সেই সুখস্মৃতি সেই অতৃপ্তি

কী আনন্দ! ভারতের পর শ্রীলঙ্কাকেও হারিয়ে ফাইনালে ওঠার পর সাকিব ও নাসির
কী আনন্দ! ভারতের পর শ্রীলঙ্কাকেও হারিয়ে ফাইনালে ওঠার পর সাকিব ও নাসির

কোনো দল ‘ল্যাপ অব অনার’ তো দেয় শিরোপা জয়ের পর। কিন্তু এরা যে ফাইনালে উঠেই সারা মাঠ প্রদক্ষিণ করছে লাল-সবুজ উড়িয়ে! অবাক করা ঘটনা! চোখগুলো ডুবে আছে বিস্ময়ের ঘোরে, কিন্তু সবার মন পাখা ঝাপটে বলছে ঠিকই আছে। এটাই হওয়ার কথা। এই দলটি দৌড়টা শুরু করেছিল এক স্বপ্নমাখা পথে। এক টানে সেই দৌড়ের শেষ গন্তব্যে পৌঁছানোটাও সাফল্যের ইতিহাস। সেই ইতিহাসের উদ্যাপনই তো হওয়া উচিত।
মিরপুর স্টেডিয়ামের কী নাম দেওয়া যায় আজ? স্বপ্নপুর, উৎসবপুর না আনন্দপুর! সব কটা নামই মানিয়ে গেল। সারা বাংলাদেশই এদিন বিলীন মিরপুরে। ঘরে ফেরার রাস্তায় পা ফেলেও কিছু দর্শক জট পাকিয়ে থাকল গ্যালারির পাদানিতে। কণ্ঠে অবশিষ্ট শক্তিটুকু ঢেলে তারা স্লোগান তুলল ‘বাংলাদেশ’ ‘বাংলাদেশ’। কোথাও কোনো নিভৃত অঙ্গনে শব্দবাজিতে হলো উৎসব-বরণ। মহল্লার গলিপথ পেরিয়ে মিছিল ছুটল বড় রাস্তায়।
জেগে উঠল ‘পুয়ের্তা দেল সল’ কিংবা ‘ক্রাইস্ট দ্য রিডিমার’, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ‘অপরাজেয় বাংলা’—দেশের সব বিজয়গাথা উদ্যাপনের চত্বর। রাতটাকে নিঃসঙ্গ অন্ধকারে ছেড়ে দেওয়া যাবে না। উৎসবের রাতটাকে জড়িয়ে রাখুক অনিঃশেষ আনন্দের ফল্গুধারা।

গ্যালারির কোনো প্রান্তে লুকিয়ে ছিলেন এক সান্তা ক্লজ। সাকিব আল হাসান উপহার পেলেন বড় একটা রঙিন টুপি। ঠিক যেন ‘জোকারস হ্যাট’। বাংলাদেশের ক্রিকেট সান্তা ক্লজ ঘুরে বেড়াতে লাগলেন টুপি মাথায়। বুকের মধ্যে মধুর অনুভূতি দলা পাকিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ এশিয়া কাপের ফাইনালে! প্রথম ম্যাচে পাকিস্তানকে প্রায় হারের দুয়ার দেখিয়ে দ্বিতীয় ম্যাচে ভারতকে হারানো। পরের ম্যাচেই শ্রীলঙ্কাকে এমন দুরমুশ! ২০ মার্চ, ২০১২ তারিখটি বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসে লেখা হলো অনপনেয় কালিতে। একাদশ এশিয়া কাপের আসরটিই তো বাংলাদেশের ইতিহাসের চির-উজ্জ্বল এক স্মৃতির আধার!

কোনো খেলার বৈশ্বিক প্রতিযোগিতার পর একটি মাত্র মহাদেশীয় প্রতিযোগিতা আর নেই। ক্রিকেটের ব্যতিক্রম সেখানে এশিয়া কাপ। বিশ্বকাপে প্রবেশাধিকার পাওয়ার ১৩ বছর আগেই বাংলাদেশ এশিয়া কাপের প্রতিদ্বন্দ্বী। সেই প্রতিদ্বন্দ্বিতা আবার এত দিন সীমিত ছিল অংশ নেওয়ার গৌরবেই। তিন ‘বড় ভাই’ বা তিন বিশ্ব চ্যাম্পিয়নের পাশে বাংলাদেশ এই টুর্নামেন্টে কেবল সহযাত্রী থেকেছে ২০০৪ অষ্টম এশিয়া কাপ পর্যন্ত। সেবারই হংকংয়ের মতো পুঁচকেকে হারিয়ে প্রথম জয়ের স্বাদ। পরের টুর্নামেন্টে দ্বিতীয় জয় আরেক নিম্নবিত্ত সদস্য আরব আমিরাতের বিপক্ষে। তার পরও এশিয়া কাপ বাংলাদেশের কাছে ছিল শুধু অংশগ্রহণেরই নামান্তর। ভারত, শ্রীলঙ্কা বা পাকিস্তানের জন্য শিরোপা বরাদ্দ রেখেই বাংলাদেশের অধিনায়কেরা দাঁড়াতেন ট্রফি উন্মোচন অনুষ্ঠানে। বাংলাদেশ সংখ্যা বাড়াত, প্রতিদ্বন্দ্বিতা হতো বহুমাত্রিক।

কিন্তু দেশের মাটিতে এশিয়া কাপের তৃতীয় আয়োজনটা অলক্ষে যেন নিয়ে এল নতুন বার্তা। শুরুটাই হলো আশা জাগিয়ে। যে পাকিস্তান অস্পর্শনীয় দূরত্বে থেকে বাংলাদেশকে শুধুই দিচ্ছিল পরাজয়ের গ্লানি, তাদের দিকে চোখ রাঙিয়ে তাকানো গেল। যদিও দিন শেষে জয়টা থাকল খুব কাছে এসেও কত দূরে। দ্বিতীয় ম্যাচেই পা পড়ল জয়ের বন্দরে। সেটিও আবার মাত্রই এক বছর আগে দ্বিতীয়বার বিশ্বসেরার মুকুটজয়ী ভারতের বিপক্ষে। এই ভারত নতুন সেনাসজ্জিত ওয়ানডে ক্রিকেটের সত্যিকারের ডাকাবুকো দল। এদের একজন ছটফট করছিলেন শততম আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরির তৃষ্ণায়। তবে ওই যে বলা হলো, টুর্নামেন্টটাই মাঠে নেমেছিল বাংলাদেশকে এক প্রাপ্তির হাতছানি দিয়ে, তাই সবকিছু ঘটছিল নিজেদের চাওয়ামতোই। শচীন টেন্ডুলকার তাঁর চির-আরাধ্য শততম সেঞ্চুরিটি পেলেন, কিন্তু জিতল বাংলাদেশ। বিশ্ব ক্রিকেটের এই বরপুত্রের তিন অঙ্ক ছোঁয়া সেঞ্চুরিটি দেখতে চেয়েছিল এই দেশ, তবে নিজেদের পরাজয়ের বিনিময়ে নয়। তা-ই হলো। তারপর রাউন্ড রবিন লিগে নিজেদের শেষ ম্যাচে শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে ওই জয়। দারিদ্র্যের সব কষ্ট ধুয়ে বাংলাদেশের ক্রিকেট এক লহমায় ধনীদের ক্লাবে দাঁড়াল ফাইনালে নাম লিখিয়ে। সামর্থ্যটা অবশ্য অন্তঃসলিলা হয়ে বইছিল কিছুদিন ধরেই। বছর দেড়েক আগে এই মিরপুরেই নিউজিল্যান্ডকে ধবলধোলাইয়ে যেটির চূড়ান্ত স্বীকৃতি।

২২ মার্চ এল এশিয়া কাপের ফাইনাল নিয়ে। বাংলাদেশকে তার প্রথম আন্তর্জাতিক শিরোপা হাতে তোলার আশায় দুলিয়ে। আক্ষরিক অর্থেই। দেশের প্রতিটি প্রান্ত দুলে উঠল জয়ের আশায়। আজ সেই দিন, পাকিস্তান ১৩ বছর পর আবার বধ হবে মুশফিক বাহিনীর হাতে। এবার আর মাথা নোয়াবে না বাংলাদেশ! সারা দেশ প্রার্থনায়-প্রত্যাশায় একাত্ম। টেলিভিশনের পর্দায় কোটি মানুষের চোখ আটকে থাকল আঠার মতো। শহরের ইলেকট্রনিকস পণ্যের শোরুমগুলোর টিভি পর্দা পথচলতি হাজার মানুষের বিনে পয়সার উন্মুক্ত প্রেক্ষাগৃহ। শেষ ওভারে জয়ের জন্য দরকার ৯ রান। সম্ভব, খুবই সম্ভব। প্রথম চার বল থেকে এল ৬ রান। পঞ্চম বলে আউট আবদুর রাজ্জাক। পেন্ডুলামের মতো দুলতে থাকা আশাটা তখনই আসলে রং হারিয়ে ফ্যাকাশে। উইকেটে এলেন দশম ব্যাটসম্যান শাহাদাত হোসেন। ব্যাট হাতে একেবারেই এলেবেলে নন। বল ব্যাটের কানায় লেগে কত চার হয়ে যাওয়ার কত দৃষ্টান্তই তো আছে সীমিত ওভারের ক্রিকেটে। আইজাজ চিমা শেষ বলটি করলেন। বল ব্যাটে লাগাতে পারলেন না শাহাদাত। কোনো রকমে প্যাডে লাগিয়ে একটি রান নিলেন। ২ রানে হারল বাংলাদেশ। মিসবাহ-হাফিজরা জয়ের স্মারক স্টাম্প তুলে মাঠে উদ্যাপন করছেন। স্বপ্নপুরী থেকে হঠাৎই অতল স্তব্ধতায় ডুবে যাওয়া মিরপুর দেখল বিশ্ব ক্রিকেটের চির বিষণ্ন এক ছবি। চৈত্রের রাতে মুশফিকের চোখ বেয়ে নামছে শ্রাবণধারা। অধিনায়ককে সান্ত্বনার আলিঙ্গনে বেঁধে সাকিবও কোনো সুদূরে তাকানো অশ্রুসিক্ত নিঃস্ব মানুষ।
এই পরাজয়ের ব্যবচ্ছেদ চলেছে পরদিন। বহুদিন। ইশ্, শেষ ওভারটিতে শাহাদাত যদি দুটি নো-বলসহ পরম দানশীলতায় ১৯টি রান না দিতেন, যদি বাংলাদেশ ওদের চেয়ে ৭টি বেশি অতিরিক্ত রান না দিত, যদি নাজিমউদ্দিন ওপেনিংয়ে নেমে ৫২ বলে ১৬ রানের ভুতুড়ে ইনিংসটি না খেলতেন, যদি নাসির স্বভাববিরুদ্ধ মন্থর ব্যাটিং না করতেন...তাহলে বাংলাদেশ জিততই। তবে এতদিন পর কেন যেন মনে হচ্ছে, প্রহর শেষের আলোয় রাঙা ওই চৈত্র মাস শুরুতে আশার দিগন্ত বাড়িয়ে সর্বনাশেরই ছবি এঁকে রেখেছিল শেষটায়।

সব ‘যদি’ ও ‘কিন্তু’র সীমানা ছাড়িয়ে এটাই অবশ্য সত্য, ২০১২ এশিয়া কাপ বাংলাদেশের এক স্বপ্নময় অর্জন। সারা দেশকে তা ভাসিয়েছে আনন্দে, যাবতীয় দুঃখের মধ্যেও দেখিয়েছে ঘুরে দাঁড়ানোর শক্তি। রাজনীতির সব বিভেদ ভুলিয়ে এক সুতোয় বুনেছে জাতীয় ঐক্য।
একই আঙিনায় আবার এশিয়া কাপ। ফিরে ফিরে আসছে দুবছর আগের উজ্জ্বল সেই স্মৃতি।