ডিসেম্বরে রক্তে আগুন জ্বলে মজিদুলের

জাতীয় দলের জার্সিতে (দাঁড়িয়ে, বাঁ থেকে তৃতীয়)।ছবি: সংগৃহীত

তারিখটা তাঁর ঠিক মনে নেই। তবে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের প্রথম সপ্তাহের সেই দিনটির কথা ভুলতে পারেননি মজিদুল ইসলাম। বীর মুক্তিযোদ্ধা মজিদুল সেদিন অল্পের জন্য বেঁচে গিয়েছিলেন।

স্বাধীনতার ৪৯ বছর পরও ভয়ংকর সেই স্মৃতি মনে পড়লে গা শিউরে ওঠে তাঁর, ‘পাকিস্তান সেনাবাহিনীর একটি গাড়ি সেদিন পাবনা শহরে ঢুকে গিয়েছিল। আমরা ছয়জন মিলে তাদের আক্রমণ করি। অপারেশনটা হয়েছিল আমারই নেতৃত্বে। কারণ, ছয়জনের মধ্যে সবচেয়ে ভারী অস্ত্র এলএমজি ছিল আমার কাছে।’ অপারেশনে পাকিস্তানি সেনাদের সবাই মারা গেছে, এমনটাই ভেবে নিয়েছিলেন মজিদুল আর তাঁর সঙ্গীরা। ভাবনাটা ছিল ভুল। মজিদুল বলেন, ‘একজন যে বেঁচে ছিল, আমরা বুঝতে পারিনি। আনন্দে আমাদের এক মুক্তিযোদ্ধা আবদুল মান্নান আকাশের দিকে ফাঁকা গুলি ছুড়তে শুরু করে। হঠাৎই পেছন থেকে একটা গুলি এসে আমার কানের পাশ দিয়ে চলে যায়। গুলিটি বিঁধেছিল মান্নানের বুকে। সেখানেই শহীদ হয় মান্নান।’

ডিসেম্বর শুধু একটি মাসের নাম নয়, মজিদুলের কাছে এ যেন রক্তে আগুন লাগা স্মৃতি, ‘এই মাসটা এলেই কত কথা যে মনে পড়ে! বিজয়ের পর আমার কাছে অনেক অতিরিক্ত বুলেট ছিল, সেগুলো দিয়ে ফাঁকা গুলি ছুড়তাম। মানুষ আমাদের দেখলেই জয় বাংলা স্লোগান দিত। মাসটা এলে আমার রক্তে কী যেন ঘটে যায়।’ বীর মুক্তিযোদ্ধা মজিদুলের আরেক পরিচয় তিনি ফুটবলার। বাংলাদেশ দলের হয়ে খেলেছেন। অ্যাথলেটিকসেও ছিল দক্ষতা। ছিলেন পাবনা জেলা হকি দলের অধিনায়কও।

মজিদুল ইসলাম

পাবনা শহরের কাচারিপাড়ায় বাড়ি। বাড়ির পাশেই পাবনা জিলা স্কুল। মজিদুল ছিলেন সেই স্কুলের দশম শ্রেণির ছাত্র। মাত্র ১৬ বছর বয়সে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ শুনে মজিদুল এতটাই মোহাবিষ্ট হয়ে পড়েছিলেন যে তখন থেকেই যুদ্ধে যাওয়ার প্রস্তুতি শুরু করেন। বয়স কম বলে যুদ্ধে যাওয়ার অনুমতি মিলছিল না। এপ্রিলের শুরুতে মজিদুল বাড়ি থেকে পালিয়ে চলে যান ভারতে। কিন্তু ভারতে গিয়েও ট্রেনিং নিতে পারেননি। ফিরে আসেন দেশে। জুনে আবার গিয়ে সফল হন, ‘জুনে গেলাম ভারতের দেরাদুনে। সেখানে ট্রেনিং নিয়ে ফিরে ৭ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করি।’

দুবার পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণ থেকে বেঁচে যান মজিদুল। বলছিলেন সেই গল্প, ‘তখন ঈশ্বরদীতে থাকি। খবর পেয়ে পাকিস্তানি সেনারা ওই গ্রামে আমাকে ধরতে ঢুকে পড়ে। স্থানীয় মানুষের সাহায্যে পালাতে পারলেও যে বাড়িতে থাকতাম, সেটা ওরা জ্বালিয়ে দিয়েছিল।’ আরেকবার মজিদুলের খবর পাবনা সদরের আলবদর ও রাজাকার বাহিনীর মাধ্যমে পৌঁছে যায় পাকিস্তানি সেনাদের কাছে। বাড়ি ছেড়ে মজিদুলের পরিবারের সবাই পালিয়ে গেলেও পাকিস্তানি সেনারা তাঁদের বাড়ি জ্বালিয়ে দেয়।

ছোটবেলা থেকেই মজিদুল ছিলেন খেলাপাগল। পাবনা ফুটবল লিগে খেলতেন। আন্তজেলা যুব দলে খেলার সুবাদে পরিচয় হয় ঢাকার ওয়াপদা ক্লাবের ফুটবলার বাচ্চু রহমানের সঙ্গে। মজিদুলকে ঢাকায় আনেন বাচ্চু। ওয়াপদার কোচ ছিলেন স্কটল্যান্ডের স্যান্ডি। অনুশীলনে পারফরম্যান্স দেখে তিনিই মজিদুলকে সিনিয়রদের সঙ্গে খেলার সুযোগ করে দেন। স্টপার মজিদুল খেলেন ওয়াপদা, আজাদ স্পোর্টিং, ব্রাদার্স, আবাহনী, মোহামেডান, রহমতগঞ্জ ও চট্টগ্রাম কাস্টমসে। জাতীয় দলে খেলেন ১৯৮০ থেকে ১৯৮৪ সাল পর্যন্ত। ফুটবল খেলার সুবাদেই কাস্টমসে চাকরি। ২০১৫ সালে যান অবসরে। বর্তমানে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত। সুযোগ পেলেই বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে চলে যান ফুটবল দেখতে। জামাল ভূঁইয়া, মামুনুল ইসলামরা যখন গেয়ে ওঠেন ‘আমার সোনার বাংলা, আমি তোমায় ভালোবাসি...’, মজিদুলের গায়ের পশম দাঁড়িয়ে যায়।

এই গানকে ভালোবেসেই তো একদিন যুদ্ধে গিয়েছিলেন তাঁরা!