের মেয়েরা। ঘণ্টা পাঁচেকের ব্যবধানে দুটি বিশ্বকাপ! এই দিন—এই রাত সবই তাই ক্যারিবীয়দের উদ্দাম আনন্দের গান!

ইংল্যান্ড: ২০ ওভারে ১৫৫/৯
ওয়েস্ট ইন্ডিজ: ১৯.৪ ওভারে ১৬১/৬
ফল: ওয়েস্ট ইন্ডিজ ৪ উইকেটে জয়ী