বলির পাঁঠা নয়, ব্যর্থতার কারণ খোঁজাই জরুরি

মিরপুর টেস্টে হেরে হতাশার গ্লানি নিয়ে মাঠ ছাড়ছেন মিরাজ ও জায়েদ
ছবি: প্রথম আলো

নিজের জ্বালানো আগুনে যেন নিজেই পানি ঢেলে দিলেন বিসিবি সভাপতি নাজমুল হাসান। রাগ-ক্ষোভ সব এক রাতে উধাও। পরশু মিরপুর টেস্টে বাংলাদেশ দলের হারের পর রীতিমতো ক্ষোভে ফুঁসছিলেন তিনি। খেলোয়াড়, অধিনায়ক, কোচ থেকে শুরু করে কাঠগড়ায় দাঁড় করান নির্বাচকদেরও। গতকাল সেই বিসিবি সভাপতিই বললেন, ওসব ছিল তাঁর রাগের কথা।

কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে কাল দুপুরে করোনার টিকা নিয়েছেন নাজমুল হাসান। টিকা নেওয়ার পর সেখানেই সাংবাদিকদের বলেন, ‘হেরে গেলে মেজাজ খারাপ হয়। আপনাদেরও খারাপ লাগে, আমারও খারাপ লাগে। কালকে (পরশু) ছিল রাগের কথা।’

দল ভালো না খেললে দেশের ক্রিকেটের অভিভাবক হিসেবে বিসিবি সভাপতির খারাপ লাগাটা অস্বাভাবিক নয়। দলের কাছে জবাবদিহি চাইতেই পারেন নাজমুল হাসান। কিন্তু যে প্রশ্নগুলো পরশু ম্যাচ শেষে সংবাদমাধ্যমের সামনে তিনি তুলে ধরলেন, সেসবের জবাব তো তাঁরই জানার কথা সবচেয়ে ভালো!

চট্টগ্রাম টেস্টের পর মিরপুর শেরেবাংলা স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত দ্বিতীয় টেস্টেও বড় প্রশ্ন হয়ে দেখা দেয়, ১৮ জনের দলে পাঁচ পেসার রেখেও ম্যাচে মাত্র এক পেসার খেলানোটা। কিন্তু এটা তো সবারই জানা যে উইকেটের ধরন সম্পর্কে অলিখিত বার্তা পেয়েই একাদশ ঠিক করে টিম ম্যানেজমেন্ট। সাজানো হয় বোলিং আক্রমণ। এবারও তার ব্যতিক্রম হয়নি বলেই জানিয়েছে দলীয় সূত্র। তারপরও বোর্ড সভাপতির ক্ষোভের আগুনে পুড়ে অসহায় বোধ করছেন জাতীয় দলের প্রধান কোচ রাসেল ডমিঙ্গো। বিসিবির এক শীর্ষ কর্মকর্তার সঙ্গে নিজের দুঃখ ভাগ করেছেন তিনি। যার সারমর্ম, কী হচ্ছে না হচ্ছে, তার সবই সবাই জানত। তারপরও কেন শুধু তাঁর আর দলের ওপরই দোষ দেওয়া? তাঁদেরই বলির পাঁঠা বানানো!

অবশ্য শুরুতে ঢাকা টেস্টে দুই পেসার নিয়েই খেলার কথা ছিল বলে প্রথম আলোকে জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচক মিনহাজুল আবেদীন। সেই সিদ্ধান্ত পরে বদলে গেল কেন? উত্তরটা প্রধান নির্বাচকেরও জানা নেই, ‘একাদশ তো ঠিক করে টিম ম্যানেজমেন্ট। আমরা শুধু পরামর্শ দিতে পারি। আর জৈব সুরক্ষাবলয়ের কারণে এবার তো আমরা ম্যাচের দিন সকালে উইকেটও দেখতে পারিনি।’ তবে দলীয় সূত্র বলছে, উইকেটে বল ঘুরবে, এমন বার্তা পেয়েই তিন স্পিনার ও এক পেসারের দল গড়ে টিম ম্যানেজমেন্ট। ওপেনার সৌম্য সরকার যেহেতু বোলিংও করেন, তাঁকে ধরা হয়েছিল দ্বিতীয় পেসার।

ম্যাচটা শেষ পর্যন্ত যেভাবে শেষ হয়েছে, তাতে অবশ্য এক পেসার-দুই পেসারের আলোচনা এখন অবান্তর। বাংলাদেশ ম্যাচটা জিততে জিততেও জিততে পারেনি তো ব্যাটসম্যানদের ব্যর্থতায়। বিসিবি সভাপতির কথায় এসেছে এই প্রসঙ্গও। ব্যাটসম্যানদের আউট হওয়ার ধরন নিয়ে প্রশ্ন তাঁর, যে প্রশ্ন আসলে সবারই। মিনহাজুল আবেদীনও বলছিলেন, ‘ঢাকা টেস্টে আমাদেরই জেতা উচিত ছিল। ৫০-৬০ রান পর্যন্ত কোনো উইকেট পড়েনি। এরপর আমরা ২৩১ করতে পারব না!’

নাজমুল হাসান অসন্তুষ্টি প্রকাশ করেছেন সাকিবের পরিবর্তে সৌম্যকে দলে নেওয়া নিয়েও। যদিও প্রশ্নটার উত্তর আছে বিসিবি সভাপতির কথাতেই। নির্বাচকদের দেওয়া সম্ভাব্য চারজনের তালিকায় সৌম্যের আগে তিনি যাঁদের নিতে বলেছিলেন, তাঁদের কেউই খেলার মতো অবস্থায় ছিলেন না। মাহমুদউল্লাহর পিঠে ব্যথা আর মোসাদ্দেক ও নাঈম শেখ ছিলেন ঢাকার বাইরে।

২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে অনুষ্ঠিত আফগানিস্তানের বিপক্ষে একমাত্র টেস্ট থেকেই বাংলাদেশ দলে পরিকল্পনার অভাব দেখছেন বলে জানিয়েছেন বিসিবি সভাপতি। এরপর সদ্য শেষ হওয়া ওয়েস্ট ইন্ডিজ সিরিজের আগপর্যন্ত বাংলাদেশ টেস্ট খেলেছে চারটি। এর মধ্যে গত বছরের ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় জিম্বাবুয়ের বিপক্ষে টেস্টটি ছাড়া ভারত ও পাকিস্তানে বাকি তিন টেস্টেই বাজেভাবে হার। দলের মধ্যে পরিকল্পনা ও সমন্বয়ের অভাব দেখে থাকলে তো বোর্ড সভাপতির আরও আগেই ব্যবস্থা নেওয়া উচিত ছিল।

নাজমুল হাসান যে কথাটি বলেননি, ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজে খারাপ করার সবচেয়ে বড় কারণ আসলে সেটিই। গত এক বছরেরও বেশি সময়ে কোনো দীর্ঘ পরিসরের ম্যাচ খেলেনি বাংলাদেশ দল। করোনাভাইরাসের মধ্যে সেটি সম্ভবও ছিল না। কিন্তু এত দিন পর ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে টেস্ট সিরিজ খেলতে নামার আগে এক-দুটি তিন বা চার দিনের প্রস্তুতি ম্যাচ তো খেলা যেত! শুরুতে সে রকম পরিকল্পনা থাকলে পরে তা বদলে ফেলা হয়। সিরিজ শুরু হওয়ার কথা ছিল টেস্ট দিয়ে, তার আগে তিন দিনের প্রস্তুতি ম্যাচ খেলার কথা ছিল বাংলাদেশ দলের ক্রিকেটারদের। কিন্তু বঙ্গবন্ধু টি–টোয়েন্টিতে টেস্ট অধিনায়ক মুমিনুল হক আঙুলের চোটে পড়লে বদলে যায় সে পরিকল্পনা। সিরিজের শুরুতে টেস্ট হলে অধিনায়ককে পাওয়া নিয়ে সংশয় ছিল। ওয়েস্ট ইন্ডিজ ক্রিকেট বোর্ডের সঙ্গে আলোচনা করে তাই ওয়ানডে দিয়ে সিরিজ শুরুর সিদ্ধান্ত নেয় বিসিবি, যেন সুস্থ হওয়ার সময় পান মুমিনুল। টেস্ট চলে যায় পরে। আর তাতে টেস্টের আগে প্রস্তুতি ম্যাচ খেলার সুযোগটিও আর থাকেনি।

টেস্ট খেলতে নামার আগে লাল বলের ক্রিকেটে ন্যূনতম ম্যাচ প্র্যাকটিস না থাকলে ফলাফল এর চেয়ে ভালো হওয়া কঠিন। সিরিজে ধারাভাষ্যকার হিসেবে থাকা আতহার আলী খানের চোখেও এটাই ব্যর্থতার বড় কারণ হিসেবে ধরা পড়েছে, ‘দীর্ঘ পরিসরের ক্রিকেট খেলাটা শুধু টেস্টের বোলিং–ব্যাটিংয়ে অভ্যস্ত হতেই নয়, টেস্টের বিভিন্ন পরিস্থিতিতে নিজের মানিয়ে নিতেও জরুরি। আমাদের মধ্যে সে প্রস্তুতির অভাব ছিল। আর শুধু দীর্ঘ পরিসরের ক্রিকেট বেশি করে খেলাই নয়, টেস্টে ভালো করতে এর মানও আরও ভালো করতে হবে।’ ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে ঘরের মাঠে টেস্টে ব্যর্থতার কারণটা তাই আপাতদৃষ্টে যথাযথ প্রস্তুতির অভাব বলেই মনে হয়। দীর্ঘ পরিসরের ক্রিকেট থেকে দীর্ঘ বিরতিই মরচে ফেলে দিয়েছে ক্রিকেটারদের সামর্থ্যে।

কিন্তু সমস্যা যদি গোড়াতেই থাকে, তাহলে আর এত জ্বালাময়ী কথা কেন? উত্তরটা খুঁজে পেতে পারেন বিসিবির ক্রিকেট পরিচালনা প্রধান আকরাম খানের কথায়, ‘দল খারাপ খেললে অনেক সমস্যাই ফুটে ওঠে, যেটা দল জিতে গেলে দেখা যায় না। আমরা দুটি জেতা টেস্টে হেরেছি। ঢাকায় ব্যাটসম্যানরা পারেনি। চট্টগ্রামে প্রথম টেস্টের দ্বিতীয় ইনিংসে বোলিং ভালো হয়নি। একটু কথা তো হবেই।’