ইতিহাসের সামনে স্পেন ও জার্মানি

অধিনায়ক এবং কোচ হিসেবে বিশ্বকাপ জয়ের অনন্য কীর্তি শুধু তাঁরই। ১৯৯৮ সালে ঘোষিত বিংশ শতাব্দীর বিশ্ব একাদশে জায়গা পেয়েছেন অনায়াসেই। ২০০২ সালে ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ারকে বাদ দিয়ে বিশ্বকাপের স্বপ্নের দল গড়তে পারেনি ফিফা। সেই জার্মান কিংবদন্তি বিশ্বকাপ নিয়ে আজ থেকে কলাম লিখছেন প্রথম আলোয়

ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার
ফ্রাঞ্জ বেকেনবাওয়ার

প্রথমে খেলোয়াড় হিসেবে বিশ্বকাপের আঙিনায়৷ এরপর কোচ এবং ২০০৬ জার্মানি বিশ্বকাপ আয়োজক কমিটির প্রধান৷ এভাবেই কাটল কয়েকটা যুগ৷ আমি খুশি যে এবারের বিশ্বকাপে থাকব নিজের মতো৷ নিজের শোবারঘরে শুয়ে-বসে চোখ রাখব টিভিতে৷ ব্রাজিলে উড়াল দেব একেবারে শেষ সপ্তাহে, সেমিফাইনালের ঠিক আগে৷
সব ম্যাচ হয়তো পুরো দেখা হবে না৷ তবে ‘ডি’ গ্রুপের কোনো ম্যাচ নিশ্চিতভাবেই বাদ যাবে না ৷ উরুগুয়ে, ইতালি, ইংল্যান্ড—বাভারিয়ায় আমরা যেভাবে বলি, তিন ‘কামানের গোলা’ এক গ্রুপে৷ সাবেক তিন বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন৷ এই গ্রুপে কোস্টারিকার প্রভাব হয়তো থাকবে সামান্য৷ তবে অন্য তিন দলের ভাগ্য নির্ধারণে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে ওরা৷ ২০১০ বিশ্বকাপের তৃতীয় উরুগুয়ে, ইতালি বর্তমান ইউরো রানার্সআপ৷ আর ইংল্যান্ড? ওদের শেষ বড় সাফল্যটা যদিও অনেক বছর আগের, তার পরও দেখা যায় কোনো না কোনোভাবে সব সময়ই ওরা দক্ষযজ্ঞের অংশ হচ্ছে৷ ইংলিশরা কোনোভাবেই উপেক্ষণীয় নয়৷ ব্রাজিলের আবহাওয়ায় অভ্যস্ত হতে ওরা এখন দস্তানা পরে অনুশীলন করছে৷ অনেকেই এতে হাসাহাসি করছে৷ কিন্তু কে জানে, কাজে লেগেও যেতে পারে!
দুই স্ট্রাইকার মারিও বালোতেল্লি ও আন্তোনিও কাসানোকে নিয়ে ইতালি কোচ সিজারে প্রানদেল্লি একটা ঝুঁকি নিয়েছেন৷ দুজনকেই যে সামলানো কঠিন! তবে দুই বছর আগে ইউরোতে কাজটা ভালোই করেছিলেন৷ সেমিফাইনালে বালোতেল্লির ২ গোলেই তো পাততাড়ি গোটাল জার্মানি৷ প্রানদেল্লির স্থিতধী ভাবমূর্তি ও রসিকতা দলের প্রায় সবাই উপভোগ করে৷ খুবই দুঃখজনক যে আয়ারল্যান্ডের বিপক্ষে প্রস্তুতি ম্যাচের চোটে বিশ্বকাপ শেষ হয়ে গেছে রিকার্ডো মন্তোলিভোর৷ ইতালি অবশ্যই মাঝমাঠে মন্তোলিভোর নেতৃত্বের অভাববোধ করবে৷
ছোট্ট একটি দেশ উরুগুয়ে, তার পরও বিশ্বকাপে তারা প্রায় সময়ই সফল৷ ভীষণ কৌতূহলোদ্দীপক ব্যাপার৷ গ্রুপ ‘ডি’তে তাই আমি কোনো একটি দলকে ফেবারিট বলতে পারছি না৷ এখানে ফেবারিট কেউ নেই৷
‘বি’ গ্রুপও দারুণ কিছু প্রাণবন্ত ম্যাচ উপহার দিতে পারে৷ ১৩ জুন, প্রথম ম্যাচেই মুখোমুখি গতবারের দুই ফাইনালিস্ট স্পেন ও হল্যান্ড৷ ওই ম্যাচে কোনো এক দল হেরে গেলে, কে জানে, তারা হয়তো চিলির কাছে হেরে বিদায় নেবে! মাস ছয়েক আগেই ওয়েম্বলিতে ইংল্যান্ডকে হারিয়ে দিয়েছিল চিলি৷ কদিন পর জার্মানির কাছে ১-০ গোলে হেরেছিল স্রেফ ভাগ্যটা পক্ষে না থাকায় ৷ হাঁটুর অস্ত্রোপচারের পর মাঝমাঠের নেতা আর্তুরো ভিদাল যদি চেনা ছন্দে ফেরে আর অ্যালেক্সিস সানচেজ ফর্ম খুঁজে যায়, টুর্নামেন্টের যেকোনো দলকে ভড়কে দিতে পারে চিলি৷
আমার বিশ্বাস, স্পেনেরও শিরোপা ধরে রাখার ভালো সম্ভাবনা আছে৷ দলে হয়তো আর আগের মতো তারুণ্য ও সজীবতা নেই, লম্বা ক্লাব মৌসুমের পর হয়তো অনেকেই ক্লান্ত৷ কিন্তু বিশ্বকাপের বাতাসই এমন যে সব ক্লান্তি ঘুচিয়ে সবাইকে চনমনে করে তোলে৷ আর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো অভিজ্ঞতা৷ বিশ্বকাপের মতো টুর্নামেন্টে অভিজ্ঞতা অমূল্য৷ স্পেনের দলটা অভিজ্ঞ, মাঝমাঠে আন্দ্রেস ইনিয়েস্তা ও জাভির মতো দুজন আছে৷ এই দলকে হিসাবের বাইরে রাখার কোনো সুযোগ নেই৷
সদ্য সমাপ্ত মৌসুমে বার্সেলোনা কোচ জেরার্ডো মার্টিনো ৩৪ বছর বয়সী জাভিকে প্রায়ই বসিয়ে রেখেছেন৷ তবে স্পেন কোচ ভিসেন্তে দেল বস্কের দর্শন ভিন্ন৷ তিনি জানেন, কার ওপর আস্থা রাখা যায়৷ উদাহরণ ইকার ক্যাসিয়াস৷ চ্যাম্পিয়নস লিগের ফাইনালে অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের বিপক্ষে যেভাবে খেলেছে, তেমনটা হলে ক্যাসিয়াসকে গোলে রাখাটা ঝুঁকিপূর্ণ ৷ কিন্তু আমার মনে হয় না ক্যাসিয়াস শেষ পর্যন্ত খারাপ করবে৷ আমার মতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো, রিয়ালের জাবি আলোনসোর এখনো মাঝমাঠে থাকা৷ ও দলকে এক সুতায় গেঁথে রাখতে পারে৷
স্পেন আবার শিরোপা জিতলে ফুটবল ইতিহাসে প্রথমবার বাইরের কোনো দল বিশ্বকাপ জিতবে দক্ষিণ আমেরিকায়৷ তবে সবকিছু ঠিকঠাক এগোলে, আমার ধারণা এই ইতিহাস গড়তে পারে জার্মানিও৷
স্পেন ও জার্মানির কথা বলছি মানে এই নয় যে ব্রাজিলকে গোনায় ধরছি না৷ ব্রাজিলের ক্ষেত্রে প্রত্যাশার চাপের সঙ্গে তরুণ দলটি কীভাবে ও কতটা মানিয়ে নিতে পারে সেটি গুরুত্বপূর্ণ৷ সময় যত গড়াবে, চাপ ততই বাড়বে৷ বার্সেলোনায় খেলে ইউরোপিয়ান ফুটবলের গতির সঙ্গে সড়গড় হয়ে অভিজ্ঞতা বাড়ানো নেইমারের বয়সটাও কিন্তু মাত্র ২২! এ জন্যই আমার মনে হয়, কাকাকে দলে রাখলে খুব ভালো হতো৷ আমি ঠিক নিশ্চিত নই ব্রাজিল দলের অন্য ফুটবলাররা এত চাপের সঙ্গে কতটা মানিয়ে নেবে৷ কতটা পারবে, দেখা যাবে খুব দ্রুতই, ‘এ’ গ্রুপে ওরা যখন ক্রোয়েশিয়া, মেক্সিকো ও ক্যামেরুনের সঙ্গে খেলবে৷ গ্রুপ চ্যাম্পিয়ন হলে ব্রাজিলও বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন হতে পারে৷
আর জার্মানি? চোটাঘাত নিয়ে কিছু দুশ্চিন্তা থাকলেও আমার মতে জার্মানি অন্যতম ফেবারিট৷ তবে ম্যানুয়েল নয়্যার, ফিলিপ লাম ও বাস্তিয়ান শোয়েইনস্টেইগারকে সময়মতো ফিট করে তোলাটা জরুরি৷ এই গ্রুপের ম্যাচগুলো রোমাঞ্চকর করে তুলবে দুর্দান্ত কিছু প্রতিদ্বন্দ্বিতাও৷ জার্মানি-ঘানা ম্যাচেই যেমন মুখোমুখি দুই ভাই৷ জার্মানির হয়ে নামবে বায়ার্ন মিউনিখের জেরোম বোয়াটেং৷ ঘানার হয়ে শালকের কেভিন-প্রিন্স বোয়াটেং৷ জার্মানি-যুক্তরাষ্ট্র ম্যাচে আবার দুই দলের কোচ দুই বন্ধু৷ জার্মানির জোয়াকিম লো এবং জার্মান দলেই তাঁর সাবেক বস এখনকার যুক্তরাষ্ট্র কোচ ইয়ুর্গেন ক্লিন্সমান৷ ক্লিন্সমান আবার উপদেষ্টা করে এনেছেন আরেক সাবেক জার্মান কোচ বের্টি ফোটসকে৷
জার্মানির গ্রুপসঙ্গী পর্তুগালের ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোকে নিয়ে পর্তুগালে যত আলোচনা হয়, তার চেয়ে বেশি হয় সম্ভবত জার্মানিতে৷ চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে অ্যাটলেটিকোর ফুটবলারদের বেশ কঠিন ট্যাকল ওকে ভালোই অস্বস্তিতে ফেলেছে৷ কেউ ওর কাছ থেকে বল কেড়ে নিলে ওর কাছে সেটা অপমান৷ ওকে দেখলেই এটা বোঝা যায়, সে যেন নিজেকে হারিয়ে ফেলে৷ জার্মান ফুটবলারদেরও লক্ষ্য হওয়া উচিত রোনালদোকে তার টেকনিক্যাল স্কিল দেখাতে না দেওয়া৷
কে জানে, হয়তো গোনার বাইরে থাকা কোনো দল দারুণ রোমাঞ্চ আর বিস্ময় উপহার দেবে! তেমন সম্ভাবনা যদিও আমি খুব একটা দেখছি না৷ ‘সি’ গ্রুপে কলম্বিয়া, জাপান, গ্রিস ও আইভরিকোস্টের যেমন বেশি দূর যাওয়ার সম্ভাবনা নেই৷ ‘এফ’ গ্রুপের আর্জেন্টিনা, ইরান, নাইজেরিয়া ও বসনিয়া-হার্জেগোভিনার মধ্যে আর্জেন্টিনা পরিষ্কার ফেবারিট৷ মেসি ফিট ও ছন্দে থাকলে আর্জেন্টিনাও অনেক দূর যেতে পারে৷
‘এইচ’ গ্রুপের বেলজিয়ামকে এবার বলা যায় বিশ্বকাপের ‘ডার্কহর্স’৷ দেখা যাক দক্ষিণ কোরিয়া, আলজেরিয়া ও রাশিয়ার বিপক্ষে সম্ভাবনার কতটা দেখাতে পারে ওরা৷ আমার ধারণা, অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদের হয়ে যে জাদু দেখিয়েছেন গোলকিপার থিবো েকার্তোয়া, বেলজিয়ামের জার্সিতেও তেমন কিছু দেখাবে৷
‘ই’ গ্রুপে ইকুয়েডর ও হন্ডুরাসের বিপক্ষে খুব একটা সমস্যা হওয়ার কথা নয় ফ্রান্সের৷ আমি সাগ্রহে দেখব সুইজারল্যান্ডের বিপক্ষে ফরাসিরা কেমন করে৷ সুইসদের বিপক্ষে ওদের জেতাই উচিত৷
এই তো, এবার বল মাঠে গড়ানোর পালা৷ প্রথম তিন সপ্তাহ আমাকে টেনেহিঁচড়েও টিভির সামনে সোফা থেকে টেনে তোলা যাবে না!