ক্লান্তি তত্ত্ব কাজে লাগাল জার্মানি

প্রতিপক্ষকে ক্লান্ত করে আসল সময়ে ছোবল মারাই বুদ্ধিমানের কাজ। এ মন্ত্র জপেই আলজেরিয়া–বাধা পার হলো জার্মানি। অঙ্কটা নির্ধারিত সময়ে হয়তো মেলেনি। জার্মানিকে যেতে হয়েছে অতিরিক্ত সময় পর্যন্ত। তাতে কী, শেষ বিচারে ক্লান্তির কাছেই হেরেছে গ্রুপপর্বে চোখকাড়া আলজেরিয়া।
ইউরোপ আর আফ্রিকার বড় পার্থক্য উদ্যমে। ইউরোপিয়ানরা শেষ মিনিট পর্যন্ত একই দমে খেলতে পারে। আফ্রিকা কেন জানি মনে হয় শেষ কয়েক মিনিট ম্যাচ ছেড়ে দেয়। আলজেরিয়ার অবস্থাও তেমন দেখলাম। যদিও এই আলজেরিয়াকে প্রথম ম্যাচে দেখেই বলেছিলাম, ওরা ইউরোপ আর লাতিন আমেরিকার মিশ্রণ। বেশির ভাগ খেলোয়াড়ই ফ্রান্সে বেড়ে ওঠে। যেমনটা আলজেরিয়ান বংশোদ্ভূত জিনেদিন জিদান ফ্রান্সে বেড়ে ওঠেন এবং একসময় মহানায়কের আসনে বসে যান ফরাসি ফুটবলে। জিদান নিশ্চয়ই দেখে থাকবেন আলজেরিয়ার খেলা। তাঁর ভালোই লাগার কথা। কিন্তু সহ্যশক্তির সমস্যায় পড়ে আলজেরিয়া এভাবে হারবে নিশ্চয়ই ভাবতে পারেননি। একই সঙ্গে মানসিক ক্লান্তিও আলজেরিয়াকে গ্রাস করেছে শেষ দিকে।
ইউরোপিয়ানরা এ সমস্যা থেকে মুক্ত। শেষ সেকেন্ড পর্যন্ত লক্ষ্য থেকে তারা একবিন্দু সরে না। চতুরতার দিক থেকেও ইউরোপ এগিয়ে। জার্মানি যেমন আলজেরিয়া ম্যাচে বল পজেশন রেখে খেলার পাশাপাশি একটা মন্ত্র জপল সারাক্ষণ, প্রতিপক্ষকে খেলতে দেওয়া যাবে না। সামনেই আটকে দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল সম্ভবত। সেটা করতে গিয়ে জার্মানির রক্ষণ এত ওপরে উঠে যায়, যা কিনা ব্যতিক্রম।
জার্মান গোলরক্ষক নয়্যার বেশ কয়েকবার বক্সের বাইরে চলে এলেন। তাঁকে একজন সুইপারের মতোই দেখাচ্ছিল। একজন গোলরক্ষক এভাবে বারবার পোস্ট ছেড়ে ওপরে উঠলে দলের ক্ষতি হতে পারে। সেটা নিশ্চয়ই জার্মান কোচ জোয়াকিম লোর জানা ছিল। কিন্তু তিনি এটা অনুমোদন করলেন কেন, বুঝলাম না। হয়তো প্রতিপক্ষকে সামনে ব্লক করে দেওয়ার পরিকল্পনা ছিল। যে কারণে জার্মান রক্ষণ এ ম্যাচে অনেক ওপরে। কোনো রক্ষণকে এত সামনে গিয়ে খেলতে কমই দেখা যায়।
আলজেরিয়ার গোলরক্ষকের জন্য খারাপই লাগছিল। বেচারা এত ভালো খেলেও শেষ পর্যন্ত হারলেন। পরশু নাইজেরিয়ার গোলরক্ষকও দারুণ বিশ্বস্ত ছিলেন পোস্টের নিচে। দুই গোলরক্ষক ভালো খেলেও পরাজিত দলে। আসলে ফুটবলে একা গোলরক্ষকের পক্ষে ম্যাচ জেতানো খুবই কঠিন। গোটা দলটাকে খেলতে হবে, সেখানেই মারটা খেল নাইজেরিয়া।
অথচ সুপার ইগলদের সবই ঠিক ছিল। কিন্তু উদ্ভাবনী ক্ষমতার অভাব তাদের দৌড় থামিয়ে দিয়েছে। বিশেষ করে মাঝমাঠে আরেকটু মেধা কাজে লাগাতে পারত। তার পরও দ্বিতীয়ার্ধের কিছু সময় নাইজেরিয়াকে বেশ ক্ষুরধার দেখাচ্ছিল। এরপর ফ্রান্স খেলাটা এমনভাবে নিয়ন্ত্রণে নিয়েছে, জয় তুলেই মাঠ ছাড়ল। গোল পাওয়ার কিছু সময় আগ থেকে ফ্রান্সের আক্রমণভাগ খুব ভালো কাজ করেছে, মাঝমাঠে তখন তরুণ পগবা দুরন্ত। এ সময় বাতাসে বল দখলে ফ্রান্সকে হারাতে পারছিল না বড় শরীরের নাইজেরিয়ানরাও। ফরাসিরা বলে পায়ে সংযোগ ঘটাচ্ছিল সুন্দরভাবে।
ফ্রান্স অভিজ্ঞ দল। মাঝমাঠ থেকে দ্রুতগতির আক্রমণ গড়ল এদিন। আসলে এমন ম্যাচ কীভাবে জিততে হয়, তা ভালোই জানা ফরাসিদের। নাইজেরিয়াকে শেষ দিকে বিভ্রান্ত লাগল। আমার মনে হয়, মনঃসংযোগ হারিয়েছে দলটি, গোলরক্ষক এনিয়েমা ভালো খেলতে খেলতে একটা ভুল করে বসলেন। প্রথম গোলটার সময় বল পাঞ্চ করে মাঠের বাইরে পাঠানো উচিত ছিল তাঁর। নাইজেরিয়ার গোলমুখ খোলার পর ফ্রান্সের দুই উইং হয়ে উঠল আরও সক্রিয়। দ্বিতীয় গোলটা ফ্রান্স পেল কর্নার থেকে আসা বলে। একটা ব্যাপার লক্ষণীয়, উইং, কর্নার, ফ্রি-কিক থেকে আসা সার্ভিসেই ব্রাজিল বিশ্বকাপ গোল দেখছে বেশি।
হিসাব করলে দেখা যাবে, পরশু পর্যন্ত দেড় শ ছাড়িয়ে যাওয়া গোলের ২০-২৫টিই সম্ভবত মাঝখান দিয়ে হয়েছে। বাকি গোল পাশ থেকে আসা সার্ভিসে। পাশ থেকে আসা বল অনেক সময় গোলরক্ষক ভালোভাবে বুঝতে পারেন না। ফ্লাইট ভুল হয়। বল সোজাসুজি থাকলে কোনো না কোনোভাবে ক্লিয়ার হয়ে যায় বেশি, গোলরক্ষকও বলের গতিবিধি বুঝতে পারেন। প্রসঙ্গটা তুললাম এই কারণে যে, নাইজেরিয়ার গোলরক্ষক পাশ থেকে আসা বল বুঝতে না পেরে গোল খেলেন, যদিও দ্বিতীয় গোলটা ছিল আত্মঘাতী—নাইজেরিয়ার এলেমেলো হয়ে পড়ারই ফল!