পৃথিবীতে একটাই ভাষা ফুটবল
সারা পৃথিবীতে এখন একটাই ভাষা—ফুটবল। ব্রাজিলিয়ানরা মোটের ওপর একটাও ইংরেজি শব্দ জানে না। আমরাও পর্তুগিজ জানি না। কিন্তু কিছু জিজ্ঞেস করলে ব্রাজিলিয়ানরা অন্তত দুই মিনিট ধরে পর্তুগিজ ভাষায় কথা বলেই যায়।
অব্রিগাদো, অব্রিগাদ—এ রকম কিছু একটার মানে ধন্যবাদ। শুধু এতটুকু জানি। পানি চাইলে ঠান্ডা পানি দেয়। একবার গরম, একবার ঠান্ডায় মহান উৎপল শুভ্রকে দেখলাম একেবারে কাহিল। নেইমারের কোমর ভেঙেছে, শুভ্রর ভেঙেছে গলা। তাই ঠিক করেছি, গরম পানি ছাড়া খাব না। আগুয়া মানে পানি। নরমাল পানির পর্তুগিজ উৎপল শুভ্র জানেন, শিখে নিতে হবে। কিন্তু এখানে, ব্রাজিলের বিভিন্ন শহরে, রাস্তায়, এয়ারপোর্টে ঘুরছি, আর ভাবছি, পৃথিবীতে বোধ হয় একটাই ভাষা আছে, যা সবার জানা। তার নাম ফুটবল। যে জাপানি মেয়েটি আবুধাবি থেকে সাও পাওলো পর্যন্ত এসেছিল আমার পাশের আসনে বসে, ফুটবল শুনলে তার চোখও উজ্জ্বল হয়। জাপান আউট বলার পর শরীর ছেড়ে দিয়ে বলে, আহা। আরব থেকে আমেরিকা, আফ্রিকা থেকে বসনিয়া—আজ তো একটাই আলোচ্য, ফুটবল।
ব্রাজিলিয়ানরা খায় ফুটবল, মাখে ফুটবল, ঘুমায় ফুটবল। তবু বলি, এরা বিশ্বকাপে পাঁচবার চ্যাম্পিয়ন হতে পারে, প্রতিবার বিশ্বকাপে খেলতে পারে, সবচেয়ে বেশিবার ফাইনালে যেতে পারে। কিন্তু মাতামাতিতে আমরা একটু বেশি এগিয়ে। ব্রাজিলে যে শহরে বিশ্বকাপ খেলা হচ্ছে, সে শহরে সেদিন ছুটি দেওয়া হয়। আর ব্রাজিলের খেলার দিন তিন ঘণ্টা আগে থেকে ব্যাংক পর্যন্ত ছুটি, ‘যাও খেলা দেখো।’ তবু মনে হয়, আমরা যতটা মাতামাতি করছি, পুরো ব্রাজিল ততটা করছে না।
একবার বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ভাঙচুর করে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ করে দিতে সক্ষম হয়েছিল; কারণ ছেলেরা বিশ্বকাপ দেখবে। তখন ব্যাপার কী জানতে চাইলে অধ্যাপক জামিলুর রেজা চৌধুরী আমাকে প্রশ্ন করেছিলেন, ‘তুমি শাহাদুজ্জামানের লেখা কয়েকটি বিহ্বল গল্প বইটা পড়েছ? ওই বইয়ে একটা গল্প আছে।’ একটা কলেজে কতগুলো ছেলে আড্ডা দিচ্ছে। ‘এই, সামনে টেস্ট। অথচ ওয়ার্ল্ড কাপ। কী করি। আয় কলেজটা বন্ধ করে দিই। আয়। ওই যে একটা ছেলে যাচ্ছে ওকে মেরে ফেলি।’ তারা খুন করল ও কলেজ ছুটি হয়ে গেল। আমাদের কাছে বিশ্বকাপ খুবই বড়, কখনো কখনো অন্যের জীবনের চেয়েও বড়, কখনো বা নিজের জীবনের চেয়েও বড়।
আজ কী হবে জার্মানি-ব্রাজিল খেলায়। কী হয়েছে আপনিই বলুন। এই উদ্ধৃতিটা ব্যাপক জনপ্রিয়, গ্যারি লিনেকার বলেছেন, ‘ফুটবল খুব সোজা খেলা। ২২ জন খেলোয়াড় একটা বল নিয়ে ৯০ মিনিট দৌড়াদৌড়ি করে। শেষে জার্মানি জয়ী হয়।’ আর চার্লস মিলার নামে যে ইংরেজ বংশোদ্ভূত ব্রাজিলীয় ১৮৯৪ সালে ইংল্যান্ড থেকে দুটো ফুটবল আর ফুটবলের নিয়মের বই নিয়ে এসেছিলেন ব্রাজিলে, যিনি ব্রাজিলের ফুটবলের জনক বলে গণ্য, তাঁর বইয়ের নাম গড ইজ আ ব্রাজিলিয়ান।
ব্রাজিল-জার্মানি খেলা শুরুর ১২ ঘণ্টা আগে যে লেখাটা লিখছি, তাতে ব্রাজিল-জার্মানি নিয়ে কথা বলব কেন? বরং দ্বিতীয় সেমিফাইনাল খেলাটা নিয়ে কথা বলা যায়। আর্জেন্টাইনরা জানে, তারা পৃথিবীর সবচেয়ে বড় ফুটবল শক্তি। শুধু বিশ্বকাপটা দুইবারের বেশি জেতা হয়নি। মেসির বয়স ২৭, সে তো ভিনগ্রহের ফুটবলার, বিশ্বের সেরা বলে গণ্য, এবারের বিশ্বকাপটা তার প্রাপ্য। নেদারল্যান্ডস ফুটবল খেলে ভালো, তারা রুড খুলিতসহ অসংখ্য ভুবনভোলানো খেলোয়াড়ের জন্ম দিয়েছে, ফুটবল-ঈশ্বর আর কতকাল তাদের কাপবঞ্চিত রাখবে? পৃথিবীতে কি ন্যায়বিচার বলে কিছু থাকবে না, যারা পাওয়ার তারাই চিরকাল পেয়ে যাবে?
ইংরেজরা ব্রাজিলে ফুটবল এনেছিল, আমাদের সাও পাওলোর গাইড বললেন—আর জার্মানি এই দেশকে দিয়েছে বিয়ার। ইংরেজরা ব্রাজিলকে ফুটবল দিয়ে এবার প্রথম রাউন্ড থেকে বিদায় হয়েছে। পর্তুগিজরা ব্রাজিল নামের দেশটা, তাদের ভাষাটা, নিয়মকানুন সব বানিয়ে দিয়ে ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর হাত ধরে চলে গেছে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব। এখন শেষ দুইয়ে কারা আছে জানার জন্য কয়েক ঘণ্টার অপেক্ষা।
ব্রাজিলে বসে ব্রাজিিলয়ানদের উত্তেজনা নয়, বাংলাদেশিদের উত্তেজনা টের পাচ্ছি।
টাইম ম্যাগাজিন একটা প্রবন্ধ ছেপেছিল, ব্রাজিল-আর্জেন্টিনা নিয়ে পৃথিবীতে সবচেয়ে বড় মাতামাতিটা হয় হাজার হাজার মাইল দূরের দেশ বাংলাদেশে। কারণ কী? প্রথম আলোর ইফতেখার মাহমুদের সাক্ষাৎকার ছাপা হয়েছিল। বিজ্ঞ ইফতেখার ততোধিক ভাবগম্ভীর কণ্ঠে জবাব দিয়েছিলেন, ব্রাজিিলয়ানরাও গরিব, আমরাও গরিব। আর আর্জেন্টিনা লড়েছে উপনিবেিশকদের বিরুদ্ধে, ফকল্যান্ড যুদ্ধের সময়ে; আমরাও একই সূত্রে তাদের সঙ্গে আত্মীয়তা বোধ করেছি। ইফতেখার জলবায়ু সম্মেলন কভার করতে রিও ঘুরে গেছেন, তাঁর পর্যবেক্ষণ তাই উড়িয়ে দেওয়া যাবে না। তবে ব্রাজিল গরিব আমরাও গরিব—এই তুলনাটা বাঁশও ঘাস, দুর্বাও ঘাস, তার মতোই হয়ে যায় নাকি। পৃথিবীর সবচেয়ে দামি গাড়িগুলো এখানে গাভির মতো চড়ছে, মেয়েরা এই দেশে সবচেয়ে বেশি টাকা খরচ করেন প্লাস্টিক সার্জারির পেছনে, লোকে কেনাকাটা করতে যায় হেলিকপ্টারে চড়ে। এদের বিমানবন্দরে ডমেস্টিক বিমান গুলিস্তানের মতো যানজটে পড়ে যায়। হাইওয়ে বিরামহীন, রাস্তাঘাট পরিকল্পিত। ব্রাজিলের যেকোনো জনপদ আমার কাছে আমেরিকার চেয়ে কোনো অংশে কম উন্নত মনে হয় না। এখানে রাস্তার ধারে ছিন্নমূল মানুষ ঘুমায়। সে তো আমি আমেরিকার রাজধানীতেও দেখেছি।
সমস্যা হলো, বৈষম্য। এত বৈষম্য বোধ হয় কম দেশেই আছে। সমস্যা হলো, দুর্নীতি। একজন বললেন, ধরো, সরকার একটা ব্রিজ বানাবে, ইঞ্জিনিয়ার লাগবে, তুমি তাদের বন্ধু, তুমি ইঞ্জিনিয়ার নও, তাতে কী, তুমিই ব্রিজটা বানাও। এই হলো এখানকার পলিসি। সাও পাওলোর নদীটি, ছোট্ট, দুই ধার পাকা, বাঁধানো, তবে ভেতরের পানি আলকাতরার মতোই। আমাদের বুড়িগঙ্গার সঙ্গে এখানেই মিল। আমাদের ব্রিজের ঠিকাদারি দেওয়ার পলিসিতেও দুদেশের মিল আছে বটে। কিন্তু অমিলও আছে। ব্রাজিল পৃথিবীর সবচেয়ে ধনী দেশগুলোর একিট। পঞ্চম কি সপ্তম ধনবান দেশ। আবার ব্রাজিলের উত্তরাঞ্চল গরিব, দক্ষিণ উন্নততর।
আর আমরা যাদের চিনি, পেলে থেকে শুরু করে রোনালদো, রিভালদো, রোনালদিনহো হয়ে থিয়োগো সিলভা, গুস্তাফো পর্যন্ত—সবাই গরিব কিংবা মধ্যবিত্ত ঘরগুলো থেকেই এসেছেন। আর পৃথিবীটা এমন যে একজন সফল ফুটবলার বছরে কত টাকা পান, তা আমরা কল্পনাও করতে পারব না। ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো সপ্তাহে আয় করেন প্রায় তিন কোটি টাকা, মেসি আর নেইমারও হয়তো সপ্তাহ শেষে বেতন পান আড়াই কোটি টাকা। জানি না, এত অল্প টাকায় ওঁদের সংসার চলে কি না!
এঁরা টাকা পান। আমাদের কোনো ঈর্ষা নেই। দেখিস, একদিন আমরাও...বলে আমরা দীর্ঘশ্বাস ফেলি না। আমরা এঁদের ভালোবাসি। বড়লোক এঁদের চেয়ে পৃথিবীতে ঢের বেশি মানুষ রয়েছে, কিন্তু পৃথিবীতে মেসি একজনই, নেইমার অদ্বিতীয়, রোবেন দুটো নেই, মুলার অতুলনীয়। ভক্তদের কী ভালোবাসাই না এঁরা পেয়ে এসেছেন। আর্জেন্টাইনরা হাজারে হাজারে ঢুকেছে ব্রাজিলে, তীব্র ফুটবল-জাতীয়তাবাদে তারা টগবগ করে ফুসছে। ব্রাজিিলয়ানরা হেক্সা হেক্সা বলে চিৎকার করছে। কিন্তু আমরা কেন নাওয়া-খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছি?
কারণ, পৃথিবীতে একটাই ভাষা আছে, যা সবাই বোঝে, তার নাম ফুটবল।
এখন আমি পড়েছি মধুর সমস্যায়, তৃতীয় স্থান নির্ধারণী খেলাটা ব্রাসিলিয়ায় দেখে পরের দিন রিও ডি জেনিরোতে যে ফাইনালটা অন্তত কোপাকাবানা সৈকতে দেখব, তা হচ্ছে না। কোনো বিমানে টিকিট নেই। তাহলে কি আমি তৃতীয় স্থানের খেলাটা না দেখেই চলে যাব রিওতে?
নির্ভর করছে সেমিফাইনাল দুটোর ওপরে। তৃতীয় স্থানে কারা খেলছে আর ফাইনালে কারা খেলছে।
এখন পর্যন্ত খোদা তাআলা বড়দেরই ফাইনালে এনেছেন, স্পেনের অকাল-বিদায় ছাড়া কোনো অঘটনই ঘটেনি। ব্রাজিল টাইব্রেকারে হারেনি চিলির কাছে, নেদারল্যান্ডস হারেনি কোস্টারিকার কাছে।
বিগবয়েজ প্লে অ্যাট নাইট।
ফাইনালে কারা খেলছে? কাপটা উঁচু করে ধরছে কারা। নেইমার ফিট থাকলে আমি বলতাম সেটা ব্রাজিল; নেইমার-সিলভাবিহীন ব্রাজিলকে নিয়ে আশা করতে পারি, বাজি ধরতে পারি না।
তাহলে কি তৃতীয় স্থানের খেলাটা দেখতে ব্রাসিলিয়াতেই থেকে যাব?