মারিয়াদের সাফল্যেও ঢাকছে না ফুটবলের ব্যর্থতা

শেষ হওয়ার পথে আরেকটি বছর—২০২১। ক্রীড়াঙ্গনে কেমন গেল বিদায়ী বছরটা? পেছন ফিরে তাকালে উঠে আসে হাসি-কান্না, প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তির কত উপাখ্যান! সেসব নিয়েই ধারাবাহিক এই বর্ষপরিক্রমা। চতুর্থ পর্বে দেশের ফুটবল।

অনূর্ধ্ব–১৯ নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের শিরোপা জয়ের পর বাংলাদেশ দলের খেলোয়াড়েরাফাইল ছবি

জাতীয় দল ব্যর্থ, ব্যর্থ যুব দলও। পুরো বছরে দেশের ফুটবলে যা একটু সাফল্য, সেটা মেয়েদের হাত ধরে, অনূর্ধ্ব-১৯ সাফ নারী ফুটবলে। কিন্তু মারিয়া মান্দাদের জেতা সেই ট্রফির আলো দূর করতে পারেনি দেশের ফুটবলে ব্যর্থতার আঁধার। আশায় আশায় দিন যে গেল...আশা পূরণ হলো না। বিখ্যাত এই গানের শিল্পী এন্ড্রু কিশোর বেঁচে থাকলে বাংলাদেশের ফুটবল নিয়ে হয়তো নতুন একটা গান গাইতেন—আর কত দিন রইব আশায়...।

২০০৩ সালের পর জাতীয় দল আর কোনো ট্রফি জেতেনি। ২০২১ সেই ট্রফির সন্ধান দিতে পারত। নেপালে তিন জাতি টুর্নামেন্টে কিরগিজস্তান অনূর্ধ্ব-২৩ দলকে হারিয়ে নেপালের সঙ্গে ড্র। ফাইনালে নেপালের কাছে ২-১ গোলে হার। সোনার হরিণ হয়ে থাকা আন্তর্জাতিক ট্রফি আর ধরা দিল না।

অনূর্ধ্ব-১৯ নারী সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে শাহেদা আক্তার হয়েছেন সর্বোচ্চ গোলদাতা, জিতেছেন সেরা খেলোয়াড়ের ট্রফি
ছবি: তানভীর আহম্মেদ

অক্টোবরে সাফ চ্যাম্পিয়নশিপে অবশ্য ট্রফি ছোয়াঁর স্বপ্ন দেখেনি কেউ। আগের চারটি সাফে গ্রুপ থেকেই বিদায় নেওয়া বাংলাদেশের কাছে ফাইনালে উঠতে পারাই হতো বড় সাফল্য। শ্রীলঙ্কাকে হারিয়ে টুর্নামেন্ট শুরু করা বাংলাদেশ সে পথে পা-ও বাড়ায়। ভারতের সঙ্গে ১০ জন নিয়েও ড্র এবং মালদ্বীপের বিপক্ষে ২-০ গোলে হারেও আশা বেঁচে ছিল। শেষ ম্যাচে নেপালকে হারাতে পারলেই ১৬ বছর পর সাফের ফাইনাল—এমন ম্যাচে শেষ পর্যন্ত নেপালের বিপক্ষে ১০ জনের বাংলাদেশ পেনাল্টিতে গোল খেয়ে ১-১। জিততেই হবে ম্যাচে ড্র করে বিদায়। ১৬ বছর ধরে তাই সাফের ফাইনাল অধরাই রইল।

বছর শেষান্তে আবার একটি সুযোগ আসে। কলম্বোয় চারজাতি টুর্নামেন্টে স্বাগতিক শ্রীলঙ্কার সঙ্গে ড্র করলেই ফাইনাল—এমন ম্যাচেও অবিশ্বাস্য হার জামাল ভূঁইয়াদের। সে ম্যাচে আগে গোল করেও ১০ জনের অদম্য শ্রীলঙ্কার কাছে ২-১ গোলে হার। আরও একবার তীরে এসে তরি ডোবার গল্প।

ছেলেদের জাতীয় ফুটবল দলের গল্পটা কেবলই ব্যর্থতার
ছবি: বাফুফে

অথচ ২০১৫ সালে জাতীয় দলের ১৫টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার রেকর্ড ছাপিয়ে এ বছর ১৬টি ম্যাচ খেলে বাংলাদেশ। বেশি বেশি ম্যাচ খেলার বছর হিসেবে তৃপ্তি দিতে পারে ২০২১। তবে দেশে খেলা হয়নি একটি ম্যাচও। আগস্টে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়াম সংস্কারের জন্য ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। তার এর আগে দেশের মাটিতে এ বছর আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার তেমন চেষ্টাও করেনি বাফুফে। বিদেশের মাটিতে ৫ টুর্নামেন্টে ১৬ ম্যাচে ৫ ড্র, ৮ হারের বিপরীতে বাংলাদেশের জয় মাত্র ৩টি।

ওই ৩ জয় নেপালে কিরগিজস্তান অনূর্ধ্ব-২৩, সাফের মঞ্চে শ্রীলঙ্কা ও কলম্বোয় মালদ্বীপের বিপক্ষে। প্রথম দুটি ১-০, তৃতীয়টি ২-০। এ বছর বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ম্যাচ জয়ের হার ১৮.৭৫ ভাগ, সাম্প্রতিক বছরগুলোর মধ্যে যা সবচেয়ে কম। গত বছর করোনাকালে খেলা ৬টি আন্তর্জাতিক ম্যাচে ২ জয়, ১ ড্র ৩ হার। ওদিকে অনূর্ধ্ব–২৩ দল এ বছর জিততে পারেনি একটি ম্যাচও। উজবেকিস্তানে এএফসি অনূর্ধ্ব-২৩ বাছাইয়ে সৌদি আরব, কুয়েত ও উজবেকিস্তানের কাছে তিন ম্যাচেই হার।

১৮ বছর পর মালদ্বীপকে হারানোর স্বস্তি মিলেছে এ বছর
ছবি: বাফুফে

ঘরোয়া ফুটবলের সর্বোচ্চ আসর প্রিমিয়ার লিগে যথারীতি ছিল বসুন্ধরা কিংসের দাপট, এবারও শিরোপা ধরে রাখে তারা। তবে স্বাধীনতা কাপের চ্যাম্পিয়ন হয়ে নতুন মৌসুমের আগে তাদের চ্যালেঞ্জ জানিয়ে রাখে আবাহনী লিমিটেড।

বছরের শেষ দিকে মেয়েরা ঢাকায় অনূর্ধ্ব-১৯ সাফ নারী ফুটবলের শিরোপা জিতে হাসি ফোটান। টুর্নামেন্টে সর্বোচ্চ গোলদাতা (৫টি) ও সেরা খেলোয়াড়ের পুরস্কার জিতে নেন শাহেদা আক্তার। বয়সভিত্তক দলের এই সাফল্যের আড়ালে মেয়েদের জাতীয় দলের অবস্থা অবশ্য ছেলেদের মতোই তথৈবচ। উজবেকিস্তানে এশিয়ান কাপের বাছাইয়ে ইরান ও জর্ডানের কাছে হেরেছেন সাবিনা খাতুনরা। নেপালের সঙ্গে দুটি প্রীতি ম্যাচে এক জয় ও এক ড্র।

বাফুফে সভাপতি হিসেবে এ নিয়ে ১৩ বছর হলো কাজী সালাউদ্দিনের। কিন্তু বারবার জাতীয় দলের কোচ বদল করা ছাড়া নতুন কিছুই দেখাতে পারেননি তিনি। জেমি ডে-কে হঠাৎ কর্মহীন করে সাফের দায়িত্ব দেওয়া হয় বসুন্ধরা কিংসের স্প্যানিশ কোচ অস্কার ব্রুজোনকে। সাফ শেষে ব্রুজোন স্বেচ্ছায় সরে গেলে শ্রীলঙ্কার টুর্নামেন্টে কোচের চেয়ারে বসেন আবাহনীর পর্তুগিজ কোচ মারিও লেমোস। এক বছরে জাতীয় দলে তিন-তিনজন বিদেশি কোচ বাফুফের এলোমেলো চিন্তারই ফল।

তবে গঠনমূলক ভাবনা থেকে এ বছরই নিজস্ব উদ্যোগে একটা জিম করতে পেরেছে বাফুফে। নামমাত্র হলেও কমলাপুরে একাডেমি চালু করেছে। পর্যাপ্ত সুযোগ–সুবিধা নেই, তবু এর নাম কিনা এলিট একাডেমি! সব ছাপিয়ে অবশ্য বছরটা শেষ হচ্ছে বাফুফে-ক্লাব দ্বন্দ্বের রণডঙ্কা বাজিয়ে। কমলাপুর স্টেডিয়ামের টার্ফে খেলা ঝুঁকিপূর্ণ দাবি করে চলমান ফেডারেশন কাপ খেলছে না তিনটি ক্লাব। শাস্তি হিসেবে ৫ লাখ টাকা করে জরিমানাসহ বসুন্ধরা কিংস, উত্তর বারিধারা ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদ ক্রীড়া চক্রকে আগামী ফেডারেশন কাপে নিষিদ্ধ করা হয়েছে।

বছরের শেষে দেশের ফুটবলে এমন হযবরল অবস্থা হবে, কে ভেবেছিল!