রোনালদো কি শেষ ছবিই এঁকে গেলেন

ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো

তখন সদ্য উনিশে পা রাখা টগবগে যুবক। মনের ভেতর তুলতুলে আবেগ। একটু ঝাঁকুনিতে চোখের দুই কূল ছাপিয়ে যায়। লিসবনে সেদিন লুইস ফিগো, রুই কস্তাদের মতো পোড় খাওয়া চোখগুলোও ভিজেছিল, সেখানে উনিশ বছরের ছেলেটির চোখে শ্রাবণের ঢল নামাই স্বাভাবিক। দেশের জার্সিতে খেলছেন সবে এক বছর। ঘরের মাঠে ইউরোর ফাইনাল, সেখানে গ্রিক রূপকথার পরাজিত ‘বীর’ হতে কার সইবে! ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোরও তাই সহ্য হয়নি। কেঁদেছিলেন শিশুর মতো।

১৭ বছর পরের কথা। এবারও সেই ইউরোর মঞ্চ, রণক্ষেত্র সেভিয়া। দল পর্তুগাল হলেও মোড়কের ভেতরকার নামটা—সোনালি প্রজন্ম। ২০০৪ ইউরোয় পর্তুগালের সেই ‘সোনালি প্রজন্মে’র সর্বকনিষ্ঠ সদস্য ছিলেন রোনালদো। এবার হোয়াও ফেলিক্স, ডিয়াগো জোতা, ব্রুনো ফার্নান্দেজদের নিয়ে গড়া দলটাও এক অর্থে সোনালি প্রজন্মই—রোনালদো তাদের মধ্যে অভিজ্ঞতম, দলের মুখ, অধিনায়কের বাহুবন্ধনী নিয়ে দলের পতাকাবাহী। উঠে আসা প্রজন্মের সামনে কান্নাটা ঠিক মানায় না। এই প্রায় দুই দশকে আয়তাকার সবুজ গালিচার রণক্ষেত্রে সব রকম অভিজ্ঞতার মধ্য দিয়ে যাওয়া রোনালদো তাই অনূদিত করলেন ট্রোজান বীর হেক্টরকে।

একিলিসের কাছে দ্বন্দ্বযুদ্ধে হারের পর হাঁটু মুড়ে সামনে বসে পড়েছিলেন হেক্টর। অনুচ্চারে বুঝিয়েছিলেন, আমার সৈন্যদল নয় শুধু আমার মাথাটাই নাও। সেভিয়ায় পরশু শেষ ষোলোর মঞ্চে শেষ বাঁশি বাজার পর মাঠেই রোনালদোর হাঁটু মুড়ে বসে পড়ার দৃশ্যটি মনে আছে? পৃথিবীর সব বিষণ্নতামাখা মুখে কান্না অনূদিত হয়নি। হবে কেন? উনিশ বছর বয়সের সেই তুলতুলে আবেগ এত দিনে পথের নানা বাঁকে হার–জিতের অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধ পাথরের মতো শক্ত। কথায় আছে, মানুষের বয়স বাড়ার সঙ্গে চোখের জলের ধারাও শুকিয়ে যায়। যদিও–বা কিছু থাকে, সেটিও জমা রাখতে হয় নিজের একাকিত্বের অর্ঘ্য দিতে। গ্রিক পুরাণে একিলিসের সামনে হেক্টর কাঁদেননি, ইউরোর পুরাণে রোমেলু লুকাকুর সামনেও রোনালদো চোখের জল আটকেছেন। হাঁটু মুড়ে বসে অধিনায়কের বাহুবন্ধনী সামনে খুলে রেখে রোনালদো মনে করিয়েছেন হেক্টরকে। একিলিস কী করেছিলেন, তা সবার জানা। লুকাকু যা করলেন, সেটাও প্রত্যাশিত। এগিয়ে এসে বুকে টেনে নিলেন। ততক্ষণে সবাই ধরে নিয়েছেন, ইউরোর পুরাণে এটাই হয়তো ক্রিস্টিয়ানো রোনালদোর শেষ ছবি।

হয়তো—কথাটা বলতে হচ্ছে নিরাপত্তার খাতিরে। নামটা যে রোনালদো। ছত্রিশ বছর বয়সের বিরুদ্ধে সাক্ষ্য দেয় তাঁর পেটানো শরীর আর ভীষণ লড়াকু মন। আগামী ইউরোয় পা রাখবেন চল্লিশে, তখন তাঁকে দেখার সম্ভাবনা এখন স্বপ্ন মনে হলেও কিংবদন্তিদের কাজই তো স্বপ্নকে বাস্তবে ফলানো। যদিও পরশু রাতে রোনালদোর অধিনায়কের বাহুবন্ধনী খুলে ক্ষোভ ও হতাশাক্লিষ্ট মুখখানি দেখে সে রকম কিছুর ইঙ্গিত মেলে না। তবে একটি অঙ্ক মেলে। মহাদেশীয় শ্রেষ্ঠত্বের রণক্ষেত্রে তাঁর পা পড়েছিল এক সোনালি প্রজন্মের হাত ধরে, এবার বিদায়রাগিণী বাজল আরেক সোনালি প্রজন্মকে রেখে। দুবারেই হারের ফল ১–০।

পার্থক্যও আছে, এই দুই সোনালি প্রজন্মের সঙ্গেই তিনি ‘ট্র্যাজেডি’র চরিত্র। কিন্তু গতবার, ২০১৬ ইউরোয় প্রায় সাদামাটা এক পর্তুগাল দলের সঙ্গেই জিতেছেন ইউরোপসেরার মুকুট। ক্যারিয়ারের পুরো সময় যে কথাটা শুনেছেন বারবার—রোনালদো একা এবং তাঁর সঙ্গে আরও ১০ জন—সেই কথাটার সার্থক রূপায়ণ হয়েছে সেবার। আর এবারের ছবিতে সেই কাঁচা বয়সের আবেগমথিত রোনালদো এবং পরশু রাতের পরিণত মানুষটির মধ্যেও ফারাকটা দেখা গেল—পাথরশীতল চোখের কূল ছাপিয়ে কান্না নয় অব্যক্ত ব্যথার স্পষ্ট ছবি। এটাই কি শেষ ছবি?

সেই উত্তর দেবে সময়। আবার এই সময়ই বুঝিয়ে দিচ্ছে, জীবনে কিছু অপূর্ণতা থাকতে হয়। নইলে খিদেটা মরে যায়। ইউরোয় ছোট–বড় সব মিলিয়ে ১৯টি রেকর্ড গড়েছেন রোনালদো। সর্বোচ্চ গোল, সর্বোচ্চ ম্যাচ জয়, সর্বোচ্চ ম্যাচ খেলা, সর্বোচ্চসংখ্যক সংস্করণে উপস্থিতি—এসব তো মোটাদাগের খতিয়ান। পুরোটা বলতে গেলে খাতা–কলম নিয়ে বসতে হবে। তার চেয়ে এটুকু বলাই ভালো, ইউরোয় তাঁর মতো এত রেকর্ড নেই আর কারও। শুধু ‘সোনায় সোহাগা’র ছাপটুকুই এবার দেওয়া হলো না—আন্তর্জাতিক ফুটবলে সর্বোচ্চ গোলের রেকর্ডটা তাঁর একার হলো না! এই না হওয়াটাই খিদের জোগান, সামনে পর্তুগালের ম্যাচ তো থাকবেই, এরপর ২০২২ বিশ্বকাপ, তারপর হয়তো ২০২৪ ইউরোও, কে জানে! রোনালদোদের যে শেষ বলে কিছু নেই—অন্তত তাঁরা শেষ বলার আগে কিছুই বলা যায় না।

এবার ইউরোয়ও দেখা গেল সেই নজির। শেষ ষোলো পর্যন্ত পর্তুগাল ৭ গোল করেছে। রোনালদোর বাইরে দলে তারকার অভাব নেই। কিন্তু তাঁর একার গোল ৫টি। এগুলোর মধ্যে ৩টি পেনাল্টি থেকে হলেও ১টি তিনি আদায় করেছেন আর গোল তো গোলই। বুঝতে না পারলে ক্রিকেটের উদাহরণ দেওয়া যায়—সুনীল গাভাস্কারের ভাষায়, ‘এমনকি হাফ ভলি ডেলিভারিকেও ঠিকমতো ব্যাটে লাগিয়ে গ্যাপে খেলতে হয়।’ তেমনি পেনাল্টি থেকে গোল করতেও স্নায়ুচাপ না নিয়ে গোলকিপারকে ফাঁকি দিতে হয়। এই কাজে রোনালদো যেমন সিদ্ধহস্ত, তেমনি ছত্রিশ বছর বয়সেও মাঝমাঠ থেকে এক দৌড়ে বক্সে ঢুকতে জানেন। তা দেখা গেছে জার্মানির বিপক্ষে, বেলজিয়ামের বিপক্ষেও গোল পেতে নিচে নেমে খেলেছেন, দৌড়েছেন মাঠের অর্ধভাগের ওপাশে প্রায় পুরোটাই, কখনো বক্সে কখনো আবার বক্স ছেড়ে দুই প্রান্তে—কোথায় ছিলেন না!

তবু গোল মেলেনি। তাই খিদেটাও থেকে যায়। শেষ বাঁশি বাজার পর বেলজিয়াম গোলরক্ষক থিবো কোর্তোয়াকে রোনালদো বলছিলেন, ‘তোমরা ভাগ্যবান। বলটা আজ কোনোভাবেই গোলপোস্টে ঢুকতে চায়নি।’ তখন তাঁর চোখেমুখে প্রতিজ্ঞার ছবিটা ছিল স্পষ্ট। এদিকে অস্পষ্ট ছবিটাও ক্রমশ স্পষ্ট হয়ে উঠছে। বেশ আগেই বলে রেখেছেন, ২০২২ বিশ্বকাপ হবে তাঁর শেষ আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট। সে হিসাবে, রোনালদোর হাঁটু মুড়ে বসে পড়ার ছবিটা চাইলে মনের মধ্যে ইউরোর ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখতে পারেন।

আর না–ও দেখা যেতে পারে।