'বিশ বছর আগে ও পরে'

রফিক আজাদের ওই কবিতার বিষয়ের সঙ্গে কোনোই মিল নেই। তার পরও কাল বিকেলে অন্ধকার নেমে আসা কলকাতায় কদিন আগে চলে যাওয়া কবির একটা কবিতার শিরোনাম খুব মনে পড়ছিল। ‘বিশ বছর আগে ও পরে।’
এখানে প্রমথ চৌধুরীকে ‘প্রথম চৌধুরী’ বলার কোনো ব্যাপার নেই। শোকাভিভূতকে ‘শোকাভূত’ বলারও। প্রেম-টেম তো নেই-ই। তবে বুক থেকে পাথর নেমে যাওয়ার উপমাটা অবশ্য চাইলে এখানেও খাটানো যায়। ঘণ্টা খানেকেরও বেশি ধরে চলা বৃষ্টি শেষ পর্যন্ত থেমে যাওয়ায় সৌরভ গাঙ্গুলীর বুক থেকে নিশ্চয়ই একটা ‘পাথর’ নেমে গেছে। নইলে যে তাঁর করে রাখা এত আয়োজন সব ভেস্তে যেত! ‘বিশ বছর আগে ও পরে’ একই ঘটনার সাক্ষী হতো ইডেন গার্ডেন।
বিশ বছর আগের ঘটনাটা আগে বলে নিই। বিশ বছর আগে এই ইডেনেই নতুন এক ধারার শুরু। সেই প্রথম বিশ্বকাপ ক্রিকেটে উদ্বোধনী অনুষ্ঠান। যাতে সবগুলো দল তো ছিলই, আরও অনেকের সঙ্গে মাত্রই বিশ্বসুন্দরী হয়ে আসা সুস্মিতা সেনও, তবে আসল আকর্ষণ ছিল অন্য। ইতালিয়ান জিয়ানফ্রাঙ্কো লুনেত্তার লেজার শো। সেই সময়ের বিচারে যা রীতিমতো রোমাঞ্চকর ব্যাপার। কিন্তু লুনেত্তার কপাল খারাপ, জগমোহন ডালমিয়ার আরও বেশি। গঙ্গা থেকে আসা দুর্বিনীত হাওয়া পর্দা-টর্দা সব উড়িয়ে নিয়ে সেই লেজার শোর বারোটা বাজিয়ে দিয়েছিল। যা নিয়ে এত হইচই, শেষ পর্যন্ত সেটির এমন হাস্যকর রূপ নেওয়ায় ওই উদ্বোধনী অনুষ্ঠান সম্পর্কে আমার লেখার প্রথম লাইনটা ছিল, ‘পর্বতের মূষিক প্রসব বোধ হয় একেই বলে!’

এবার বিশ বছর পরে আসি। ইডেনের জন্য এই ভারত-পাকিস্তান ম্যাচ ‘হঠাৎ হাওয়ায় ভেসে আসা ধন’। নিরাপত্তা নিয়ে ঝামেলা না হলে তো এই ম্যাচ ধর্মশালায় হয়। টুর্নামেন্টের বাকি সব ম্যাচ থেকে এটিকে আলাদা করে রাখতে সিএবির বিশেষ আয়োজনের কথা তো কাল এই ডায়েরিতেই জানিয়েছি আপনাদের। সেটি আদৌ হবে কি না, এ নিয়ে ভালোই সংশয় জেগেছিল। বিশ বছর আগে ছিল ঝোড়ো হাওয়া, বিশ বছর পর বৃষ্টি।
সেবার জগমোহন ডালমিয়া যদি বিয়ের আসরে ‘মেয়ের বাবা’ হয়ে থাকেন, এবার তা সৌরভ গাঙ্গুলী। সিএবি প্রেসিডেন্টের যেখানে আমন্ত্রিত অতিথিদের পাশে দাঁড়িয়ে থাকার কথা, সেখানে উল্টো সারাক্ষণ ছোটাছুটি করে বেড়াচ্ছেন। সৌরভের করুণ মুখ দেখেই বোধ হয় বৃষ্টি-দেবতার দয়া হলো।

দেরিতে হলেও অনুষ্ঠানটা হলো। ভালোই হলো। এটির জন্যই পাকিস্তান থেকে উড়ে এসেছেন ইমরান খান। যদিও আনন্দবাজার পত্রিকার দাবি, ইমরানকে আনার কৃতিত্বটা নাকি তাদের। হতেও পারে। কাল আনন্দবাজার-এর প্রথম পাতাজুড়ে ইমরান, শেষ পাতাজুড়েও। প্রথম পাতায় ইমরান খানের বিশেষ লেখা। শেষ পাতায় এই ম্যাচ নিয়ে বিশেষ সাক্ষাৎকার। যা দেখে ভাবছিলাম, বাংলাদেশের ম্যাচে প্রতিপক্ষ কোনো দলের ক্রিকেটারের লেখাটা প্রথম আলোয় এমন গুরুত্ব দিয়ে ছাপলে কেমন তুলকালাম কাণ্ড ঘটে যেত! এসব ভাবি আর দুঃখ লাগে, ক্রিকেটটাকে বোধ হয় খেলার বদলে আমরা জাতীয়তাবাদ ও দেশপ্রেম প্রকাশের এক মাধ্যম বানিয়ে ফেলেছি।

এসব দুঃখের কথা থাক। অনুষ্ঠানের কথা বলি। মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকে স্মারক উপহার নিতে ইমরানকেই ডাকা হলো প্রথমে। এর পর ক্রিকেটকে ইমরানেরই বড় দুই উপহার ওয়াসিম আকরাম ও ওয়াকার ইউনিস। সংবর্ধনা পেলেন ভারতের তিন সাবেকও—সুনীল গাভাস্কার, শচীন টেন্ডুলকার ও বীরেন্দর শেবাগ। ইডেন হাততালি দিল সবাইকেই। তবে সেটি সবচেয়ে বেশি বরাদ্দ থাকল টেন্ডুলকারের জন্য। বক্তৃতা দেওয়ার সময় টেন্ডুলকারের কণ্ঠ যে একটু বাষ্পরুদ্ধ শোনাল, সেটির কারণ বোধ হয় অনেক দিন পর স্টেডিয়ামভর্তি দর্শকের সেই ‘শচীন’ ‘শচীন’ কোরাস। বিদায়বেলায় বলেছিলেন, এই ‘শচীন’ ‘শচীন’ চিৎকারটা চিরদিন তাঁর কানে বাজবে। ওয়াংখেড়ের ওই দিনটা কাল যেন ফিরে এল ইডেনে।
ছয় ক্রিকেটারের সঙ্গে সংবর্ধনা মঞ্চে উঠলেন দুই অভিনেতাও। যাঁরা আবার পিতা-পুত্রও। অমিতাভ ও অভিষেক বচ্চন। অমিতাভের ব্যাপারটা না হয় বোঝা গেল। কিন্তু অভিষেক কী বিবেচনায় এই দলে ঢুকে গেলেন, এর ব্যাখ্যা খুঁজে পেলাম না। ‘অভিনেতা’ হিসেবে হলে তাঁর আগে আরও অনেকের নাম আসে। কে জানে, এটি হয়তো মাঠে উপস্থিত সবচেয়ে বিখ্যাত ভারতীয় সমর্থকের স্বীকৃতি। ভারতের জার্সি গায়ে খেলা দেখতে এসেছেন। উপহারও নিতে গেলেন সেটি পরেই।
বক্তৃতা দিলেন ইমরান খান, মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় ও অমিতাভ বচ্চনও। মমতা তাঁর শহরে পাকিস্তানকে আবারও স্বাগত জানিয়ে যতবার ইচ্ছা এখানে আসার আমন্ত্রণ জানিয়ে রাখলেন। অমিতাভ দিলেন দুই দেশের মধ্যে শান্তির ডাক। তাঁর ওপর আরেকটি দায়িত্বও ছিল। ম্যাচ শুরু হওয়ার আগে ভারতের জাতীয় সংগীত গাইলেন তিনি, পাকিস্তানেরটা গাইলেন শাফকাত আমানত আলী।

খেলাটা যে নির্ধারিত সময়ের এক ঘণ্টা পর শুরু হলো, মনে হয় না তার পুরোটা দায় বৃষ্টির। ম্যাচের আগের ওই পর্বটারও হয়তো ভূমিকা আছে। এ নিয়ে অনেক সাংবাদিককে অভিযোগ করতে শুনলাম। আমার কেন যেন ওই দলে যোগ দিতে ইচ্ছা হলো না। খেলা তো আগে-পরে হচ্ছেই, বাড়তি কিছু থাক না! চিয়ারগার্লদের নাচ তো আর দেখতে হচ্ছে না!