মাতামাতিতে বাংলাদেশই চ্যাম্পিয়ন

আগের দিন ব্রাজিল গুঁড়িয়ে গেছে জার্মানির কাছে। বিকেলে খেলবে আর্জেন্টিনা আর হল্যান্ড। বেলো হরিজন্তের মার্কেটে আমি ঘুরছি। বিশাল সুপার মল। রাস্তার ধারের দোকান। সবাই কাজে মগ্ন। বিশ্বকাপ নিয়ে কেউ কথা বলছে না। যেন পৃথিবীতে কোথাও বিশ্বকাপের খেলা হচ্ছেই না।
বিকেল পাঁচটায় আর্জেন্টিনা-হল্যান্ড খেলা। পৌনে পাঁচটার দিকে নামলাম হোটেলের লবিতে। টিভি বন্ধ। আমি রিসেপশনে অনুরোধ করে টেলিভিশন চালু করলাম। পুরো খেলা আমি একা দেখলাম। টাইব্রেকারের সময় আরও দু-তিনজন দর্শক পাওয়া গেল। হার বা জিত নিয়ে কেউ কোনো কথা বলছে না।
জার্মানির কাছে প্রলয়ংকরী হার ব্রাজিলকে স্তব্ধ করে দিয়েছে। এর চেয়েও বড় শঙ্কার ব্যাপার, আর্জেন্টিনা না চ্যাম্পিয়ন হয়ে যায়। বেলজিয়ামের সঙ্গে আর্জেন্টিনার খেলার দিন ব্রাসিলিয়ার স্টেডিয়ামে দেখেছি, ব্রাজিলিয়ানরা সব লাল জার্সি পরে এসেছে। হল্যান্ড-আর্জেন্টিনা খেলার দিনে বহু ব্রাজিলীয়কে কমলা রঙের জার্সি কিনতে হয়েছে। কোনোই সন্দেহ নেই, ১৩ জুলাইয়ের ফাইনালে ব্রাজিলীয়রা সাদা-কালো-লাল জার্সি পরে গ্যালারিতে হাজির হবে।
রিও ডি জেনিরোতে আমাদের গাইড ছিল ইউরি নামের এক ব্রাজিলিয়ান। তাকে বলেছিলাম, কী হবে যদি আর্জেন্টিনা চ্যাম্পিয়ন হয়? সে মাথা নাড়ছিল, ‘নো ওয়ে, হতেই পারে না।’
ব্রাজিল আর আর্জেন্টিনা কিন্তু প্রতিবেশী। লুৎফর রহমান সরকারের রম্য রচনায় পড়েছিলাম, প্রতিবেশীর সবকিছুই বেশি বেশি, তাদের ঘেঁষাঘেঁষিও বেশি, রেষারেষিও বেশি। ব্রাজিল-আর্জেন্টিনার প্রতিদ্বন্দ্বিতা প্রায় শত্রুতার পর্যায়ে চলে গেছে। রাজনীতি, অর্থনীতি, সামরিক কিংবা মহাকাশ গবেষণায় তারা বহু ক্ষেত্রে হাত ধরাধরি করে এগিয়ে যাচ্ছে বটে, ফুটবলে সেটা দা-কুড়াল সম্পর্কে পর্যবসিত। এরা ১৯৩৯-৪০ থেকেই ফুটবল মাঠের হাড্ডাহাড্ডি লড়াইকে হাড্ডি ভাঙার লড়াইয়ে পরিণত করেছে। খেলার মাঠে মারামারি হয়েছে, শেষ মুহূর্তে ব্রাজিলের পক্ষে পেনাল্টি দেওয়ায় আর্জেন্টাইনরা মাঠ ছেড়ে চলে গেলে ফাঁকা নেটে গোল দেওয়ার ঘটনা ঘটেছে। ভারতের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার খেলা হলে পাকিস্তানিরা কাকে সমর্থন করবে? পাকিস্তানের সঙ্গে ইংল্যান্ডের খেলা হলে ভারতীয়রা কাকে সমর্থন করবে। জার্মানির সঙ্গে আর্জেন্টিনার ফাইনালে ব্রাজিলীয়রা কোন দল, সেটা বলার অপেক্ষা রাখে না। তবে এটা কেবল ব্রাজিলীয়দের বেলায় প্রযোজ্য নয়, বাংলাদেশের সমর্থকদের বেলায়ও সমানভাবে খাটবে। ব্রাজিল-জার্মানি খেলার দিন আর্জেন্টিনার সমর্থকেরা জার্মানির বিজয়ে একেবারে ডগমগ ছিল। আর পরাজিত ব্রাজিল-সমর্থকেরা তাদের সাতটি গোল উপহার দেওয়া জার্মানির মুখের দিকেই তাকিয়ে থাকবে, যেন রোববারের ফাইনালে তাদের জার্মানি উদ্ধার করে দেয়।
ফুটবলের সমস্যাটা এখানে। সৌন্দর্যটাও এখানে। ব্রাজিল বাংলাদেশিদের কেউ নয়। তবু তার পরাজয়ে বহু বাংলাদেশি কাঁদে। আর্জেন্টিনা কে আমার? তবু শ্বাসরুদ্ধকর টাইব্রেকার শেষে যখন মেসি কাঁদছিল, মেসি ছুটছিল, তখন কত বাংলাদেশিই না কেঁদেছে।
জয়ে-পরাজয়ে দক্ষিণ আমেরিকার দলগুলো কাঁদে। আমরা, বাংলাদেশের মানুষেরাও কাঁদি। সে কারণেই হয়তো আমাদের দেশে এ দুটি দলের সমর্থক এত বেশি। আমরা যে দক্ষিণ আমেরিকার মানুষদের মতোই, বড় বেশি আবেগপ্রবণ।
তার পরেও একটা কথা বলি। বিশ্বকাপ ফুটবল নিয়ে আমরা বাংলাদেশে যত মাতামাতি করি, ব্রাজিলে আমি সেই মাতামাতি দেখিনি। বেশির ভাগ ব্রাজিলীয় নিজের দেশের খেলা বাদে অন্য খেলাগুলোর খবর রাখে না। আমাদের মতো সব দেশের খেলোয়াড়দের নামধাম বংশ-ক্লাব পরিচয় এরা মুখস্থ করে বসে নেই। এবং এদের সংবাদপত্রগুলোর প্রথম পাতায় রোজ বিশ্বকাপের খবরই একমাত্র খবর নয়।
আমার কাছে মনে হয়েছে, ব্রাজিলীয়রা নিজেদের আয়-উন্নতি, জীবন-সংগ্রাম নিয়ে ব্যাপৃত, বিশ্বকাপ তাদের কাছে মুখ্য নয়। তাদের যখন জিগ্যেস করি, কে চ্যাম্পিয়ন হবে? তারা বলে, ব্রাজিল। জার্মানির খেলার আগেও একজন মহিলা দোকানি বলেছিলেন, ২-০। এটা তাদের বিশ্বাস যে তাদের দল তাদের জয় এনে দেবে। কীভাবে দেবে, সেটা তাদের মাথাব্যথা নয়। তাহলে কি আমরা বাংলাদেশিরা একটু বেশিই বাড়াবাড়ি করছি? আমার ধারণা, ফুটবল নিয়ে মাতামাতিতে বাংলাদেশই চ্যাম্পিয়ন। স্কটিশ ফুটবলার বিল শ্যাংকির একটা উক্তি খুব বিখ্যাত, ‘কেউ কেউ বিশ্বাস করে থাকেন, ফুটবল হলো জীবন-মরণ সমস্যা। আমি এই মনোভাবে হতাশ হই। আসলে ফুটবল জীবন-মরণের চেয়েও কিছু বেশি।’ এটা হয়তো কেবল বাংলাদেশিদের বেলায় সত্য।
এই মুহূর্তে অবশ্য আমার মনে পড়ছে একজন আর্জেন্টাইন বালকের কথা। তার নাম তাফু। ব্রাসিলিয়ার হোটেলে তার সঙ্গে দেখা খাবারের টেবিলে। সঙ্গে তার বাবা। ছেলেটার বয়স বারো-তেরো বছর। ছেলেটা ইংরেজি পারে। বাবা পারে না। কোন ক্লাসে পড়? হাতের আঙুলে ইংরেজি সংখ্যা গুনে সে বলল, সেভেনে। স্কুলে সে ইংরেজি পড়ে। তাকে জিগ্যেস করেছিলাম, কে চ্যাম্পিয়ন হবে, বলো। সে বলল, আর্জেন্টিনা।
আমি বললাম, কিন্তু সেমি ফাইনাল তো কঠিন হবে। হল্যান্ড তো...তারপর ফাইনাল...
তাফু ছেলেটা দেখতে দেবদূতের মতো। আর্জেন্টাইনদের গায়ের রং খুব উজ্জ্বল হয়। অনেকটা নাসপাতির মতো। তার চোখ দুটো উজ্জ্বল, কালো। সে বলল, আমাদের মেসি আছে না? ও ঠিকই জিতিয়ে দেবে।
মেসি বর্তমান পৃথিবীর একজন শ্রেষ্ঠ খেলোয়াড়। শুধু তাঁর সম্মানেই সোনার কাপটা তাঁর হাতে ওঠা উচিত।
বেলজিয়ামের সঙ্গে খেলার দিনই এক আর্জেন্টাইনের সঙ্গে আমি বাংলাদেশের ক্রিকেটের জার্সি বদল করেছি। আর আরেকজন আর্জেন্টাইন আমার কাছে বাংলাদেশের পতাকা নেওয়ার জন্য খুবই পীড়াপীড়ি করছিল। তখন আমাদের সঙ্গের তিনটা লাল-সবুজ পতাকার একটা ওকে আমরা দিয়েছি। তখন ও শিশুর মতো হাসছিল। আর ওর পাশের স্বর্ণকেশিনী ওর পিঠে মৃদু চাপড় দিয়ে একটা প্রশ্রয়ের হাসি হেসেছিল।
আমাদের দলের শাফি আর মাহবুব ‘আর্জেন্টিনা’ ‘আর্জেন্টিনা’ বলে এমন চিৎকার করেছিলেন যে আশপাশের সবাই চমকে তাকিয়েছিল। ফুটবল কত দূরবর্তী মানুষকেও আত্মীয় করে তোলে!
ব্রাজিলের কাছ থেকে আমাদের শিখতে হবে পরাজয় সুন্দরভাবে মেনে নেওয়া। আমাদের রাজনীতিতে যদি আমরা পরাজয় মেনে নিতে পারতাম, দেশের অর্ধেক সমস্যার সমাধান হয়ে যেত। জয় ও পরাজয় উভয় পরিস্থিতিকে সুন্দরভাবে উদ্যাপন করার শিক্ষাই তো খেলোয়াড়ি মনোভাব।
এই মুহূর্তে ব্রাজিলীয়রা বড় অস্বস্তিতে আছে। লাখ লাখ আর্জেন্টাইন ঢুকে পড়েছে ব্রাজিলে, তারা সেই গানটা গেয়ে চলেছে—‘ব্রাজিল তোমাদের আঙিনায় এসে যখন আমরা তোমাদের ওপরে বসগিরি করছি, তখন তোমাদের কেমন লাগছে বলো। আমাদের ম্যারাডোনা তোমাদের পেলের চেয়ে বড়... তোমরা এবার দেখবে মেসিকে, আমরা এবার কাপ নিয়ে যাব ঘরে।’ খেলার শেষে মাঠে, ড্রেসিংরুমে মেসিবাহিনী এই গানে গলাও মিলিয়েছে।
সেমিফাইনালের আগ পর্যন্ত ব্রাজিলীয়রা হাতের পাঁচ আঙুল দেখিয়ে বলত, ‘পেন্টা, পেন্টা, এবার হবে হেক্সা...’
কিন্তু এখন কী করবে? পাঁচ দেখাতে গেলে না ওরা সাত দেখিয়ে দেয়।
আমার আর্জেন্টাইন বন্ধু বিখ্যাত লেখিকা পলা অলইক্সারাক এখন হাসছে। খেলা দেখতে ব্রাজিলে এলে না?
না না। মেসি যদিও আমাকে চান, কিন্তু পোচো ল্যাভেজ্জি আমাকে দেখলে তাঁর মনোযোগ হারিয়ে ফেলবেন। কাজেই আসছি না। সে তার উপন্যাস নিয়ে ব্যস্ত। আর আমি ব্যস্ত ফুটবল নিয়ে। বুঝুন!