এটি নাকি বিশ্বকাপ-নগর!

সাম্বার দেশে বিশ্বকাপ
সাম্বার দেশে বিশ্বকাপ

এমিরেটসের ফ্লাইটটা কি ভুল এয়ারপোর্টে নেমে পড়ল নাকি! এটা সাও পাওলোই তো! তাহলে এমন কেন? বিশাল টার্মিনাল একেবারে সুনসান। কেমন যেন একটা ভুতুড়ে-ভুতুড়ে আবহ।
ইমিগ্রেশন পার হওয়ার পর সংশয়টা বাড়ল বৈ কমল না। বিশাল জায়গা খালি পড়ে আছে, কোথাও কিচ্ছু নেই। যেকোনো ট্যুরে গেলে বিমানবন্দরে নেমেই মোবাইলের সিম কার্ড, ইন্টারনেট মডেম এসব কেনার কাজটা সেরে ফেলি। এখানে দোকানপাট বলে তো কিছুই দেখছি না । তা না থাকুক, কিন্তু চার দিন পর যে শহরে বিশ্বকাপ ফুটবল নামে মহাযজ্ঞের উদ্বোধন, সেই শহরের বিমানবন্দরে বিশ্বকাপের কোনো চিহ্ন থাকবে না! সেটিও নেই।
দুবাই-সাও পাওলো ফ্লাইটে ভাগ্যক্রমে পাশের সিটেই পেয়ে গেছি সাও পাওলোর এক ভদ্রলোককে। কাগজের ব্যবসার কাজে বছরে দু-তিনবার চীন যাওয়া-আসা করতে হয়। সেখান থেকেই ফিরছেন। বিস্ময়ের উত্তর মিলল তাঁর কাছ থেকে। সপ্তাহ দুয়েক আগে নতুন এই টার্মিনালের উদ্বোধন করা হয়েছে। দোকানপাট সব পুরোনো টার্মিনালে।
উত্তর মিলল, আবার মিললও না। বিশ্বকাপ উপলক্ষেই নির্মিত যে টার্মিনাল, সেটিতে একটা বিশ্বকাপ-বিশ্বকাপ ভাব থাকবে না! বিমানবন্দর থেকে হোটেলে আসার পথেই বা বিশ্বকাপ কই! রাস্তার দুই পাশে বিশাল কিছু বিলবোর্ড দেখলাম। কোনোটাতে নেইমার, কোনোটায় থিয়াগো সিলভা, কোনোটাতে বা ব্রাজিল দল। অবশ্যই বিশ্বকাপ সামনে রেখে করা। তবে তাতে বিশ্বকাপ আয়োজকদের কোনো ভূমিকা নেই। ওই সব বিলবোর্ড স্যামসাংয়ের বিজ্ঞাপনী কার্যক্রমের অংশ।
দেশে থাকতে সাও পাওলো-রিও ডি জেনিরোর এমন সব ছবি দেখে এসেছি, যা দেখে মনে হয়েছে বিশ্বকাপ-জ্বরে রীতিমতো কাঁপছে ব্রাজিল। রাস্তার দুই পাশে কৌতূহলভরে তাকাচ্ছি আর বিস্ময় ক্রমেই বাড়ছে—কোথায় বিশ্বকাপ! জানা না থাকলে তো কারও বোঝারই উপায় নেই যে, এটা সাও পাওলো। সাও পাওলোমুখী প্লেনে বসে যে বিশ্বকাপ-বিশ্বকাপ ভাব এসেছিল, সেটিও যে প্রায় উধাও হয়ে যাওয়ার জোগাড়!
বিশ্বকাপের স্পনসর বলে এমিরেটসের প্লেনের গায়ে ব্রাজিল ২০১৪ লোগো আঁকা। প্লেনে ঘোষণা-টোষণায় অবশ্য বিশ্বকাপ প্রসঙ্গ একবারও উঠল না। তার পরও বিশ্বকাপ-বিশ্বকাপ যে ভাবটার কথা বলছি, সেটির মূলে ক্রিস্টিয়ান নামে ২৩ বছর বয়সী এক স্টুয়ার্ট। পাশের যাত্রীর সঙ্গে পর্তুগিজে কথা বলতে শুনে ব্রাজিলিয়ান ভেবেছিলাম। নিশ্চিত হতে জিজ্ঞেস করে জানলাম, অর্ধেক ব্রাজিলিয়ান, অর্ধেক আর্জেন্টাইন। ব্রাজিলিয়ান বাবা ও আর্জেন্টাইন মায়ের সন্তান অবশ্য নিজেকে আর্জেন্টাইন বলেই দাবি করেন। সাড়ে পনেরো ঘণ্টার লম্বা ফ্লাইট ক্রিস্টিয়ানের সঙ্গে আড্ডারও সুযোগ করে দিল। শৈশব-কৈশোর সাও পাওলো ও বুয়েনস এইরেসে ভাগাভাগি করে কেটেছে। বিশ্বকাপ এলে ক্রিস্টিয়ানের পরিবারও এমন ভাগ হয়ে যায়। নয় ভাইয়ের পাঁচ ভাই আর্জেন্টিনার সমর্থক, চার ভাই ব্রাজিলের।
এ তো দেখছি বাংলাদেশের মতো অবস্থা! ক্রিস্টিয়ানকে তা বলতে শুরু করতেই ও থামিয়ে দিল, ‘আমি জানি।’ পেশার কারণে ঢাকায় যাওয়া-আসা আছে। বিশ্বকাপের সময় বাংলাদেশের আকাশ ব্রাজিল ও আর্জেন্টিনার পতাকায় ছেয়ে যাওয়ার ব্যাপারটা তাই তাঁর জানা। পরিবার-পরিজনের কাছে সেই গল্পও করেছেন। যেটির মূল সুর প্রকাশ পেল ‘ইটস ক্রেজি’ কথাটাতে।
এয়ারপোর্ট থেকে হোটেলে আসার পথে বিশ্বকাপের কোনো চিহ্ন না দেখে ভেবেছিলাম, এত বড় শহর, কোনো কারণে হয়তো এই অংশটা বাদ পড়ে গেছে। গত পরশু সকালে হোটেল থেকে উদ্বোধনী ম্যাচের ভেন্যু অ্যারেনা করিন্থিয়ানসে যেতে যেতে এই ব্যাখ্যাটাও আর টিকল না। স্টেডিয়ামের একেবারে কাছাকাছি গিয়ে প্রথম মনে হলো, না, বিশ্বকাপের উদ্বোধনী ম্যাচটা এই শহরেই। রাস্তার দুই পাশে বিশ্বকাপ আর ফুটবলকে উপজীব্য করে ব্রাজিলের বিখ্যাত সেই দেয়ালচিত্র। হলুদ-সবুজ রঙের ছড়াছড়ি।
অ্যাক্রিডিটেশন কার্ড তোলার প্রথম কাজটা সেরে মিডিয়া সেন্টারের দিকে হাঁটছি। রোদে গা পুড়ে যাচ্ছে আর স্যুটকেস ভরিয়ে তোলা শীতবস্ত্রগুলোর কথা ভেবে হাসি পাচ্ছে। ব্রাজিলে এখন শীতকাল, ইন্টারনেটে দেখেছি সাও পাওলোতে ১০ ডিগ্রির আশপাশে তাপমাত্রা। সেটি নাকি আবার হুট করে নেমে যায়। যে রাতে রওনা হব, সেদিন সকালে এক শুভার্থী ফোন করে জানালেন, ‘সাও পাওলোতে কিন্তু তাপমাত্রা কখনো কখনো শূন্য ডিগ্রিও হয়ে যায়। তুষারপাতও হয়।’ যে ফোন পাওয়ার পর স্যুটকেসে আরও শীতবস্ত্র ঢুকল। সাও পাওলোতে নামার আগে পাইলট যখন তাই তাপমাত্রা ২৮ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড বলে ঘোষণা করলেন, মনে হলো ভুল শুনলাম না তো! নিশ্চিত হতে পাশের সিটের সাও পাওলোবাসীকে জিজ্ঞেস করলাম। তুষারপাতের কথা শুনে যিনি রীতিমতো অট্টহাসি দিলেন, ‘আমি ১৬ বছর সাও পাওলোতে আছি। তুষারপাত দেখার সৌভাগ্য হয়নি।’
খুশিই হলাম। শীত ভালোই লাগে, কিন্তু শরীরে জাব্বাজোব্বা পরে বেরোতে হয়, এমন তীব্র শীত আমার ঘোর অপছন্দ। ঝুপ করে সন্ধ্যা নেমে আসাটাও। এটি অবশ্য মেনে নিতেই হচ্ছে। ঘড়ির কাঁটা সাড়ে ৫টার আশপাশে যেতেই আঁধার নেমে আসে সাও পাওলোতে।
আজ এটুকুই থাক। ব্রাজিলে আসার পর থেকে শরীর-ঘড়ি ওলটপালট হয়ে যাওয়ায় নিদ্রা-জাগরণের সময় বদলে যাওয়ার চেয়েও বড় যে সমস্যায় পড়েছি, সেই প্রসঙ্গ না হয় আরেক দিনের জন্য তোলা থাকুক। সেই সমস্যার নাম ভাষা। যা প্রতি মুহূর্তে আফসোসে পোড়াচ্ছে, ব্রাজিলে আসার আগে পর্তুগিজ ভাষাটা অবশ্যই শিখে আসা উচিত ছিল।
সাও পাওলো
৯ জুন, ২০১৪