
ওরা বলেই দিয়েছিল, ‘বাংলাদেশ ফেবারিট, এটা আমাদের জন্য ভালো। চাপে থাকবে বাংলাদেশ!’
মাশরাফি একাদশ চাপে ছিলেন কি না জানি না, চাপে ছিলাম আমি। আগের রাত থেকে কথা বলা বন্ধ। ধর্মশালায় নাকি শ্বাস নেওয়া কঠিন, কিন্তু ঢাকায় বসে গতকাল সকাল থেকে আমার শ্বাস নিতে যেন কষ্ট হচ্ছিল। পত্রপত্রিকা ও নেট ঘেঁটে বিদ্যার্জন করেছি, উড়ন্ত ডাচরা রান ধাওয়া করতে ওস্তাদ, ইংল্যান্ডকে হারিয়েছিল ১৯০ তাড়া করে! সর্বশেষ মুখোমুখি হয়ে বাংলাদেশকেও হারিয়ে রেখেছে। কাল সকাল থেকে প্রার্থনা করছিলাম, বাংলাদেশ যেন টস জেতে। টস জিতে বল নিতে হবে, এটা আমার মতো ক্রিকেট-মূর্খও জানে।
কাল বেলা সোয়া তিনটার সময় অফিসের বৈঠকের মধ্যে চুপিসারে ক্রিকইনফো দেখি। কমলারা জিতে গেছে টস। এবং অভ্রান্তভাবে লাল-সবুজকে পাঠিয়েছে ব্যাটিংয়ে। আমার মুখ শুকিয়ে আমসি।
সন্তানের অমঙ্গল-আশঙ্কায় বাবা-মার মন যেমন সব সময় কুপিত থাকে, আমার মনেও তেমনি নানা দুর্ভাবনা। আর আমি তো বাবা-বাবা অনুভূতি নিয়েই ক্রিকেট দেখতে বাধ্য। মুশফিকের বাবা ক্রিকেট মাঠে এসেই আমাকে খুঁজে বের করেন, ভাই কোথায়? এশিয়া কাপের ফাইনালে শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে কোথায় চশমা ফেলে এসেছি, একটু পরে মুশফিকের বাবা এসে আমাকে চশমা দিয়ে গেলেন, বললেন, এটা কুড়িয়ে পেয়ে তাঁকে দিয়েছেন মাশরাফির বাবা। তারও একটু আগে মাশরাফির বাবার সঙ্গে দেখা হয়েছিল, বলেছিলেন, চিনতে পেরেছেন তো! কোথায় চশমা ফেলেছি, কে বা পেল, আর সেটা পেলেন মাশরাফির বাবা, সেটা দিলেন মুশফিকের বাবাকে, আর সেটা পেলাম আমি। তারও একটু পরে একজন বললেন, আপনার সঙ্গে ছবি তুলি, আমাকে তো চিনবেন না, আমার ছেলেকে চিনতে পারেন, আমার ছেলের নাম তাসকিন। তাসকিনের মাকেও তিনি ডেকে আনলেন ছবি তুলতে। আর সাকিবের বাবা আর আমি একই সালে মাধ্যমিক পরীক্ষা দিয়েছি।
কাজেই বলতেই পারি, আমাদের ছেলেরা ধর্মশালায় গেছে খেলতে, এশিয়া কাপ ফাইনাল শেষ করে এক ফোঁটাও না ঘুমিয়ে সারা দিন ছিল তাদের বিমানযাত্রা। কী ক্লান্তিকর। আহা রে, ওরা যে একটুও বিশ্রাম পায়নি! ওই পিচ কেমন, ওই মাঠ কেমন, সীমানা কত দূরে, ছেলেগুলোর কোনো ধারণা নেই, তারা নেমে পড়েছে খেলতে। আর তার ওপরে টসে হার। উফ্!
মাশরাফিকে একটা টিপস দিই। টসের সময় কল দেওয়ার সুযোগ পেলে বলবেন, ‘কয়েনের যেটা ওপরে পড়বে, সেটা আমার।’
এখন রসিকতা করছি। কিন্তু কালকের বিকেলটা মোটেও রসিকতার ছিল না। যতই বলি না কেন খেলায় হারজিত থাকবেই, হল্যান্ডের সঙ্গে হার মেনে নেওয়া খুবই কষ্টকর ব্যাপার হতো! যাক, ব্যাটিংয়ে বাঁচিয়েছেন তামিম। অনবদ্য, অপরূপ, নিপুণ, অভ্রান্ত, অপরাজিত! ও তামিম-বিরোধী ভাই ও বোনেরা, তামিম আর কী করলে আপনারা মেনে নেবেন যে তামিমই আমাদের সেরা ব্যাটসম্যান? এবং ভালো বোলিং করলেন মাশরাফি, সাকিব, তাসকিন আর আল আমিন।
আমরা পরের খেলায় একটু নির্ভার থাকতে পারব। মাঠটা কেমন আমরা জানি। উচ্চতার সঙ্গেও খাপ খাওয়ানো যাবে। এভারেস্ট অভিযাত্রীরা কেন বেশ কিছুদিন আগে থেকে বেস ক্যাম্পে আশ্রয় নেন, একবার ওঠেন, আরেকবার নামেন, জানেন! কারণ ওই উচ্চতায় অক্সিজেন কম, বাতাসের চাপ কম, রক্ত বেরিয়ে আসতে চায় ত্বক ফেটে, বেস ক্যাম্পে অনেক দিন থেকে অভিযাত্রীরা ওই উচ্চতার সঙ্গে শরীরকে খাপ খাইয়ে নিতে চান! বাংলাদেশ দলও এবার কিছুটা সময় পাবে অলটিটুডের সঙ্গে অভ্যস্ত হওয়ার। কু-কুড়ি ক্রিকেটে কোনো প্রতিপক্ষই সহজ নয়, কোনো খেলার ফলই আগে থেকে নির্ধারিত নয়। আর আছে মেঘ-বৃষ্টি-রোদের খেলা। কাজেই বাংলাদেশ দলের জন্য শুভকামনা করে যাব নিরন্তর।
কালকের খেলা থেকে কী শিক্ষা পাইলাম? হুমায়ূন আহমেদের শ্রাবণ মেঘের দিন ছবিতে গান ছিল ‘নাও বাওয়া মদ্দ লোকের কাম’। ক্রিকেট দেখাও শক্ত লোকের কাজ। আমার মতো দুর্বলচিত্তের লোকের পক্ষে ক্রিকেট দেখা সত্যি কঠিন। তবে এই বুক ধড়ফড়ানির শেষে যখন মাশরাফি জয় এনে দেন, তখন মুখে হাসি ফুটে ওঠে। কী, আবার বাংলাদেশের খেলা দেখতে বসবি!
অবশ্যই, অবশ্যই। একটুখানি অনিশ্চয়তা না থাকলে জিতে সুখ কী!