রিয়ালের স্বপ্নের লা ডেসিমা

মার্সেলোকে জড়িয়ে ধরে আছেন জিদান। ফ্রান্স কিংবদন্তির চোখে অশ্রুকণা। লুকানোর চেষ্টা নেই একটুও। দুঃখের কান্না নয়, এ যে আনন্দাশ্রু! মাঠের মাঝখানে একা বসে কাঁদছেন রামোসও। কাছে গিয়ে ক্যাসিয়াস টেনে তুললেন তাঁকে। তারপর আবার দুজনের হাউমাউ কান্না। আনন্দাশ্রু!
রোনালদো কাঁদবার লোক নন। হ্যাঁ, ব্যালন ডি’অর জেতার পর আবেগে তাঁর চোখ থেকেও জল গড়িয়েছিল। কিন্তু পরশু রাতে তিনি সেই ‘বেয়াড়া’ রোনালদো। শেষ বাঁশিটা বাজার পর জার্সি খুলে ছুটে গেলেন গ্যালারির দিকে। হাতে ধরে জার্সিটা ছুড়ে দিলেন রিয়াল সমর্থকদের দিকে। তারপর শরীরের সবগুলো পেশি ফুলিয়ে দাঁড়ালেন রোমান গ্ল্যাডিয়েটরদের মতো।
টেলিভিশনের ক্যামেরা বেলকে খুঁজছে। কোথায় তিনি? পাওয়া গেল রিয়ালের ডাগ আউটের কাছাকাছি জটলায়। সতীর্থরা একজন করে আসছেন আর লাফিয়ে পড়ছেন তাঁর ওপর। শেষ পর্যন্ত সতীর্থদের উল্লাসে চাপা পড়লেন ওয়েলশ উইঙ্গার।
লিসবনের স্তাদিও দ্য লুজে ততক্ষণে রিয়ালের নামে ধ্বনি উঠছে, বাড়ছে গর্জন। এক নয়, দুই নয়, ১২ বছরের অপেক্ষা যে শেষ হয়েছে অবশেষে! স্বপ্নের লা ডেসিমা এসেছে বাস্তব হয়ে।
ভাবছেন অ্যাটলেটিকো মাদ্রিদ তখন কী করছে? নীরব, স্বপ্নভঙ্গের বেদনায় স্তব্ধ? এত কাছে এসেও না পারার আক্ষেপটা তাদের চোখেমুখে ছিল বটে, কিন্তু নাহ্, সে আক্ষেপে ভেঙে পড়েনি লাল-সাদারা। রিয়ালকে অভিনন্দন জানাতে পুরো গ্যালারি যখন উঠে দাঁড়িয়েছে, হাত তালি দিয়ে তাতে শামিল অ্যাটলেটিকোও। চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতেছে রিয়াল, কিন্তু অ্যাটলেটিকোও কি অনেকের হৃদয় জয় করেনি? এ হারে ওরা কেন লজ্জা পাবে!
হ্যাঁ, নিজেদের একটু দুর্ভাগা ভাবতেই পারে অ্যাটলেটিকো। ফুটবল হয়তো একটু নির্মম আচরণই করল তাদের সঙ্গে। নইলে এত কাছে এসেও কেন ৪০ বছর পর আবারও প্রায় একইভাবে স্বপ্নভঙ্গ হবে! আর মাত্র একটা মিনিট পার করতে পারলেই ইতিহাসের দরজা খুলে যেত৷ ঠিক তখনই সার্জিও রামোস ওইভাবে হেড করে গোল করে দেবেন সেটা কে ভেবেছিল! ওই এক গোলেই সব এলোমেলো হয়ে গেল সিমিওনের দলের। ৩৬ মিনিটে ডিয়েগো গডিনের হেডে এগিয়ে যাওয়া দল পরের ৫৭ মিনিট সেটা ধরে রেখেও ম্যাচ হারল ৪-১ েগালে! অতিিরক্ত সময়ে অ্যাটলেটিকোর স্বপ্ন কফিনে ঢোকালেন বেল, মার্সেলো আর রোনালদো মিলে।
প্রথম গোলটার জন্য অবশ্য ক্যাসিয়াসকে একটা ধন্যবাদ দিতে পারেন গডিন। পুরো ক্যারিয়ারে যিনি অতিমানবীয় সব সেভ করে সমর্থকদের কাছে ‘সেইন্ট ইকার’ হয়ে গেছেন, তিনিই পরশু অ্যাটলেটিকোর কর্নারের সময় ও রকম বোকার মতো জায়গা ছেড়ে বেরিয়ে গেলেন। পরে প্রাণপণ ফেরার চেষ্টা করেছেন, কিন্তু ততক্ষণে গডিনের হেড রিয়ালের জালে! মাত্র ৯ মিনিটের মধ্যে চোট পেয়ে ডিয়েগো কস্তা মাঠ ছেড়ে যাওয়ার পর অ্যাটলেটিকো সমর্থকেরা কিছুটা হতোদ্যম হয়ে পড়েছিলেন, ওই গোল তাঁদের চাঙা করে দিল। লিসবনে পরশু রিয়াল হারলে সারা জীবন ওই আক্ষেপ বয়ে বেড়াতেন ক্যাসিয়াস। তাঁকে উদ্ধার করেছেন রামোস। যোগ হওয়া সময়ে তাঁর গোলটা ম্যাচটিকেই অতিরিক্ত সময়ে নেয়নি, অ্যাটলেটিকোও আসলে হেরে গিয়েছিল তখনই।
রিয়ালের জার্সিতে অ্যাঙ্গেল ডি মারিয়া খেললেন তাঁর অন্যতম সেরা ম্যাচটা। ১১০ মিনিটে আর্জেন্টাইন উইঙ্গারের অসাধারণ মুভ থেকেই গোল করেছেন বেল । অ্যাটলেটিকো গোলরক্ষক কোর্তোয়া তাঁর শটটা ঠেকিয়েছেন, তবে ঠেকাতে পারেননি বেলের ফিরতি হেড। কোপা ডেল রের ফাইনালে গোল করে রিয়ালকে জেতানো ওয়েলশ উইঙ্গার আবারও প্রমাণ করলেন, তাঁকে এক শ মিলিয়ন ইউরোয় কিনে ভুল করেনি রিয়াল। অ্যাটলেটিকো বিধ্বস্ত, নড়ার শক্তি নেই। বেলের গোলের পর আর গোল না হলেও চলত। কিন্তু জয়টা লা ডেসিমার মাহাত্ম্যের সঙ্গে মানানসই হতে হবে তো! কয়েক মিনিট পর বদলি নামা মার্সেলো করলেন ৩-১। নিজের দেশে, চেনা মাঠে রিয়াল চ্যাম্পিয়নস লিগ জিতবে আর তাতে রোনালদোর কোনো অবদান থাকবে না তা কি হয়?
শেষ বাঁশির খানিক আগে পেনাল্টি থেকে রোনালদো ৪-১ করতেই লিসবন উন্মাদ প্রায়! এএফপি, রয়টার্স।
জয়–পরাজয়ের পর
n মার্সেলো (রিয়াল মাদ্রিদ ডিফেন্ডার)
বলার আসলে কিছু নেই, মানুষজনের মুখ দেখেই বুঝতে পারছি তারা কতটা খুশি
n ইকার ক্যাসিয়াস (রিয়াল মাদ্রিদ অধিনায়ক)
এর চেয়ে খুশির আর কিছু হতে পারে না। এই ক্লাবে ৯ বছর বয়স থেকে আছি, দারুণ গর্বের এটা। সবাইকে ধন্যবাদ!
n অ্যাঙ্গেল ডি মারিয়া (রিয়াল মাদ্রিদ মিডফিল্ডার)
শৈশব থেকে এই স্বপ্ন দেখছি। আমি দারুণ খুশি। আমরা অনেক পরিশ্রম করেছি। রিয়াল মাদ্রিদের হয়ে কিছু জিততে পারাটা আসলেই দুর্দান্ত একটা ব্যাপার।
n সার্জিও রামোস (রিয়াল মাদ্রিদ ডিফেন্ডার)
এটা আমার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ গোল। অবিশ্বাস্য একটা অনুভূতি। এটা শুধু আমার গোল নয়, মাদ্রিদের সব সমর্থক, আমার পরিবার ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের জন্য। এত বছর পর এটা আমাদের প্রাপ্য ছিল৷
n ডিয়েগো গডিন (অ্যাটলেটিকো ডিফেন্ডার)
অবশ্যই খারাপ লাগছে, কারণ আমরা হেরেছি। এটা লজ্জাই। কিন্তু এটাই ফুটবল ।
n থিবো কোর্তোয়া (অ্যাটলেটিকো গোলরক্ষক)
ইশ, আর এক বা দুই মিনিট যদি পেতাম!
n ডিয়েগো সিমিওনে (অ্যাটলেটিকো কোচ)
এটা খেলারই অংশ। আপনি জিততে পারেন, হারতেও পারেন। তবে আমরা এটা অন্তত জানি নিজেদের সর্বোচ্চ চেষ্টাই করেছিলাম৷