সেই জিম্বাবুয়ে এই জিম্বাবুয়ে

জিম্বাবুয়েকে তৃতীয় ওয়ানডেতেও হারিয়ে ধবলধোলাই করল বাংলাদেশ।
ছবি: জিম্বাবুয়ে ক্রিকেট টুইটার

সেই এক দিন ছিল বটে! বিফ স্টেকের সঙ্গে ফ্রেঞ্চ ফ্রাই মিলে দাম ছিল ১২ লাখ ডলার। ৭ লাখ ডলারে মিলত শুধু একটা শিক কাবাব। এক বোতল ছোট মিনারেল ওয়াটার কিনতে লাগত ২ লাখ ডলার।

খাবারের এত দাম, তবু আমরা এক বেলা না খেয়ে থাকিনি। উল্টো সেবার জিম্বাবুয়ে এসে আমরা সবাই মিলিয়নিয়ার হয়ে গিয়েছিলাম। আমাদের টাকা রাখার জায়গা ছিল না। হারারে শহরে আমরা ট্যাক্সি থেকে নেমে ড্রাইভারকে প্যাকেট ভর্তি ডলার দিতাম। রেস্টুরেন্টে খেয়ে ক্যাশ কাউন্টারের সামনে ডলারের পাহাড় রেখে আসতাম। আমরা মানি এক্সচেঞ্জ থেকে ব্যাগভর্তি ডলার নিয়ে পাঁচ তারকা রেইনবো টাওয়ার হোটেলে ফিরতাম।

২০০৬ সালের সেই জিম্বাবুয়ে আর আজকের জিম্বাবুয়ে এক নয়। জিম্বাবুয়েতে তখন মুদ্রা ছিল জিম ডলার। ১ মার্কিন ডলারে পাওয়া যেত লাখ লাখ জিম ডলার। জিনিসপত্রের দামও ছিল তাই মিলিয়ন ছাড়িয়ে। মুদ্রার অবমূল্যায়ন হতে হতে পরে এমন অবস্থা হয়েছিল যে ব্যাগেও হয়তো আর কুলাচ্ছিল না। সে জায়গায় ট্রাংক চলে এসেছিল কি না কে জানে!

এরপরও দুবার জিম্বাবুয়ে এসেছি। জিম ডলার উঠে গিয়ে তখন এখানে চলত দক্ষিণ আফ্রিকান র‍্যান্ড আর মার্কিন ডলার। এবার অবশ্য মার্কিন ডলারেরই দাপট দেখছি। জিম ডলার তো নেইই, র‍্যান্ডের ব্যবহারও খুব কম জায়গাতে। তা–ও যদি বড় নোট হয়, তাহলে।

জিম্বাবুয়েতে এখন তাই লাখ লাখ ডলার খরচ করে লাঞ্চ করতে হয় না। ১৫-২০ ডলারেই পেট পুরে যায়। ট্যাক্সি ড্রাইভারকে তাড়া তাড়া নোট না দিয়ে এক-দুইটা নোট দিলেই চলে। সব টাকা জায়গা হয়ে যায় ওয়ালেটেই।

জিম্বাবুয়েতে চতুর্থবার হলেও এ নিয়ে ষষ্ঠবার আফ্রিকা মহাদেশে আসা হলো আমার। প্রতিবারই এসেছি প্রথম আলোর হয়ে ক্রিকেট কাভার করতে। আফ্রিকার মানুষের জীবন-যাপন দেখে সাদা চোখে যেটা মনে হয়, এই দেশগুলোতে ধনী-দরিদ্রের আর্থিক সংগতির ব্যবধান অনেক বেশি। যার আছে তার অনেক কিছুই আছে, যার নেই তার ফুটপাতে বিছানোর মতো মাদুরটুকুও হয়তো নেই।

হারারেতেই যেমন শ্বেতাঙ্গদের বোরোডেল এলাকার জীবনের সঙ্গে আশপাশের কোনো ‘লোকেশনে’র এলাকার জীবন মেলাতে পারবেন না। ‘লোকেশন’ বলতে গুগল ম্যাপ বা ফেসবুকের ‘লোকেশন’ নয় কিন্তু। আফ্রিকায় ইংরেজি ‘লোকেশন’ শব্দটার ভিন্ন অর্থও আছে। শহরের একটু বাইরে যেখানে দরিদ্র জনগোষ্ঠীর বাস, জীবন-যাপনের মান নিচের দিকে, ‘লোকেশন’ বলতে এখানে সেসব এলাকাকেই বোঝায়। ছোট ছোট ঘরে গাদাগাদি করে অসংখ্য মানুষের বসবাস। আর বোরোডেলে গেলে দেখবেন বড় বড় ভিলা। বিশাল বিশাল বাগানবাড়ি।

হারারে শহরে লকডাউনের কারণে ফাঁকা সড়ক।
ছবি: তারেক মাহমুদ

হারারে আগের তুলনায় বেশ ব্যস্ত হয়েছে। রাস্তাঘাটে দামি গাড়ি বেড়েছে। ট্যাক্সিচালকদের ধারণা, গাড়ির দাম কম বলেই এটা হয়েছে। সেদিন ব্রন্টে গার্ডেন হোটেল থেকে প্রস্তুতি ম্যাচ দেখতে তাকাসিঙ্গা ক্রিকেট ক্লাব মাঠে গেলাম যে টয়োটা গাড়িতে চড়ে, গাড়ির চালক ও মালিক স্যাম জানালেন, সেকেন্ড হ্যান্ড এই গাড়িটি কিনতে তাঁর লেগেছে ৪ হাজার মার্কিন ডলার। গাড়ির অবস্থা মোটামুটি ভালো। বাংলাদেশের তুলনায় দামটা বেশ কমই মনে হলো।

দেশটির অর্থনৈতিক অবস্থা আগের তুলনায় কিছুটা ভালো হলেও ক্রিকেটের উন্নতিটা যেন কিছুতেই হচ্ছে না। স্কুল ক্রিকেট ও ঘরোয়া ক্রিকেটের ওপর জোর দিয়েছে এখানকার ক্রিকেট বোর্ড। কিন্তু সেটার সুফল পেতে বোধ হয় আরেকটু সময় লাগবে।

হারারেতে জাতীয় ক্রিকেট দলের খেলোয়াড়দের অনুশীলন।
ছবি: তারেক মাহমুদ

হারারে স্পোর্টস ক্লাবের বার কাম রেস্টুরেন্ট দ্য সেঞ্চুরিয়নে কাজ করেন ট্যাবু নামের এক ভদ্রমহিলা। নামের বানান যদিও জিম্বাবুয়ে দলের সাবেক অধিনায়ক টাটেন্ডা টাইবুর নামের দ্বিতীয় অংশের মতো, ট্যাবুর দাবি, টাইবুরও উচিত নিজের নামটা ‘ট্যাবু’ বলা। টি এ আই ইউ বিতে নাকি ‘ট্যাবু’ই হয়!

সে যা–ই হোক, ট্যাবুর প্রসঙ্গ তোলার কারণ, দীর্ঘ ১৭ বছর হারারে স্পোর্টস ক্লাবের চৌহদ্দিতে থাকার সৌজন্যে জিম্বাবুয়ে ক্রিকেটের অনেক কিছুই তাঁর দেখা। তবে রেস্টুরেন্ট কর্মী যেহেতু, ক্রিকেটের অবনতির পেছনে খাবার-দাবারের ব্যাপারটাই তাঁর চোখে বেশি চোখে পড়ছে, ‘আমাদের খেলোয়াড়েরা তো শুধু বিফ স্টু আর বিয়ার খেতে পছন্দ করে। এগুলো শরীর ভারী করে দেয়। ওরা খেলবে কীভাবে!’

সেঞ্চুরিয়নের ভেতর থেকে ঠিক ওই সময়ই দেখা গেল, মাঠ দিয়ে হেঁটে যাচ্ছেন বাংলাদেশের দুই ক্রিকেটার শরীফুল ও সাইফউদ্দিন। এবার ট্যাবুর দৃষ্টি সেদিকে, ‘দেখো, দেখো, তোমাদের ক্রিকেটারদের দেখো! ওরা শরীরটাকে কী দারুণ রেখেছে! কীভাবে যে মেইনেটইন করে ওরা…।’

হোক জিম্বাবুয়ের ক্রিকেটের অবনতির কারণে, হোক একজন রেস্টুরেন্ট কর্মীর চোখে, কারও কাছে কোনোভাবে তো বাংলাদেশের ক্রিকেটটাকে অনুসরণযোগ্য মনে হলো!