নীল–সাদা চোখে : আর্জেন্টিনার ফুটবল–গুরু সিজার লুইস মেনোত্তি লিখছেন প্রথম আলোয়
ব্রাজিলের জন্য কাজটা কঠিন হবে
কোয়ার্টার ফাইনালে লড়বে ইউরোপ আর লাতিন আমেরিকার চারটি করে দেশ। খেলবে আমার দেখা ব্রাজিলের বিশ্বকাপ ইতিহাসের সবচেয়ে বাজে দল, খেলবে সার্বিক বিচারে চার লাতিন দলের মধ্যে সেরা কোস্টারিকা, খেলবে আর্জেন্টিনা যাদের কোনোরকমে জেতার চিন্তা বাদ দিতে হবে, আর খেলবে কলম্বিয়া যাদের আছে এই বিশ্বকাপের সেরা আবিষ্কার—হামেস রদ্রিগেজ। চলুন দেখে নিই এই চার ম্যাচে কী অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য।
ব্রাজিল-কলম্বিয়া
দুই দলের খেলার ধরন দুই রকম। লুইস ফেলিপে স্কলারি তাঁর খেলোয়াড়দের ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের ওপর নির্ভর করেন। কৌশলের দিক থেকে ব্রাজিলের প্রাপ্তির খাতা এখনো শূন্য। সব ম্যাচেই ওরা নিজেদের জন্য পরিস্থিতি খুব জটিল করে ফেলেছে। তার পরও ওরা উতরে গেছে ইতিহাস এবং ঐতিহ্যের খাতিরে। তা ছাড়া প্রতিপক্ষকে বেসামাল করে দিতেও ওরা খুব ভালো পারে।
কলম্বিয়ার কোচ হোসে পেকারম্যান উচ্চাভিলাষী, খেলার সৌন্দর্যও তাঁর কাছে গুরুত্বপূর্ণ। হামেস নিঃসন্দেহে এই বিশ্বকাপের সেরা আবিষ্কার। সেটা শুধু তাঁর গোল করার দক্ষতার কারণেই নয়, ও খেলাটা বোঝে ভালো। ব্যক্তিগত নৈপুণ্যের দিক দিয়েও হামেস অনন্য।
ম্যাচটা আকর্ষণীয় হবে সন্দেহ নেই। ব্রাজিলের এ দলটির আক্রমণ-ভাগ তাদের ইতিহাসের জঘন্যতম। নেইমারের ওপর ওরা অতিমাত্রায় নির্ভরশীল। রক্ষণের চিন্তা থাকবে কলম্বিয়া যেন তাদের খেলাটা না খেলতে পারে। কিন্তু পেকারম্যানের দলে এমন কিছু খেলোয়াড় আছে যারা যেকোনো মুহূর্তে খেলা ঘুরিয়ে দিতে পারে। দেখার বিষয় কলম্বিয়া নিজেদের খেলাটা খেলতে পারে কি না। যদি পারে, ব্রাজিলের জন্য কাজটা কঠিন হবে।
আর্জেন্টিনা-বেলজিয়াম
আর্জেন্টিনাও বোধ হয় ভাবেনি, নিজেদের কাজগুলো তারা নিজেরাই এত কঠিন করে তুলবে। খেলায় কীভাবে আরও উন্নতি আনা যায়, সেটা নিয়ে ভাবার মতো মানসিক অবস্থা খেলোয়াড়দের নেই। ওরা শুধু জানে, কোনো না কোনোভাবে ম্যাচ জিততে হবে। আর্জেন্টিনার মনোভাবটাই সবার আগে পাল্টাতে হবে। ওরা জেতার জন্য খেলে না, খেলার আগেই জয় নিয়ে ভাবতে থাকে। ফলে নিজেদের খেলা নিয়ে ভাবার সুযোগ থাকে না, মাঠে কী করতে হবে সেটা যেন ওরা জানেই না! সুইজারল্যান্ডের সঙ্গে খেলায় তো সেটাই মনে হলো।
তবে বেলজিয়াম কিন্তু সুইজারল্যান্ড থেকে পুরোপুরি আলাদা। ওদের খেলোয়াড়েরা তুলনামূলকভাবে ভালো সন্দেহ নেই, কিন্তু পরিকল্পনা বাস্তবায়নে তারা কিছুটা অদক্ষ। কোয়ার্টার ফাইনালিস্টদের মধ্যে আমাকে যদি প্রতিপক্ষ বেছে নিতে বলা হতো তাহলে আমি বেলজিয়ামকেই নিতাম। ফুটবলীয় দৃষ্টিকোণ থেকে অন্য দলগুলোর তুলনায় আর্জেন্টিনার জন্য নিজেদের খেলাটা খেলা সহজ হবে বেলজিয়ামের বিপক্ষেই।
জার্মানি-ফ্রান্স
কোয়ার্টার ফাইনালের আট দলের মধ্যে একমাত্র জার্মানিই মাঠে তাদের পরিকল্পনা কাজে লাগাতে পেরেছে। কোচ এবং খেলোয়াড়, সবারই ধারণা স্পষ্ট। তবে আগের মতো ম্যাচ ঘুরিয়ে দেওয়া খেলোয়াড় দেখছি না। ভলভগ্যাং ওভের্যাথ বা জার্ড মুলারের মতো দুর্দান্ত কোনো সেন্টার ফরোয়ার্ড বা উইঙ্গার দলে নেই যারা একাই ম্যাচের ভাগ্য গড়ে দিতে পারে।
এখন পর্যন্ত কোনো ম্যাচে জার্মানি নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করতে পারেনি, কিন্তু বড় টুর্নামেন্টে ওরা ঠিক ম্যাচ বের করে আনে। চিলি আর জার্মানিকেই কেবল মাঠে তাদের পরিকল্পনা কাজে লাগাতে দেখলাম। এ ক্ষেত্রে প্রতিপক্ষ নিজেদের খেলা খেলার মতো জায়গা পায় না।
কোনো সন্দেহ নেই, ফ্রান্স ইউরোপিয়ান পরাশক্তি। কিন্তু মাঠে পরিকল্পনার অভাব স্পষ্ট। ওরা খেলছে আবেগ দিয়ে, তবে ব্যক্তিগত নৈপুণ্যে ভাস্বর কিছু খেলোয়াড়ও দলটাতে আছে যাদের সম্মান জানাতেই হয়। ম্যাচে হাড্ডাহাড্ডি লড়াই হবে, তবু জার্মানিই ফেবারিট।
হল্যান্ড-কোস্টারিকা
আকর্ষণীয় ম্যাচ হবে নিঃসন্দেহে। কোস্টারিকা গুরুত্ব দেয় কৌশল আর বল ধরে রাখার ওপর, যেন প্রতিপক্ষ নিজেদের খেলার জন্য জায়গা বের না করতে পারে। হল্যান্ডের দলটা দুর্দান্ত। ওদের আছে স্নাইডার, ফন পার্সি আর রোবেনের মতো খেলোয়াড় যাদের অভিজ্ঞতা ব্যবধান গড়ে দিতে পারে।
কোস্টারিকা এই বিশ্বকাপের চমক। কিন্তু মধ্য আমেরিকা সম্পর্কে যাদের ধারণা আছে তাঁরা জানেন এই অঞ্চলের দেশগুলোতে অনেক ভালো ভালো খেলোয়াড় আছে। কোস্টারিকা তাদের মধ্যে অন্যতম। ‘টিকোস’দের নিয়ে সতর্ক থাকতে হবে কারণ ওরা খুবই ভালো খেলার ক্ষমতা রাখে।
হল্যান্ডের সবচেয়ে বড় সুবিধা হলো ওরা এ ধরনের পরিস্থিতে সবকিছু জটিল করে ফেলে না, মাথা ঠান্ডা রাখে। এ রকম ম্যাচ খেলে ওরা অভ্যস্ত। কোস্টারিকার জন্য এটা বড় পরীক্ষা হবে। তবে শেষ আটে আসাও তাদের জন্য বিশাল অর্জন। আমি মনে করি না আমাদের জন্য কোনো চমক অপেক্ষা করছে। হল্যান্ডের বিপক্ষে খেলা কোস্টারিকার জন্য কঠিন হবে, কিন্তু এটাও মনে রাখতে হবে সার্বিকভাবে দক্ষিণ আমেরিকার দলগুলোর মধ্যে ওরাই সবচেয়ে ভালো খেলেছে।