বিশ্বকাপে লাতিন আধিপত্য

চিলির কাছে হেরে স্পেনের বিদায়! ক্লাব-সতীর্থ ইনিয়াস্তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন সানচেজ। এটি প্রতীকি ছবি মাত্র। ব্রাজিল বিশ্বকাপে ইউরোপের অধিকাংশ দলগুলোর অবস্থা এমনই ছিল। ছবি: রয়টার্স
চিলির কাছে হেরে স্পেনের বিদায়! ক্লাব-সতীর্থ ইনিয়াস্তাকে সান্ত্বনা দিচ্ছেন সানচেজ। এটি প্রতীকি ছবি মাত্র। ব্রাজিল বিশ্বকাপে ইউরোপের অধিকাংশ দলগুলোর অবস্থা এমনই ছিল। ছবি: রয়টার্স

ফুটবল বিশ্বকাপের চিরায়ত লড়াইটা দুই মহাদেশেরই। এক দিকে ইউরোপ, অন্য দিকে লাতিন আমেরিকা। বিশ্বকাপের রোল অব অনারেও এই দুই মহাদেশের হাড্ডাহাড্ডি লড়াই। ১৯ বিশ্বকাপের ১০টি গেছে ইউরোপে, নয়টি লাতিনে। আরও নির্দিষ্ট করে বললে বিশ্বকাপের জয়োত্সবে ব্রাজিল, ইতালি, জার্মানি, আর্জেন্টিনা, উরুগুয়ে, ফ্রান্স, স্পেন, ইংল্যান্ড—এ আটটি দলই মেতেছে ঘুরেফিরে।

আটলান্টিকের ওপারে দুই আমেরিকায় গিয়ে ইউরোপের কোনো দেশ কখনো শিরোপা জিততে পারেনি। আবার ১৯৫৮-এ ব্রাজিলের সুইডেন বিশ্বকাপ জয়ের ইতিহাস বাদে ইউরোপে গিয়ে লাতিন আমেরিকার দেশগুলোর শিরোপা জয়ের ইতিহাসও অনুজ্জ্বল। এবার বিশ্বকাপ ব্রাজিলে। ফলে অবধারিতভাবে একটি প্রশ্ন এসে যাচ্ছে, তবে কি এবার লাতিনদের জয়োত্সবে মেতে ওঠার পালা?

দেখতে দেখতে ব্রাজিল বিশ্বকাপ চলে এসেছে মাঝপথে। প্রথম রাউন্ড শেষে টিকে থাকা দলের সংখ্যা নেমে এসেছে অর্ধেকে। ৩২ দলের যে ১৬টি বিদায় নিয়েছে, সেগুলোর মধ্যে আছে সাবেক তিন বিশ্বচ্যাম্পিয়ন—ইংল্যান্ড, ইতালি ও স্পেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই দলগুলোর সবই ইউরোপের। অন্যদিকে, লাতিন আমেরিকার কোনো সাবেক বিশ্বচ্যাম্পিয়ন (উরুগুয়ে, ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা) প্রথম রাউন্ড থেকে বিদায় তো নেয়ইনি, বরং ঝলক দেখিয়েছে এই অঞ্চলের অন্যরাও। চিলি, কলম্বিয়ার দুরন্ত গতি চমকে দিয়েছে ফুটবলপ্রেমীদের।

এবার লাতিন আমেরিকা থেকে বিশ্বকাপে অংশ নিয়েছিল ছয়টি দেশ—ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, উরুগুয়ে, চিলি, কলম্বিয়া ও ইকুয়েডর। এর মধ্যে বিদায় নিয়েছে কেবল ইকুয়েডর। অন্যদিকে কনক্যাকাফ অঞ্চল থেকে অংশ নিয়েছিল চার দেশ—যুক্তরাষ্ট্র, মেক্সিকো, হন্ডুরাস ও কোস্টারিকা। এর মধ্যে বিদায় নিয়েছে কেবল হন্ডুরাস। অর্থাত্ দুই আমেরিকা মিলে বিশ্বকাপে দলের সংখ্যা ছিল ১০টি। এর মধ্যে দ্বিতীয় পর্বে পা রেখেছে আটটি দল। লাতিন আমেরিকার বিদায়ী দল ইকুয়েডরের পারফরম্যান্সও কিন্তু ফেলে দেওয়ার মতো কিছু ছিল না। হন্ডুরাসই যা বিশ্বকাপে খারাপ খেলেছে। তাদের নিয়ে প্রত্যাশারও তেমন কিছু ছিল না। কোস্টারিকার পারফরম্যান্স তো অবাক বিস্ময়ে উপভোগ করার মতোই। সাবেক দুই বিশ্বচ্যাম্পিয়নকে পায়ের ভৃত্য বানিয়ে তাদের দ্বিতীয় পর্বে উঠে যাওয়াটা এবারের বিশ্বকাপেরই এক বড় চমক।

এবার ইউরোপের পারফরম্যান্স খুব একটা ভালো নয়। অংশ নেওয়া ১৩টি দলের মধ্যে কেবল ছয়টি নিশ্চিত করতে পেরেছে দ্বিতীয় রাউন্ড। ব্যাপারটা ইউরোপের জন্য খুব সুখকর নয়। প্রথম পর্ব শেষে আমেরিকা (লাতিন-কনক্যাকাফ) বনাম ইউরোপের স্কোরলাইন দাঁড়াল ৮:৬! সাফল্যের অনুপাত ৮০: ৪৬ শতাংশ। সর্বোচ্চ গোলদাতার তালিকায় দুজন লাতিন আমেরিকার—লিওনেল মেসি, নেইমার; একজন ইউরোপের—টমাস মুলার। সবদিক দিয়ে এবারের বিশ্বকাপ লাতিন আধিপত্যের প্রমাণ বহন করে চলেছে।

ইউরোপের দলগুলোর মধ্যে ফ্রান্স ,হল্যান্ড, জার্মানি ও বেলজিয়ামের পারফরম্যান্স ছিল উল্লেখ করার মতো। তবুও গ্রুপ পর্বে নিজেদের শেষ দুটি ম্যাচে হল্যান্ড-জার্মানির পারফরম্যান্স নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন। বেলজিয়াম প্রতিটি ম্যাচ জিতেছে বটে, তবে তাদের খেলার ধরন নিয়ে উঠেছে প্রশ্ন। ফুটবল-তীর্থ ব্রাজিলে এসে বেলজিয়াম যেভাবে জিতেছে, তাতে সৌন্দর্যপিপাসু ফুটবলপ্রেমীদের জন্য হতাশাজনক। বেলজিয়াম কোচ মার্ক উইলমোটস রেগেমেগে তাই বলেই বসলেন, ‘গ্রহের সেরা দলটি নিয়েই এখানে খেলতে এসেছি। জানি না কারা খুব সুন্দর ফুটবল খেলছে। সুন্দর ফুটবল খেলতে এখানে আসিনি, এসেছি জিততে।’

বেলজিয়াম না হয় যেকোনো মূল্যে জিতেছে কিন্তু ডিফেন্ডিং চ্যাম্পিয়ন স্পেন কিংবা চারবারের চ্যাম্পিয়ন ইতালি অথবা তারকাসমৃদ্ধ ইংল্যান্ডের কেন এমন ত্রাহি দশা হলো? নানা কারণ থাকতে পারে। তবে সবার অভিন্ন অজুহাত—ব্রাজিলের ‘টুইস্ট কন্ডিশন’। লাতিন আমেরিকার সর্ববৃহত্ দেশটির বিচিত্র আবহাওয়া-পরিবেশে রীতিমতো খাবি খেয়েছে ইউরোপের দেশগুলো। ইতালির অভিজ্ঞ সেনানী আন্দ্রেয়া পিরলো তো বলেই দিয়েছেন, ব্রাজিলে নাকি একসঙ্গে দুটি বিশ্বকাপ চলছে। দুটি সম্পূর্ণ ভিন্ন পরিবেশে, ভিন্ন আবহাওয়ায়! একটি উষ্ণ—উত্তরে, আরেকটি শীতল—দক্ষিণে। বিশাল ব্রাজিলে যে ১২টি ভেন্যুতে এবারের বিশ্বকাপের খেলাগুলো অনুষ্ঠিত হচ্ছে, এতে আবহাওয়ার তারতম্য খুব প্রকট। অংশগ্রহণকারী দলগুলোর কোনো কোনোটি খেলছে শীতল আরামদায়ক পরিবেশে, আবার কোনো কোনোটি খেলছে তপ্ত পরিবেশে, গরমে গা পুড়িয়ে!

এ ছাড়া মাঠ নিয়েও এন্তার অভিযোগ অধিকাংশ ইউরোপের দলগুলোর। তাড়াহুড়ো করে তৈরি অনেক মাঠের উপযুক্ততা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন খেলোয়াড় ও কোচেরা। আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক—দর্শক। লাতিন আমেরিকার দেশগুলো যেভাবে দর্শকের সমর্থন পাচ্ছে, ইউরোপ ততটা নয়। এ ক্ষেত্রে ফ্রান্স কোচ দিদেয়ের দেশমের মন্তব্য যথেষ্ট যুক্তিযুক্ত, ‘আমরা ব্রাজিলে খেলতে এসেছি। দক্ষিণ আমেরিকান দলগুলো এখানে অভ্যস্ত। তাদের কাছে অনেকটা নিজেদের ঘরের মাঠে খেলার মতো। প্রচুর দর্শক সমর্থনে অধিক শক্তিশালী হয়ে উঠছে তারা।’ আবহাওয়া প্রসঙ্গে দেশমের জবাব, ‘আবহাওয়া কিছুটা পার্থক্য গড়ে দিচ্ছে। এটি কৌশলেও পার্থক্য গড়ে দিতে ভূমিকা রাখছে। কলম্বিয়া, ইকুয়েডর, উরুগুয়ে, চিলি—প্রতিটি দলই টেকনিক্যালি ভালো ফুটবল খেলেছে। তারা এ ধরনের উষ্ণ আবহাওয়ায় খেলতে অভ্যস্ত।’

তবে সুইজারল্যান্ড কোচ অটমার হিজফিল্ড কোনো কূটনৈতিক উত্তরে গেলেন না। সরাসরি বলেই দিলেন, ‘দক্ষিণ আমেরিকায় যে বিশ্বকাপগুলো হয়েছে, সেগুলোয় ইউরোপের দেশগুলো ভালো খেলতে পারেনি—এটি কোনো কাকতালীয় ঘটনা হতে পারে না। উরুগুয়ে, মেক্সিকো, আর্জেন্টিনা কোনো দেশেই ইউরোপ শিরোপা জিততে পারেনি। ব্রাজিলেও পারবে না।’