গানের ভুবনে টিটির মানস
জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারপ্রাপ্ত সংগীত শিল্পী উমা খান তাঁর পিসি। আরেক পিসি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শিল্পী কল্যাণী ঘোষ। বাবা প্রবাল চৌধুরী তো বিখ্যাত গায়ক। ‘আমি ধন্য হয়েছি ওগো ধন্য, তোমারি প্রেমেরই জন্য’, ‘লোকে যদি মন্দ কয়, সে তো নহে পরাজয়, ’ ‘ফুলের বাসর ভাঙল যখন স্মৃতি কেন বেদনার বাসর সাজায়’, ‘এই জীবন তো একদিন, চলতে চলতে থেমে যাবে...’এমন কত যে জনপ্রিয় গান গেয়েছেন প্রবাল চৌধুরী। সেই পরিবারের ছেলে গায়ক হবে না তো কে হবে?
মানস চৌধুরী গায়কই হয়েছেন। কিন্তু গায়ক-সত্তা ছাপিয়েও তাঁর আরও একটি বড় পরিচয় আছে। তিনি টেবিল টেনিসের জাতীয় চ্যাম্পিয়ন। সর্বশেষ চারটি প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ন হওয়া দুর্দান্ত এক খেলোয়াড়।
এই মুহূর্তে টেবিল টেনিসটা নিয়েই বেশ ব্যস্ত মানস। চলছে এসএ গেমসের ক্যাম্প। পল্টনের উডেন ফ্লোর জিমনেশিয়ামে পিংপং বল আর টিটি ব্যাট নিয়েই কাটছে চট্টগ্রামের অধিবাসী মানসের সময়। সেখানে বসেই তিনি বললেন, টিটি প্যাশন। কিন্তু গানটাই তাঁর জীবনের লক্ষ্য।
এ ব্যাপারে বেশ বাস্তববাদী মানস। খুব ভালো করেই জানেন খেলোয়াড়ি জীবনের সময়টা নির্দিষ্ট। খেলা ছেড়ে একদিন চলে যেতে হবে অবসরে। তাই গানটাকে যেন ভবিষ্যতের পাথেয় করতে পারেন, প্রস্তুতি নিচ্ছেন তারই। তাছাড়া প্রবাল চৌধুরী-পুত্র গানের ভুবন মাতাবে না, সেটা কীভাবে হয়!
প্রবাল-পুত্র বলেই কিনা গানের প্রতি আলাদা একটা টান, ‘গানের মাধ্যমেই বেঁচে থাকতে চাই। ঠিক আমার বাবার মতো।’
খেলার ভুবনে তিনি মানস। কিন্তু গানের ভুবনে এই নামে কেউ চেনেই না! মানসের ডাক নাম রঞ্জন। শিল্পী হিসেবে সবার কাছে রঞ্জন নামেই পরিচিত। সেই অর্থে ওস্তাদ ধরে গানে হাতেখড়ি হয়নি মানসের। শুরুর দিকে বন্ধুদের আড্ডায় গুনগুনিয়ে গাইতেন। বন্ধু সলিল, সাজ্জাদদের হাততালিও মিলত বিস্তর। কিন্তু একদিন তাঁর গানের গলা ঠিকই কানে ধরল সুরকার প্রণব ঘোষের। মানসকে ডেকে বললেন, ‘তোমাকে দিয়েই হবে।’ ,
২০০১ সালে প্রথম প্লেব্যাক করলেন একটি চলচ্চিত্রে। গলায় নিলেন কবির বকুলের লেখা গান ‘ভালোবাসা বড় কষ্টের।’ সুরকার ছিলেন আলাউদ্দিন আলী। কেমন ছিল গায়ক হিসেবে তাঁর শুরুর অভিজ্ঞতা?
মানস শোনালেন এক মজার ঘটনা। রেকর্ডিং স্টুডিওতে এসে দেদারছে ঘামতে লাগলেন মানস। লজ্জায় জড়সড় হয়ে যাচ্ছিলেন। গানটা কেমন গাইবেন সেটা ভেবে নয়, বরং গাইতে হবে যার সঙ্গে সেই শিল্পীর কথা ভেবেই এমন অবস্থা। গানের আরেকজন শিল্পী ছিলেন তারই আপন পিসি উমা খান! মূলত গানের কথাগুলো সাজানো প্রেমিক-প্রেমিকার জন্য, সেটা ভেবেই যত লজ্জা। সেই অভিজ্ঞতার কথা মনে হলে এখনো হাসি পায় মানসের, ‘আমি তো বিব্রতকর অবস্থায় পড়লাম। যতই পিসি বোঝান, সুরকার বোঝান আমি আর সহজ হতে পারি না। এরপর চোখ বন্ধ করে গাইলাম। বিশ মিনিটেই রেকর্ডিং শেষ।’
ছেলের প্রথম গান রেকর্ডিং দেখতে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় এসেছিলেন বাবা প্রবাল চৌধুরী। সেদিনের স্মৃতি আজও মনে আছে মানসের, ‘বাবা গান শুনে বললেন, ভালোই হয়েছে। নিজের ছেলে হিসেবে নয়, শিল্পী হিসেবেই সমালোচনা-প্রশংসা করতেন বাবা।’
ছয় বছর আগে বাবাকে হারিয়েছেন। কিন্তু বাবার ছায়াটা এখনো অনেকেই খোঁজেন মানসের মধ্যে। বাবাকে নিয়ে স্মৃতির ঝাঁপি খুলে দিলেন তিনি। হয়ে পড়লেন একটু আবেগাপ্লুত, ‘আমরা দুই ভাই গান করি। কিন্তু বুঝতাম, বাবা পছন্দ করেন আমাকেই। উনি চাইতেন যেন আমি নিয়মিত গান করি। বাবা নিজেও যখন গান রেকর্ডিং করতেন, আগে আমাকে শোনাতেন। বাবার ধারণার আমার কান অনেক পরিষ্কার।’
একটি বেসরকারি টেলিভিশন চ্যানেলে সম্প্রতি সরাসরি অনুষ্ঠানে গান গেয়েছেন। আরেকটি চ্যানেলে শিল্পী কনকচাঁপার উপস্থাপনায় হয়েছিল ‘উত্তরাধিকার’ অনুষ্ঠান। সেখানে প্রয়াত বাবার ৯টি জনপ্রিয় গান গেয়েছিলেন মানস। গানগুলো যেন ছিল বাবার প্রতি এক ছেলের অর্ঘ্য।
এ পর্যন্ত মানসের একক অ্যালবাম বেরিয়েছে চারটি—জীবন সাথি, আজ তুমি অন্যের হলে, কত আর কাঁদাবে তুমি। মাস তিনেক আগে বেরিয়েছে জীবন কাব্য। এই অ্যালবামে বাবা প্রবাল চৌধুরীর গাওয়া চারটি গান গেয়েছেন—‘আমি ধন্য হয়েছি ওগো ধন্য’, ‘আমি মানুষের মতো বাঁচতে চেয়েছি, ’ ‘এই জীবন তো একদিন, চলতে চলতে থেমে যাবে, ‘ফুলের বাসর ভাঙল যখন . ।’ গানে কোনো ধরনের আধুনিক সরঞ্জাম ব্যবহার করেননি তিনি। মানসের ভাষায়, ‘বাবার ফ্লেভারটা রেখে দিয়েছি। আমি আসলে সব সময়ই বাবার গান গাওয়ার চেষ্টা করি। জানি, বাবার মতো তো আর হবে না। বাবাকে আমার মতো করে অনুভব করে নিই।’ একক অ্যালবাম বের হওয়ার পর ওস্তাদ খন্দকার নুরুল আলম, সঞ্জীব দে, প্রণব ঘোষ, আলী হোসেনের কাছে গান শিখেছেন মানস।
ও হ্যাঁ, মানসের আরেকটি পরিচয় তো দেওয়ায় হয়নি। পেশায় তিনি দন্ত চিকিৎসক। চট্টগ্রামেই চেম্বার। গান আর খেলা একই সঙ্গে মেলাতে গিয়ে বেশি সমস্যা হয় সূচি নিয়ে। ইদানীং পত্রিকায় খেলার পাতায় ছবি ছাপা হয়। টেলিভিশনেও নিয়মিত গাইছেন। চেম্বারে রোগী এলে অনেক সময় দ্বিধায় পড়েন। তেমনই এক ঘটনা বললেন মানস, ‘একদিন টিভিতে আমার গান বাজছে। তখন একজন রোগী এলেন। টিভিতে আমাকে দেখে বললেন, উনি কে? আমি বললাম, আমার যমজ ভাই।’ মজা করে না, সত্যি সত্যিই নিজের পরিচয় লুকিয়েছিলেন তিনি, ‘আমাদের দেশের মানুষ এখনো এটা ভাবে যে ডাক্তার কীভাবে গায়ক হয়, খেলোয়াড় হয়?’
দেশের হয়ে এসএ গেমসে দলগত ব্রোঞ্জ জিতেছেন টিটিতে। খেলেছেন টিটি বিশ্বকাপে, কমনওয়েলথ গেমসে, এশিয়ান গেমসে। দেশের বাইরে গেলেই আড্ডায় খুলে বসতে হয় ‘অনুরোধের আসর গানের ডালি।’
খেলা বা গান কোনোটাকেই পেশা হিসেবে নিতে পারেননি। বাস্তবতা মাথায় রেখেই বললেন, ‘জীবিকার প্রয়োজনে ডাক্তারি করা। নইলে আমি ডাক্তারি করতাম না। মনের আনন্দেই গান গাই।’ এখনো প্রতিদিন জিমনেশিয়ামে যান খেলার অনুশীলন করতে, সকালে উঠেই রেওয়াজ করেন গানের। এখনো মনের অজান্তেই গলা ছেড়ে গেয়ে ওঠেন, ‘বাউলা কে বানাইলো রে, হাসন রাজার বাউলা কে বানাইলো রে...’।