বেলজিয়াম: সংশয় হ্যাজার্ড আর ডি ব্রুইনাকে নিয়ে

বেলজিয়াম ইউরোর শিরোপার বড় দাবিদার দলগুলোর একটি।ছবি : রয়টার্স
প্রশ্নটা আসলেই প্রায় এক শ কোটি টাকার। ইউরোর চ্যাম্পিয়ন দল ১ কোটি ইউরো পাবে, বাংলাদেশি মুদ্রায় সেটা তো প্রায় এক শ কোটি টাকাই। সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা শুরু হবে আগামী ১১ জুন, শেষ ১১ জুলাই। ইউরোতে অংশ নিতে যাওয়া ২৪টি দলের খুঁটিনাটি জেনে নিলে এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা সহজ হতে পারে আপনার জন্য।

২০১৪ বিশ্বকাপ ও ২০১৬ ইউরোতে কোয়ার্টার ফাইনাল, এরপর গত বিশ্বকাপে তৃতীয় স্থান। উন্নতির এই ধারাবাহিকতায় এবার কি তবে শেষ হাসিটা হাসতে পারবেন লুকাকু-ডি ব্রুইনারা? ইউরো উপলক্ষে এর মধ্যে ২৬ সদস্যের দল ঘোষণা করেছেন কোচ রবের্তো মার্তিনেজ। কেমন হয়েছে দলটা?

দল: বেলজিয়াম

ফিফা র‍্যাঙ্কিং:

যাঁরা আছেন দলে

গোলকিপার

থিবো কোর্তোয়া (রিয়াল মাদ্রিদ), সিমোন মিনিওলেই (ক্লাব ব্রুগা), মাৎস সেলস (স্ত্রাসবোর্গ)

সেন্টারব্যাক

টোবি অল্ডারভাইরেল্ড (টটেনহাম হটস্পার), দেদ্রিক বোয়াতা (হার্থা বার্লিন), জেসন দেনায়ের (অলিম্পিক লিওঁ), টমাস ভারমায়েলেন (ভিসেল কোবে), ইয়ান ভার্তোনে (বেনফিকা)

রাইটব্যাক/ রাইট উইংব্যাক

তিমোথি কাস্তানিয়ে (লেস্টার সিটি), থমা মনিয়েঁ (বরুসিয়া ডর্টমুন্ড)

লেফটব্যাক/ লেফট উইংব্যাক

নাসের শাদলি (ইস্তানবুল বাশেকশেহির), ইয়ানিক ফেরেইরা-কারাসকো (আতলেতিকো মাদ্রিদ), থরগান হ্যাজার্ড (বরুসিয়া ডর্টমুন্ড)

সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার/ ডিফেন্সিভ মিডফিল্ডার

এক্সেল উইতসেল (বরুসিয়া ডর্টমুন্ড), হান্স ভানাকেন (ক্লাব ব্রুগা), লিয়েন্দার দেনদঙ্কার (উলভারহ্যাম্পটন ওয়ান্ডারার্স), দেনিস প্রায়েত (লেস্টার সিটি)

অ্যাটাকিং মিডফিল্ডার

কেভিন ডি ব্রুইনা (ম্যানচেস্টার সিটি), ইয়ুরি তিয়েলেমান্স (লেস্টার সিটি)

উইঙ্গার/ ওয়াইড মিডফিল্ডার

এদেন হ্যাজার্ড (রিয়াল মাদ্রিদ), জেরেমি দোকু (রেনেঁ), দ্রিস মের্তেন্স (নাপোলি), লিয়ান্দ্রো ত্রসার (ব্রাইটন)

স্ট্রাইকার

রোমেলু লুকাকু (ইন্টার মিলান), ক্রিস্টিয়ান বেনটেকে (ক্রিস্টাল প্যালেস), মিচি বাতশুয়াই (ক্রিস্টাল প্যালেস)

বেলজিয়াম কোচ রবের্তো মার্তিনেজ।
ছবি : সংগৃহীত

কোচ

রবের্তো মার্তিনেজ

অধিনায়ক

এদেন হ্যাজার্ড/কেভিন ডি ব্রুইনা

ইউরোতে সেরা সাফল্য

রানার্সআপ (১৯৮০)

গ্রুপে প্রতিপক্ষ

রাশিয়া (১২ জুন)

ডেনমার্ক (১৭ জুন)

ফিনল্যান্ড (২১ জুন)

বেলজিয়াম অধিনায়ক এডেন হ্যাজার্ড।
ছবি: এএফপি

শক্তি

আনুষ্ঠানিক দল ঘোষণার আগেই ভুলে নিজের দলে থাকার খবর টুইটারে ফাঁস করে বেলজিয়াম ফুটবল ফেডারেশনের ‘শাস্তি’ পেয়েছেন মিচি বাতশুয়াই। বেশি কিছু নয়, প্রথম দিন অনুশীলনে ৫০টা পুশ-আপ দেওয়া।

স্কোয়াডে জায়গা পেয়েছেন বলেই যে বাতশুয়াই মূল একাদশে সুযোগ পাবেন, এ রকম মনে করার কোনো কারণ নেই। বেলজিয়ামে প্রতিভাবান খেলোয়াড়ের এত ছড়াছড়ি, বেঞ্চে বসেই হয়তো সন্তুষ্ট থাকতে হবে বাতশুয়াইকে। আর এটাই বেলজিয়ামের সবচেয়ে বড় শক্তির জায়গা।

নিয়মিত অধিনায়ক এদেন হ্যাজার্ড চোটে থাকার পরেও যে দল দোর্দণ্ড প্রতাপে বাছাইপর্বের প্রতিটা ম্যাচে প্রতিপক্ষকে গোলবন্যায় ভাসিয়ে ইউরোর টিকিট পেয়ে যায়, সে দলের আক্রমণভাগ নিয়ে বেশি কিছু বলার দরকার হয় না।

রোমেলু লুকাকু সদ্য সমাপ্ত মৌসুমে সব টুর্নামেন্ট মিলিয়ে ৪৪ ম্যাচে করেছেন ৩০ গোল, এর মধ্যে লিগে ৩৬ ম্যাচে তাঁর ২৪ গোল জুভেন্টাসের আধিপত্য গুঁড়িয়ে ইন্টার মিলানের সিরি ‘আ’ জয়ে বড় ভূমিকা রেখেছে। ডি ব্রুইনাকে তো এই সময়ে ইউরোপের সেরা মিডফিল্ডারই বলা যায়। লেস্টারকে এফএ কাপ জিতিয়েছেন তিয়েলেমান, রিয়াল-বার্সাকে টপকে আতলেতিকো মাদ্রিদের লা লিগা জয়ের অন্যতম নায়ক ফেরেইরা-কারাসকো।

টুর্নামেন্ট শুরুর আগে চোটে পড়েছেন ডি ব্রুইনাও।
ফাইল ছবি

রক্ষণের পাশাপাশি টোবি অল্ডারভেইরেল্ড ও ইয়ান ভার্তোনে পেছন থেকে নিখুঁত পাস দিয়ে আক্রমণ গড়ে দেন। ২০১৮ বিশ্বকাপের সেরা গোলরক্ষক থিবো কোর্তোয়া এবারও আছেন অসাধারণ ফর্মে।

বেলজিয়াম কোচ রবের্তো মার্তিনেজ বুঝেছেন, যে দলটা ঐতিহ্যগতভাবে ফুলব্যাক পজিশনে দুর্বল এবং মাঝমাঠ ও আক্রমণভাগে শক্তিশালী। যে কারণে মার্তিনেজ শুরু থেকেই ৩-৪-৩ ছকে খেলাচ্ছেন বেলজিয়ামকে।

এই ছকে উইংব্যাক হিসেবে যাঁরা খেলেন, তাঁদের কেউই রক্ষণে খুব ভালো নন, তাই তাঁদের ওপর থেকে রক্ষণের চাপটা কমানোর জন্যই একাদশে একজন বাড়তি সেন্টারব্যাকের উপস্থিতি। বেলজিয়াম এখন গোল খায় কম, আক্রমণে ওঠে বেশি। কোচ হিসেবে মার্তিনেজের বুদ্ধিমত্তাও বেলজিয়ামের অন্যতম শক্তির জায়গা।

এই দুজনকে নিয়েই চিন্তায় বেলজিয়াম
ফাইল ছবি

দুর্বলতা

চোটের কারণে দলের নিয়মিত অধিনায়ক এদেন হ্যাজার্ড আদৌ মূল একাদশে খেলতে পারবেন কি না, সেটা বড় প্রশ্ন। ২৯ মে চ্যাম্পিয়নস লিগ ফাইনালে চোট নিয়ে মাঠ ছেড়েছেন কেভিন ডি ব্রুইনাও।

চোট কাটিয়ে এ দুজন খেলতে পারবেন কি না, ইউরোতে কেমন খেলবেন, তা নিয়ে শঙ্কা আছে। হ্যাজার্ড-ডি ব্রুইনার খেলা না–খেলা বদলে দেবে বেলজিয়ামের কৌশল। হয়তো ইউরোতে বেলজিয়ামের ভাগ্যও।

রক্ষণের বাঁ পাশের জায়গা নিয়ে একটু দুশ্চিন্তা আছে মার্তিনেজের। এই জায়গায় যাঁদের নিয়মিত খেলান মার্তিনেজ, সেই থরগান হ্যাজার্ড, ইয়ানিক-ফেরেইরা কারাসকো কিংবা নাসের শাদলি—নিজ নিজ ক্লাবে সবাই উইঙ্গার হিসেবেই খেলেন। লেস্টার সিটির ফুলব্যাক কাস্তানিয়ে সে ক্ষেত্রে দারুণ বিকল্প হতে পারেন, যিনি ডান-বাম দুদিকেই সমানতালে খেলতে পারেন।

মাঝমাঠে তিয়েলেমানসের সঙ্গী কে হবেন, তা-ও ধোঁয়াশায়। মারুয়ান ফেলাইনি, মুসা দেম্বেলের মতো বিশ্বস্ত সেন্ট্রাল মিডফিল্ডারকে বেলজিয়াম এবার পাচ্ছে না। বরুসিয়া ডর্টমুন্ডের এক্সেল উইতসেল গত জানুয়ারিতে পায়ের চোটে পড়ার পর এখনো মাঠে ফেরেননি। ইউরোর স্কোয়াডে থাকলেও উইতসেল কেমন খেলবেন, তা নিয়েও আছে অনিশ্চয়তা। তাঁর বিকল্প হিসেবে আছেন উলভারহ্যাম্পটনের লিয়ান্দার দেনদঙ্কার।

দলের তৃতীয় সেন্টারব্যাক হিসেবে ভিনসেন্ট কোম্পানির জায়গায় লিওঁর জেসন দেনায়ের কতটুকু ভালো করতে পারেন বড় টুর্নামেন্টে, সেটাও দেখার অপেক্ষা।

আমরা জানি এদেন হ্যাজার্ড আমাদের দলের জন্য কতটা গুরুত্বপূর্ণ। ওর চোট পুনর্বাসন প্রক্রিয়া বেশ সন্তোষজনক
রবের্তো মার্তিনেজ, বেলজিয়াম কোচ
সম্ভাব্য একাদশ।
ছবি : সংগৃহীত

সম্ভাব্য একাদশ ও খেলার কৌশল (৩-৪-৩)

কোর্তোয়া; অল্ডারভাইরেল্ড, দেনায়ের, ভার্তোনে; মনিয়েঁ, তিয়েলেমান্স, দেনদঙ্কার, ফেরেইরা-কারাসকো; ডি ব্রুইনা, লুকাকু, মের্তেনস

তিন সেন্টারব্যাকের মাঝে দেনায়ের, তাঁর ডানপাশে অল্ডারভেইরেল্ড, বাঁ পাশে ভার্তোনে। বল বেলজিয়ামের নিয়ন্ত্রণে থাকলে তিনজন নিজেদের মাঝে বেশ ফাঁকা জায়গা রেখে অবস্থান নেন। অনেকটা মাঠের প্রস্থকে তিন ভাগে ভাগ করার মতো। অল্ডারভেইরেল্ড ও ভার্তোনের অবস্থান হয় অনেকটা ফুলব্যাকের মতো। তাতে ডানে মনিয়েঁ ও বাঁয়ে কারাসকো কিংবা থরগান হ্যাজার্ডের মতো উইংব্যাকরা ওপরে উঠে প্রতিপক্ষের কাছ থেকে বল কেড়ে নেওয়ার জন্য ঝাঁপাতে পারেন।

গত বিশ্বকাপে কেভিন ডি ব্রুইনা সেন্ট্রাল মিডফিল্ডার হিসেবে খেলেছেন, অনেক সময় নিচ থেকে বল নিয়ে আক্রমণের সঙ্গে সংযোগ ঘটাতেন। তিয়েলেমান্সের উত্থান ও চোটের কারণে এদেন হ্যাজার্ডের ক্রমাগত অনুপস্থিতির কারণে ডি ব্রুইনাকে এখন অত নিচে খেলানো হয় না। ওপরে রাইট ফরোয়ার্ড হিসেবে খেলেন।

আক্রমণভাগে মাঝে লুকাকুকে রেখে দুই প্রান্তে ডি ব্রুইনা আর অন্য একজন (মের্তেনস, হ্যাজার্ড বা দোকু) ঠিক প্রথাগত উইঙ্গারের ভূমিকায় খেলেন না। বরং লুকাকুর পেছনে ফাঁকা জায়গাগুলোতে দৌড়াদৌড়ি করে সুযোগ খুঁজতে থাকেন আক্রমণের। লুকাকু নিজেও নিচে নেমে দুই সহকারী ফরোয়ার্ডকে ওপরে ওঠার সুযোগ করে দেন অনেক সময়।

ওপরে থাকা তিনজন ক্রমাগত জায়গা বদল করে প্রতিপক্ষকে বিভ্রান্ত করে দেন, যার আদর্শ বাস্তবায়ন দেখা গিয়েছিল ২০১৮ বিশ্বকাপে ব্রাজিলের বিপক্ষে কোয়ার্টার ফাইনালে।

প্রত্যাশা ও বাস্তবতা

গ্রুপ সেরা হয়েই পরের রাউন্ডে যাওয়ার কথা বেলজিয়ামের। ডি ব্রুইনা-লুকাকুরা আসলে ফাইনাল শেষেই হাসতে চাইবেন। বেলজিয়ামের এই সোনালি প্রজন্ম বড় শিরোপা জেতার সুযোগ আর খুব বেশি পাবেন না। এমন একটা দল নিয়ে সেমিফাইনালের আগে ছিটকে যাওয়া দুর্ভাগ্যই হবে।