সেই 'ছোট্ট' ডলি এখন

ডলি আক্তার
ডলি আক্তার

প্রতিদিন সকালে পত্রিকার পাতায় চোখ বুলিয়ে দেখতে পান অলিম্পিক গেমসের নানা খবর। বাংলাদেশ থেকে কারা যাচ্ছেন, কারা ওয়াইল্ড কার্ড পাচ্ছেন, এ নিয়ে কত জল্পনা! এসব পড়েন আর স্মৃতিকাতরতায় ডুবে যান ডলি আক্তার। দুদিন আগেও আনমনে বলছিলেন, ‘ইশ্‌, মেজবাহ-শিরিনরা যদি ওয়াইল্ড কার্ডটা পেত!’

ডলির ওই চাওয়া পূরণ হয়েছে। শেষ পর্যন্ত অলিম্পিকে যাচ্ছেন দেশের দ্রুততম মানব-মানবী। এসব খবর দেখে তাঁর চোখ আনন্দে নেচে ওঠে। কারণ, অলিম্পিকে খেলতে পারাও তো একজন খেলোয়াড়ের অনেক বড় পাওয়া। নিজের অভিজ্ঞতা থেকেই তা জানেন ডলি।

বেশ কয়েক বছর ধরেই আড়ালে ঢাকা পড়েছেন ডলি। এখনো খেলেন বাংলাদেশ আনসারের হয়ে, কিন্তু সেভাবে আলোচনায় নেই। কিন্তু রিও অলিম্পিক আবার যেন তাঁকে মনে করিয়ে দিচ্ছে। বাংলাদেশের ক্রীড়াবিদদের মধ্যে রাজবাড়ীর এই মেয়েই সবচেয়ে বেশি তিনবার অলিম্পিকে যাওয়ার দুর্লভ সুযোগ পেয়েছেন। ২০০০ সালে সিডনি, ২০০৪ এথেন্স, ২০০৮ বেইজিং। সাঁতরেছেন ৫০ মিটার ব্যাক স্ট্রোকে।

পেছনে তাকিয়ে তাঁর মনে হয়, কী অসাধারণ সব স্মৃতিই না জমা করে রেখেছেন স্মৃতির অ্যালবামে। সবচেয়ে বড় স্মৃতি অবশ্যই পুলে নামা, বড় বড় সাঁতারুকে কাছ থেকে দেখা। ২০০৮ সালের স্মৃতিটা যেন আজও তাঁর চোখে জ্বলজ্বলে, ‘সেবার মাইকেল ফেল্‌প্‌সের সঙ্গে একই পুলে অনুশীলন করেছি। কোচ আমাকে দেখিয়ে দেন...বলেন...ওই যে ফেল্‌প্‌স। আমি তো আর চিনতাম না। পরে পরিচিত হয়েছি ওনার সঙ্গে।’

স্মৃতির খাতায় সুখের কথা যেমন লেখা আছে, ২০০০ সালের দুঃস্মৃতিটাও ডলির সামনে এসে দাঁড়ায়। সেবার সাঁতরাতেই পারলেন না। আগেই ঝাঁপ দেওয়ায় ডিসকোয়লিফাইড হয়ে যান। নির্ধারিত সময়ের আগেই ঝাঁপ দেওয়ায়। সেটারও একটা কারণ দেখেন তিনি, ‘তখন চারপাশ থেকে বাঁশির আওয়াজ আসছিল। ওটা শুনেই পুলেই ঝাঁপিয়ে পড়লাম। আসলে তখন ছোট ছিলাম তো, অতটা বুঝিনি।’

ছোট ছিলেন বলতে ডলির ভাষায়, ‘আমি তো তখন ক্লাস থ্রি না ফোরে পড়ি ঠিক মনে নেই। এটা মনে আছে আমি প্রাইমারি স্কুলে পড়ি, স্কুলটা ছিল আমাদের রাজবাড়ীতে শহীদ স্মৃতি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়।’


যদি সেটিই হয়, তাহলে তো ডলির ওই অলিম্পিক–যাত্রা ছিল অবিশ্বাস্য। তবে থ্রি-ফোরের ছোট্ট একটা মেয়ে অলিম্পিকের মতো আসরে গিয়ে খেলবে, এই হিসাব তো মেলানো কঠিন।

তাও আবার বাংলাদেশের একটা মেয়ে! ডলিকে যখন বলা হলো প্রাথমিক বিদ্যালয়ে থাকতেই তাঁর অলিম্পিকে যাওয়ার ব্যাপারটা বিশ্বাস করা কঠিন, হেসে বললেন, ‘বিশ্বাস না করারই কথা। আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে যাই, ক্লাসটা ঠিক মনে নেই এই আরকি। ওই স্কুল থেকেই আমি সাঁতারে উঠে আসি।’

ডলির দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, তাঁর জন্ম ১৯৮৮ সালের বন্যার সময়। সেই হিসাবে মাত্র ১২ বছর বছর বয়সে গেছেন অলিম্পিকের মতো মহাসমুদ্রে সাঁতার কাটতে।

শুরুটা ছোট থেকেই, বাড়ির পুকুরে সাঁতারের নেশা পেয়ে বসে। ১৯৯৭ সালে মাত্র ৯ বছর বয়সে ঢাকায় জাতীয় জুনিয়রে খেলতে আসেন। তারপর এগিয়ে চলা, চারটি দক্ষিণ এশিয়ান গেমসে ৬টি রুপা, ৮টি ব্রোঞ্জ, ইন্দো বাংলা গেমসে ৯টি সোনা। কত কত অর্জন। তবে সব ছাপিয়ে দেশের ক্রীড়াঙ্গনে স্মরণীয় হয়ে থাকবেন সর্বোচ্চ তিনটি অলিম্পিকে দেশের প্রতিনিধিত্ব করে।

ডলি নিজেকে গর্বিত ভাবেন। পুরোনো দিনের গল্প করেন সতীর্থদের সঙ্গে। যেখানে সবার চেয়ে তিনি হয়ে আছেন আলাদা, ‘অলিম্পিকে এভাবে তিনবার খেলতে পারব ভাবিনি। খেলে আসার পরও বুঝিনি এটার মূল্য আসলে কত বেশি। কিন্তু এখন বুঝতে পারছি, যখন দেখি একটি ওয়াইল্ড কার্ডের জন্যও আমাদের খেলোয়াড়দের কত অপেক্ষা!’

সেই অপেক্ষা ফুরিয়ে মেজবাহ, শিরিন, মাহফিজুর রহমান সাগর, আবদুল্লাহ হেল বাকিরা (গলফার সিদ্দিকুর রহমান যাচ্ছেন সরাসরি যোগ্যতার মানদণ্ড অর্জন করেই) অলিম্পিকে যাওয়ার শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত এখন। আর আনসার একাডেমিতে বসে পূর্বসূরিদের জন্য শুভকামনা রাখেন ডলি, ‘ওরা সবাই যাক, সবার জন্য আমার আন্তরিক দোয়া আর ভালোবাসা।’

সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতায় টিপস দিতেও ভুললেন না। সবাই যেন নিজের সেরা স্কোর বা টাইমিংটা করতে পারেন এটাই তাঁর বড় চাওয়া। অলিম্পিকে একটা পদকের স্বপ্ন দেখার সাহসও যে আমাদের এখনো নেই!