
‘সকলে গভীর ঘুমে মগ্ন। বাইরে শুধু কুকুরের গলার আওয়াজ, কিন্তু ছয় বছর বয়সী মুকুলের চোখে ঘুম নেই। নিজের মনে কী যেন এঁকে চলছে, বাবা-মা তাকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় অস্থির। কী এমন হলো ছেলের। মুকুল রাত জেগে জেগে ছবি আঁকে। ওর চোখে আবছা ধরা দেয় আগের জন্মে দেখা উট, মরুভূমি, ময়ূর। আর আঁকে একটা কেল্লার ছবি, সোনার কেল্লার ছবি।’ সত্যজিৎ রায়ের রহস্য রোমাঞ্চ উপন্যাস সোনার কেল্লার সেই মুকলের বাড়ি ছিল সোনার কেল্লায়। পূর্ব জন্মের ভিটে দেখতে মুকুল গিয়েছিল সোনার কেল্লা দেখতে। আর আমরা গিয়েছিলাম সেই কল্পকাহিনির ফাঁদে পড়ে।
সূর্য তখন উঠতে বসেছে। জানালায় উঁকি দিয়েই হতবাক। প্রকৃতির রং-রূপ এখানে ভিন্নতর। মাইলের পর মাইল রুক্ষ প্রকৃতি। মাঝে মাঝে বুনো ঝোপ। সিংহের কেশরের মতো সোনালি পাথরের চাং। দ্বিতল বাসটি জয়সলমীরে দাঁড়াতেই হুড়মুড় করে স্থানীয় গাইডরা বাসে উঠে পড়েন। ইয়া পাগড়ি পরা, রাজস্থানের তাগরাই গাইডদের সঙ্গে যখন যাত্রীদের কঠিন দরদাম চলছে, আমরা তখন ব্যাগ গুছিয়ে সুরুত করে নেমে পড়ি। গাইড তো লাগবেই, ইতিউতি তাকাতেই রাস্তার অপর পাশে উটের দড়ি হাতে উদাস মুখে দাঁড়ানো ১২-১৩ বছরের এক ছেলেকেই আমাদের নির্ভরযোগ্য মনে হয়। সে যে নিতান্ত বালক! এই দূর দেশে সেটাই আমাদের এক ভরসা দেয়। বালকের নাম বজরাং। বজরাং তার উটের গাড়ি হাঁকিয়ে আমাদের শহরের দিকে নিয়ে যাওয়ার বন্দোবস্ত করে।
বহুদূর থেকেই সোনার কেল্লাটা দেখা যায়। এক মাথা পাহাড়ের ওপর অতিকায় এক কেল্লা। সূর্যের আলো সুবর্ণ কেল্লার গায়ে প্রতিফলিত হয়। কেল্লার ফটকের কাছে গাড়ি থামে। বজরাং মালসামান নিয়ে ভেতরে ঢোকার জন্য তাড়া দেয়। কেল্লার ভেতরেই থাকব এমনটা সুরাহা হয়। কেল্লার রাজকীয় সদর দরজা পেরোনোর পরই ঢাল বেয়ে ওপরের দিকে উঠতে হয়। অতিকায় প্রবেশদ্বার পেরোনোর পরেই কেল্লার উঠান। কেল্লাবাসীরা ততক্ষণে জেগে উঠেছেন। পুরনারীরা বেরিয়েছেন সওদাপাতি কিনতে। জমজমাট এক শহর এখানে। বজরাং এতক্ষণে মুখ খুলল। স্পষ্ট ইংরেজিতে হাত-পা নাড়িয়ে খানিকটা ইতিহাস ঝেড়ে দিল। ‘এখন থেকে ৮০০ বছরেরও বেশি সময় আগে ১১৫৬ সালের দিকে গড়ে ওঠে এই কেল্লাটি। রাজপুত রাও জয়সাল এই ত্রিকূট পাহাড়ে গড়ে তোলেন তাঁর সাম্রাজ্য। তখন থেকেই বংশপরম্পরায় এখানে বাস করছেন রাজপুতরা, আর আছে স্থানীয় অধিবাসী।’ কথা বলতে বলতেই এ গলি, ও গলি পেরিয়ে হাজির হই প্রাচীন এক বাড়িতে। এটাই হোটেল। লটবহর হোটেল কক্ষে চালান করে আবার বেরিয়ে পড়ি পথে। কেল্লার অভ্যন্তরে মানুষের নিত্যদিনের গৃহস্থালি চলছে এখানে। সওদাগরেরা বসেছেন মনোহারী মালপত্তর নিয়ে। এটা-সেটা দেখতে দেখতে আমরা চলছি রাজমহলের দিকে। এই সাম্রাজ্যের রাজাধিরাজরা একসময় এখানেই থাকতেন। রাজবাড়ির উঠোনে এসে বজরং শোনায় দুঃখজাগানিয়া এক কাহিনী। ‘১৩০০ শতাব্দীতে এই কেল্লা আক্রমণ করেছিলেন আলাউদ্দীন খিলজী। কেল্লার তিন স্তরবিশিষ্ট প্রতিরক্ষা ভেঙে শত্রুরা ঢুকে পড়ে কেল্লায়। বীর রাজপুতদের রক্তে লাল হয়ে ওঠে এই সোনার পুরী। রাজমহলও আক্রান্ত হয়েছিল। তখন পুরনারীরা বেছে নেন স্বেচ্ছা মৃত্যু। শত্রুদের হাতে অপমানিত হওয়ার আগেই রাজনারীরা একসঙ্গে আত্মহত্যা করেন। নয় বছর পরে কেল্লা আবারও রাজপুতদের হস্তগত হয়। ২০০ বছর পরে মোগল সম্রাট হুমায়ুনের দ্বারাও আরেকবার আক্রান্ত হয়েছিল এই কেল্লা।’ সুবর্ণ পাথরপুরীর অলিতে-গলিতে কেটে যায় সারাটা দিন। সন্ধ্যার আগে আগে কেল্লার টাওয়ারে চড়ে বসি। একটু দূরেই থর মরুভূমি। মরুপ্রান্তর থেকে ছুটে আসা লু হাওয়ায় ভ্রম তৈরি হয়। চোখের সামনে ভেসে ওঠে খণ্ড খণ্ড দৃশ্য। বীর রাজপুতরা দুর্গ রক্ষায় প্রাণপণ লড়ছেন। দুর্গ পতনের খবর অন্দরমহলে পৌঁছাতেই নির্দ্বিধায় স্বেচ্ছা মৃত্যুর আয়োজন! আহা রে, এই অনাত্মীয় রাজপুতদের জন্য মনটা বড় খারাপ হয়ে যায়।
কীভাবে যাবেন
রাজস্থান বেড়ানোর জন্য শীতকালটাই বেছে নিন। রুক্ষ মরুভূমির এই দেশে গরমটা বড্ড বেশি। গত বছর শীতের সময় আমরাও গিয়েছিলাম দলবেঁধে। ঢাকা থেকে বিমান, বাস বা ট্রেনে করে কলকাতা যাবেন। এরপর কলকাতার হাওড়া থেকে রাজস্থানের রাজধানী জয়পুর পর্যন্ত বেশ কয়েকটি ট্রেন যায়। যেকোনো একটিতে চেপে বসুন। তারপর জয়পুর ঘুরে বাসে করে চলে যেতে পারেন সোজা জয়সলমীরে। এ ছাড়া দিল্লি থেকেও ট্রেন কিংবা বাসে যেতে পারবেন জয়সলমীরে। সোনার কেল্লার মধ্যেই থাকার ব্যবস্থা আছে। এ ছাড়া কেল্লার বাইরেও তৈরি হয়েছে অত্যাধুনিক সব হোটেল। দরদাম করে যেকোনো একটিতে উঠে পড়ুন।
