ফুটবল ক্লাবের বিশ্ববিদ্যালয়!

বুয়েনস এইরেসের মনুমেন্টাল স্টেডিয়াম। এই মাঠেই মারিও কেম্পেসের হাত ধরে এসেছিল ১৯৭৮ বিশ্বকাপ। ৬৫ হাজার দর্শক ধারণক্ষমতার এই মাঠ কিন্তু এক দিক দিয়ে পুরো বিশ্বেই অনন্য। জ্ঞানের মৌনতা আর ফুটবলের কোলাহল যে এখানে গলাগলি করে থাকে!
একটু ধন্দে পড়ে গেলেন? ভাবছেন, ফুটবল মাঠের সঙ্গে আবার জ্ঞানের মেলবন্ধন হয় কী করে? মনুমেন্টাল স্টেডিয়ামের পাশেই যে রিভার প্লেট বিশ্ববিদ্যালয়! এরই মধ্যে ৭০ জন ছাত্র ভর্তিও হয়ে গেছে এখানে। আরও বিভ্রান্ত হলেন! রিভার প্লেটকে তো ক্লাব হিসেবেই জানেন। সেটা আবার বিশ্ববিদ্যালয় হলো কবে থেকে? না, রিভার প্লেট আর্জেন্টিনার ফুটবল ক্লাব, সেই জানায় ভুল নেই। তবে ফুটবলের পাশাপাশি জ্ঞানচর্চায় সমান মনোযোগ ক্লাবটির। সে জন্যই কদিন আগেই ক্লাবের নিজস্ব বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। কোনো ক্লাবের এ ধরনের উদ্যোগ ইতিহাসে এটাই সম্ভবত প্রথম। ফার্নান্দো মাসের মতো ফিটনেস প্রশিক্ষকদের জন্য এ যেন মেঘ না চাইতেই জল, ‘সবার ওপরে আমি এটা (বিশ্ববিদ্যালয়) বেছে নিয়েছি কারণ এটা রিভার। আমি শুধু একজন সমর্থকই নই, এই ক্লাবটাকে আমি ভালোও বাসি। এখানকার অনেককেই আমি চিনি। ফুটবলই ক্লাবের প্রাণ, কিন্তু ক্লাব শুধু ফুটবল নিয়েই সন্তুষ্ট নয়। বিশ্ববিদ্যালয় ক্লাবের বিশালতারই সাক্ষী।’
তাই বলে শুধু ক্লাবের প্রতি ভালোবাসার টানেই এই বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে এসেছেন, সেটা ভাবাও ভুল। বাস্তবতার জমিনেও পা রাখছেন রিভার প্লেট কিংবদন্তি অস্কার পিনিও মাসের ছেলে ফার্নান্দো, ‘আমি বসে থাকতে চাচ্ছিলাম না। আমি আবার পড়াশোনা শুরু করতে চাইছিলাম। আমি একজন অধ্যাপককে খুঁজছিলাম, যিনি আমাকে চাপ দিতে পারবেন। আমাকে দেখিয়ে দেবেন কী করতে হবে। পড়াশোনায় আমি ফিরতে চাচ্ছিলাম। কিন্তু আমি একজন ফিটনেস প্রশিক্ষকও বটে। আমি মনে করি, কয়েক বছরের মধ্যেই ইউরোপের মতো এখানেও বেঞ্চে থাকতে হলে একটা ডিপ্লোমা দরকার হবে।’
শুধু একটা খেলার গণ্ডি ছাপিয়েও ফুটবলের বিস্তৃতিটা অনেক দূর। প্রাতিষ্ঠানিকভাবেও আজকাল ফুটবলের শেকড়টা অনেক দূর প্রোথিত। ফার্নান্দো মনে করেন, সেটা ইউরোপ ছাড়িয়ে এখন ছড়িয়ে পড়েছে দক্ষিণ আমেরিকাতেও। আজকাল ফুটবলের সঙ্গে থাকতে হলে প্রাতিষ্ঠানিক একটা ভিতও তাই থাকা চাই। রিভার প্লেট প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা বিস্তারের উদ্যোগ নেয় অবশ্য অনেক আগে। ১১২ বছরের পুরোনো এই ক্লাবটি শিশুদের জন্য কিন্ডারগার্টেন চালু করে সেই ১৯২৮ সালে। তখন সুবিধাটা পেতেন শুধু খেলোয়াড়েরাই। এখন সুযোগ অবারিত, আজ তাই দুই হাজার শিশুর কলতানে মুখর এই বিদ্যানিকেতন। বিশ্ববিদ্যালয়টা ওটারই বর্ধিত সংস্করণ। আর্জেন্টিনায় যে এরই মধ্যে রিভার প্লেটের এই উদ্যোগ আদৃত হয়েছে, সেটা জানালেন কিন্ডারগার্টেনের প্রধান মার্সেলা স্ত্রোনাত্তি, ‘একটা শিশুকে কিন্ডারগার্টেনে নেওয়ার পর প্রাথমিক, মাধ্যমিক, এরপর বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত গড়ে তোলা সম্ভব। এটা গুরুত্বপূর্ণ একটা শিক্ষাগত উদ্যোগ। আমাদের দেশে দারুণ সম্মানেরও বটে।’ আর বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য হুয়ান কার্লোস পুগলিসের মতে, এটা একটা সামাজিক প্রতিষ্ঠানও, ‘এক শ বছরের বেশি সময় হয়ে গেছে আমাদের। আমরা একটা শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তুলেছি। আমরা বুঝতে পারছি, বিশ্ববিদ্যালয় চালু করার পর ক্লাব অন্য উচ্চতায় চলে গেছে। ফুটবল দল আছে এ রকম অনেক বিশ্ববিদ্যালয় আছে, কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় আছে এ রকম ফুটবল ক্লাব শুধু আমরাই।’ এই শিক্ষাব্যবস্থার দুজনকে নিয়ে রিভার প্লেট গর্ব করতেই পারে। হার্নান ক্রেসপো আর গঞ্জালো হিগুয়েইন স্কুলের পাঠ নিয়েছিলেন এখানেই!
আপাতত ক্রীড়া-বাণিজ্য, ক্রীড়া প্রশাসন, ব্যবসায় প্রশাসন ও শারীরিক শিক্ষা—এই চার বিভাগে পড়ার সুযোগ রয়েছে। মেক্সিকো ও কলম্বিয়া থেকে আসছে বিদেশি শিক্ষার্থীরাও। শিক্ষার্থীদের মাসে দিতে হয় ১২০০ পেসো (২২০ ডলার)। ক্লাব সদস্যরা অবশ্য কিছু ছাড় পান। আপনি ক্লাবের সমর্থক হোন বা না হোন, রিভার প্লেটে ভর্তি হতে সমস্যা নেই। আর এই বিদ্যায়তনের মানটাও খুব ভালো। এএফপি।