দাবায় দাবিয়ে রাখা যাচ্ছে না ওঁদের!

এশিয়ান জোনাল দাবার দুই চ্যাম্পিয়ন শিরিন ও ফাহাদ
এশিয়ান জোনাল দাবার দুই চ্যাম্পিয়ন শিরিন ও ফাহাদ
এশীয় জোনাল দাবায় অনেক অর্জন বাংলাদেশের। এখানে চ্যাম্পিয়ন হয়ে ফিদে মাস্টার থেকে সরাসরি আন্তর্জাতিক মাস্টার হয়েছেন ফাহাদ রহমান। এখন বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক মাস্টার চারজন, একজন আবার যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী। নারী বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হয়ে শারমীন সুলতানা শিরিন নারী বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পেয়েছেন। নারী বিশ্বকাপে এর আগে খেলেছেন বাংলাদেশের মাত্র দুই দাবাড়ু


দেশের নিস্তরঙ্গ দাবা ১১ বছর ধরে ষষ্ঠ গ্র্যান্ডমাস্টারের অপেক্ষায় আছে। সর্বশেষ ২০০৮ সালে এনামুল হোসেন রাজীব গ্র্যান্ডমাস্টার হওয়ার পর বিরাট শূন্যতা। এক জায়গাতেই ঘুরপাক খাচ্ছেন অন্যরা। দেশে আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট তেমন নেই। বড় আকারে জিএম টুর্নামেন্ট হয়েছে সেই ২০০৯ সালে।


৯ বছর পর এশিয়ান জোনাল দাবা ৩.২ বিভাগের খেলা তাই যেন একটু উৎসবের হাওয়া লাগিয়ে গেল। ভারতবিহীন দক্ষিণ এশিয়ার বাকি ছয় দেশের এই টুর্নামেন্টে ৬৪ জনের ৫৮ জন প্রতিযোগীই ছিলেন স্বাগতিক বাংলাদেশের। নেপাল ও শ্রীলঙ্কার তিন তিন করে ছয়জন। ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে পরশু শেষ হওয়া টুর্নামেন্টে তাই বাংলাদেশিদেরই হয়েছে জয়জয়কার।

এই টুর্নামেন্টটি বাংলাদেশের দাবার জন্য নতুন আলো জ্বেলেছে। এখানে চ্যাম্পিয়ন হয়ে ফিদে মাস্টার থেকে সরাসরি আন্তর্জাতিক মাস্টার হয়েছেন ফাহাদ রহমান। মিনহাজ উদ্দিন সাগরকে দিয়ে বাংলাদেশ সর্বশেষ আন্তর্জাতিক মাস্টার পেয়েছে ২০১২ সালে। ২০১১ সালে হন আবু সুফিয়ান। এখন বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক মাস্টার চারজন। তাঁদের একজন যুক্তরাষ্ট্রপ্রবাসী জিল্লুর রহমান চম্পক।
তবে এই জোনাল দাবায় চ্যাম্পিয়ন হয়ে মাত্র ১৬ বছর বয়সে দেশের সর্বকনিষ্ঠ দাবাড়ু হিসেবে ফাহাদ খেলবেন আগামী সেপ্টেম্বরে রাশিয়ায় দাবা বিশ্বকাপে। ফাহাদই আগামী বিশ্বকাপে সর্বকনিষ্ঠ দাবাড়ু হবেন কি না, সেই আলোচনা আছে দাবা ফেডারেশনে।
এখানে নারী বিভাগে চ্যাম্পিয়ন হয়ে শারমীন সুলতানা শিরিন নারী বিশ্বকাপে খেলার সুযোগ পেয়েছেন। নারী বিশ্বকাপে এর আগে শামীমা আক্তার লিজা দুবার ও রানী হামিদ একবার খেলেছেন। অথচ বিশ্বকাপের টিকিট পাওয়ার পথে শিরিন নেপালের লোহানি সুজানার কাছে হার দিয়ে শুরু করেছিলেন এই টুর্নামেন্টে। এরপর ৭ জয়, ১ হার, ১ ড্র। সেই সুবাদে তাঁর রেটিং বেড়েছে ২৩ এবং বাংলাদেশের তৃতীয় আন্তর্জাতিক মহিলা মাস্টার হয়েছেন।
সর্বশেষ ২০১১ সালে এই এশিয়ান জোনালে চ্যাম্পিয়ন হয়েই লিজা আন্তর্জাতিক মহিলা মাস্টার হন। ১৯৮৫ সালে নর্ম করে প্রথম এই খেতাব পান রানী হামিদ। এই টুর্নামেন্টে ভালো করতে পারলে নাজরানা খান ইভা আন্তর্জাতিক মহিলা মাস্টার হতে পারতেন। দুটি আইএম নর্ম আছে তাঁর। জাকিয়া সুলতানারও একটি আইএম নর্ম আছে। এই টুর্নামেন্টে তনিমা পারভীন আন্তর্জাতিক মাস্টার্স নর্ম করেছেন। টুর্নামেন্টে রানারআপ স্কুলছাত্রী নওশীন আঞ্জুম ফিদে মাস্টার হয়েছেন এবং একটি আইএম নর্মও করেছেন। এ ছাড়া ক্যান্ডিডেট মাস্টারসহ আরও কিছু সাফল্য যোগ হওয়ায় এই টুর্নামেন্ট বাংলাদেশের অর্জনের খাতাটা বেশ ভারীই।
২০০০ সালে দাবায় আসা শিরিন ১৯ বছর পর হলেও একটা জায়গায় এসে দাঁড়ালেন। এত দীর্ঘ সময় লাগার পেছনে দেশের দাবার ভঙ্গুর কাঠামোর দায়ই বেশি। ২০১৭ সালে তৃতীয়বারের মতো সর্বশেষ জাতীয় চ্যাম্পিয়ন হওয়ার আগে ২০১৩ সালে ফিদে মাস্টার হন শিরিন। আন্তর্জাতিক মহিলা মাস্টার হতে ছয় বছর লাগল তাঁর। শিরিন বলেন, ‘আমাদের উঠে আসার সময়ে ভালো সুযোগ-সুবিধা পেলে এত সময় লাগত না। টুর্নামেন্ট ঠিকমতো না হলে আমরা হতাশ হই।’ বাগেরহাটের মেয়ে শিরিন নারায়ণগঞ্জের বিবি মরিয়ম বালিকা উচ্চবিদ্যালয়ে খেলতে খেলতেই জাতীয় মঞ্চে চলে আসেন। ২০১০ সাল থেকে সব কটি অলিম্পিয়াডে খেলেছেন। এখন যে কজন নারী দাবাড়ু নিয়মিত খেলেন, শিরিন তাঁদেরই একজন। লড়াকু মানসিকতা আছে তাঁর।
এর আগে নেপাল বা শ্রীলঙ্কায় এই জোনাল দাবা যখন হয়েছে, বাংলাদেশ থেকে বেশি খেলোয়াড় যেতে পারেননি খরচের কারণে। এবার ঢাকায় হওয়ায় সুবিধা হয়েছে। শিরিন বলেন, ‘আমরা এখানে অনেক বেশি দাবাড়ু অংশ নিয়েছি। অনেকে নর্ম করেছি। এই টুর্নামেন্ট দেশে হলে ভালো হবে।’ তাঁর কথা, ‘হাতে গোনা যে কজন মেয়ে দাবায় আসে, কিছুদিন পর ওরা আগ্রহ হারিয়ে ফেলে। কারণ সমস্যা অনেক। মহিলাদের জন্য অর্থ পুরস্কারও তেমন নেই। আমাদের সুযোগ-সুবিধা দরকার।’
ফাহাদ ইউরোপে সুপার জিএমের কাছে অনুশীলন-সুবিধা চান, ‘আমার এখন বড় চাওয়া ইউরোপে খেলা, অনুশীলন করা। তাহলে আরও ভালো করব আশা করি। পাশে দাঁড়ানো তাঁর বাবা বলেন, ‘ফাহাদের তো আর্থিক সহযোগিতা দরকার।’ সেই সহায়তা দিতে চান দাবা ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক সৈয়দ শাহাবুদ্দিন শামীম, ‘ফাহাদ ও সাগরকে ইউরোপে পাঠাতে চাই আধুনিক প্রশিক্ষণের জন্য। ইউরোপে কোথায় কী টুর্নামেন্ট আছে, আমরা খুঁজে দেখছি। সেভাবেই পরিকল্পনা করে ওদের পাঠাব।’
তাতে যদি দাবায় আরেকটু রং লাগে।